রক্তগঙ্গার মাঝে ভোজন বিলাস বীরত্বের লক্ষণ নয়
গত ১ জুলাই রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় গ্রেফতার হওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সপরিবারে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। গত কয়েকদিন আগে হাসনাত করিম এর বাবা রেজাউল করিম গণ মাধ্যমের কাছে তার ছেলের ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দেয়াকে নায়কোচিত বলে দাবি করেছেন। সেই সাথে পর্দানশীলতা এবং সুরা কালাম বলতে পারাকে সপরিবারে রক্ষা পাওয়ার কারণ হিসেবে দাবি করেছেন স্ত্রী শারমিন । তিনি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাঁদের সামনে ও পেছনের টেবিলে যারা ছিল, চোখের সামনেই প্রথমে তাদের গুলি করা হয়। এরপর চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। সন্ত্রাসীরা সবাইকে মাথা নিচু করে রাখতে বলে। সারারাতই হাসনাত এবং তাদের পরিবারকে একটি টেবিলে বসিয়ে রাখা হয়। ওই একই টেবিলে বসানো হয় আরও দুই তরুণী এবং দুই ব্যক্তিকে। তবে সকালে কমান্ডো অভিযানের আগেই জঙ্গিরা তাদের বেরিয়ে যেতে দেয় বলেও জানান শারমিন।
সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের আগে তাহমীদ হাসিবও অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু পুরনো ভিডিওর সাথে নতুন প্রকাশিত কিছু স্থির চিত্র তদন্ত কাজে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। বর্তমানে তাদের আট দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ছবিগুলোর শারীরিক ভাষা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রথম থেকেই হাসনাত করিমের বাবা তার ছেলের পক্ষে নির্লজ্জ সাফাই গাইবার মুহুর্মুহু বক্তব্য প্রদান ছিলো অত্যন্ত দায়িত্বহীন এবং সন্দেহজনক।
চুরির অপবাদ দিয়ে ১৩ বছরের শিশু রাজন হত্যার ঘটনা দেশবাসী ভুলে যায়নি। বাংলাদেশের সকল কাতারের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো দ্রুত আইনে বিচারের দাবিতে। হাসনাতের বাবার বক্তব্যে শুনে রাজন হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া আসামী চৌকিদার ময়না মিয়ার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো । একজন নিরক্ষর মানুষ হয়ে অভিযুক্ত আসামীর অভিভাবক ময়নার মা যা পেরেছিলেন তা পারলেন না হাসনাত করিমের বাবা। যদি সত্যিই ময়নার মায়ের ছেলে হত্যাকারী হয়ে থাকে তাহলে অন্যায়কে অন্যায় বলে নিজ সন্তানের ফাঁসি দাবি করেছেন তিনি। ময়নার মা সংবাদিকদের বলেছিলেন “আমার পোয়া যদি দুষি হয়ে থাকে আপনারা ফাঁসি দিলাউক্কা। আমার কোনো দুঃখ নাই। ওউ মায়ের বুক খালি হইছে, ছোট একখান পোলা আমার এতে দুঃখ লাগছে ।”
হাসনাত করিমের বাবা এবং ময়না মিয়ার মা দুজনেই সন্দেহে অভিযুক্ত আসামীর অভিভাবক। একজন অভিভাবক সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে চাইবেন এটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে অপরাধী সন্তানকে আইনের কাছে সোপর্দ করে ময়নার মা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলেও হাসনাত করিমের পিতার ভূমিকা খুবই লজ্জাজনক । ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা কখনো অভিভাবকদের এরুপ অন্ধ আচরণ আশা করি না। তার ছেলেকে আমরা সবাই বীর বলতে পারতাম যদি তিনি শুধু তার পরিবারকে না বাঁচিয়ে সকলকে বাঁচাতে পারতেন। আমরা সবাইকে বাঁচানোর মতো বীর চাই। হাসনাত এবং তার স্ত্রীর মতো বীর নাগরিক আমাদের কাছে কাম্য নয়। হাসনাত এবং তাহমীদ ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে ভিডিও এবং ছবিগুলো জোরালো ইঙ্গিত প্রদান করলেও আমরা জানি না যে তারা প্রকৃতই জঙ্গিদের দলভুক্ত কিনা । তবে সত্য উদ্ঘাটন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র ।
ইতোমধ্যে তাহমিদ হাসিবের জন্য মুক্তি চেয়ে ফেসবুকে "ফ্রি তাহমিদ" ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে আদাজল খেয়ে লেগেছেন এভারেস্ট জয়ী দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী ওয়াসফিয়া নাজরিন। কথা হচ্ছে ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে না জেনে যে কোনো পক্ষ অবলম্বন করার বিষয়টি এক রকম নিঃশব্দ সমর্থন। যারা আত্মীয় এবং কাছের মানুষ বলে অন্যায়কে সমর্থন দিচ্ছেন তাঁদের এ ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক হতে হবে। কারণ এখনকার সময়ে জঙ্গিদের পিতামাতারাই তাঁদের সন্তানদের জঙ্গি হওয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আর বন্ধু হয়ে তা বুঝে ওঠা এবং এ বিষয়ে সাফাই গাওয়াতো অনেক পরের বিষয়।
আসফিয়া নাজরীন আমাদের দেশের গর্ব। কিন্তু তিনি জানেন না জঙ্গিবাদের মতো একটি দেশীয়-আন্তর্জাতিক সমস্যার মোকাবেলা করা এবং এর কারণ এভারেস্ট জয়ের চেয়েও কঠিন। আত্মীয় স্বজন হলেই তিনি অপরাধী নন এবং তাদের ফ্রি ক্যাম্পেইন করতে হবে, এ ধরনের আচরণ হতাশাজনক । তাহমীদ এর বন্দুক হাতে হাসনাত করিমের প্রতি অবনত হওয়ার ভঙ্গিটি শারীরিক ভাষা বিশেষজ্ঞ দ্বারা তদন্তাধীন। এ পর্যায়ে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ হাতে না পেয়ে মন্তব্য করা দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। সাধারণ মানুষ এতোটুকু বোঝেন যে এতোবড় একটি ঘটনা তদন্ত শেষ হবার আগে মন্তব্য করা যায় না । কারণ কেউ একজন হুট করে একদিনে জঙ্গি হয়ে ওঠে না। জঙ্গি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় ধীরে ধীরে এবং বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে এবং অতি গোপনে। কোনো ব্যক্তি এক ধরনের আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ক্রমে সে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে তা চরমপন্থী আকার ধারণ করে।
আমরা শুধু জানি যে দেশি বিদেশি এতোগুলো মানুষকে একসাথে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু দেখিনি । হত্যার নির্মমতা বুঝতে পারি কিন্ত উপলব্ধি করতে পারি না। কারণ আমরা ইশরাত আখন্দ অথবা অবিন্তার বাবা মা নই। হাসনাত এর বাবা কখনোই বুঝবেন না হত্যার শিকার হওয়া এই স্বজনদের হাহাকার। তাই তারা এখন সন্তানের পক্ষে বীরত্ব গাথা তৈরি করতে গিয়ে নৈতিকতা সহমর্মিতা এবং মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছেন। গণমাধ্যমে বিশ্বজিৎ হত্যার ধারাবাহিক ভিডিওচিত্র সারা বাংলাদেশের মানুষ টেলিভিশনে দেখেছে। বিশ্বজিতের হত্যার মতই হত্যার শিকার হয়েছে মুক্তচিন্তার প্রতিটি মানুষ অভিজিৎ নিলয় বাবু অনন্ত দীপনসহ আরো অনেকে। মাঝে মাঝে অবিশ্বাস হয় কেমন করে, কিভাবে এবং কেনো এতো উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা মায়ের বয়সী, বোনের বয়সী নারীদের শরীর ছিন্ন ভিন্ন করেছে !
আমরা আইনের প্রতি আস্থাশীল । এই ঘটনায় হাসনাত তাহমীদ এর জড়িত হওয়ার স্বপক্ষের প্রমাণগুলো তদন্তেই প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে । তদন্তে নিরপরাধীরা ভুলভাবে শাস্তি পাক এ কখনো কারো কাছে কাম্য হতে পারে না। এও আমরা জানি সত্য নির্মম হলেও একসময় তা বের হয়ে আসবে। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজের মনে নিজে প্রশ্ন করি, ধর্মের সেবক জঙ্গিরা রোজার দিনে নামাজ না পরে জন্মদিন পালন করার জন্যে সপরিবার কেনো ঐ রকম একটি রেস্টুরেন্ট গেলো? তার উত্তর তাহমিদ হাসনাতের বাবা দেশবাসীকে আগে দিক। তার পরহেজগার ছেলের বউ তারাবিহ নামাজ না আদায় করে হিজাব পরে ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে চারদিকে লাশের স্তুপের মধ্যে সেহরী খেয়ে সকালে আত্মরক্ষা করে কেন বের হয়ে আসলেন? পর্দা হিজাব নিয়ে দেশবাসীকে কি ধরনের মেসেজ তিনি দিতে চেয়েছেন। ধানমন্ডিতে জঙ্গি রাশিকের বাবার দেয়া তথ্য অনুযায়ী হাসনাতের রাশিকের সাথে দেখা করার কি কারণ ছিলো, তার জবাব দিক। হাসনাতের স্ত্রী তার স্বামীর সকল কর্মকাণ্ডগুলোই কাছ থেকে দেখেছেন। নতুন যুক্ত হওয়া ছবিগুলো তদন্তে যে তথ্য দিচ্ছে সেই তথ্যগুলো প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে কি তিনি আগে দিয়েছিলেন? যদি না দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি কি তার স্বামীর মতোই অপরাধী নন? এতোগুলো মানুষ হত্যায় কেনো তিনি এই হিজাব সুরার কাহিনীর নাটক করলেন তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাঁর হিজাব সুরার কারণে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাটি জবাবদিহিতায় আনা হোক। কারণ তার এ বক্তব্যে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারী হত্যার মৌলবাদী ইঙ্গিত রয়েছে।
গুলশান ট্র্যাজেডির মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিষয়ে কোন একটি পক্ষ অবলম্বন করে তার পক্ষে ক্যাম্পেইন করা অন্ধত্বের লক্ষণ। উচ্চ বংশমর্যাদা ধন দৌলত আভিজাত্যকে কখনো অন্যায় ঢেকে ফেলার অস্ত্র বানানো কাম্য নয়। অন্যায়কে অন্যায় না বলে কারো ইমেজকে অন্ধভাবে বৈধতা দেয়া এক ধরনের দাস প্রথা। এরা এক ধরনের পীরের মুরিদ যারা অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে দেখতে পান না, সম্পদ অথবা জনপ্রিয়তাকে অন্যায়কারীকে রক্ষার করার ঢাল হিসাবে অনেকেই ব্যবহার করেন। আমরা প্রতিনিয়তই আমাদের সংস্কৃতিতে এ ধরনের মাছের মায়ের পুত্রশোক দেখতে পাই। সমাজে দুর্ঘটনার সময় এরা ঘাপটি মেরে বসে থেকে নিজের স্বার্থের হিসেব নিকেশ করেন। তারা কখনোই নিরপেক্ষ একটি অবস্থানে এসে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে দাঁড়াতে চান না। যার নুন খেয়েছি সে হত্যাকারী হলেও তার গুণ গাইতে হবে এ ধরনের গর্হিত মানসিকতা থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে ।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
এইচআর/এবিএস