ব্যাচেলররা কি কমলাপুরে থাকবে?
নচিকেতার একটা গান আছে, `পুরুষ মানুষ দুই প্রকার, জীবিত-বিবাহিত...`। কিন্তু গানটাতে এখন চেঞ্জ আনতে হবে, পুরুষ মানুষ দুই প্রকার, বিবাহিত ও ব্যাচেলর। ব্যাচেলররাই জীবিত। কিন্তু এই জীবিত ব্যাচেলররাই যেন সব নষ্টের গোড়া। এরা সমাজের শত্রু। এরা নরকের কীট। এদের কোনো কাজ নেই, খালি বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে প্রেম করার সুযোগ খোঁজেন। এখন আবার যুক্ত হয়েছে নয়া উৎপাত। ব্যাচেলররা সব নাকি জঙ্গী। বাসা ভাড়া নিয়ে এরা জঙ্গী ট্রেনিং নেয়, বোমা বানায়। তাই কস্মিনকালেও ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেয়া যাবে না। আমি নিশ্চিত ঢাকা শহরের এই সুশীল বাড়িওয়ালারা কোনোদিন ব্যাচেলর ছিলেন না। আমি আরো নিশ্চিত, এই বাড়িওয়ালা কোনোদিন তার মেয়েকে কোনো ব্যাচেলরের কাছে বিয়ে দেবেন না। ব্যাচেলররা এমনই ভয়ঙ্কর প্রাণি!
পত্রিকায় দেখলাম প্রায় ১১ লাখ ব্যাচেলর ঢাকায় মেস করে বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। কিন্তু ঢাকায় ব্যাচেলরদের বাসা পাওয়া সত্যিই কঠিন। অনেক বাসার সামনে লেখা থাকে, ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেয়া হয় না। তাই ব্যাচেলরদের বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মেসে থাকতে হয়, নইলে বেশি ভাড়া দিয়ে বাসা নিতে হয়। কিন্তু কল্যাণপুরে অপারেশন স্টর্ম ২৬-এর পর তাও এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমিও একসময় জীবিত ছিলাম।
৮৮ সালে ঢাকায় এসে প্রথমে আমি ৮৪ নয়াপল্টনে তৌহিদের মেসে থাকতাম। প্রিয় বন্ধু ও ব্যবসায়ী আবুল কাশেম এবং বর্তমানে জার্মানি প্রবাসী মিথুন কায়সার ছিলেন আমার রুমমেট। সাত রুমের সেই টানা ভবনে ২৫/৩০ জন মানুষের জন্য একটামাত্র বাথরুম ছিল। সকালে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হতো। একদিন হুট করে আমরা মেসটি ছেড়ে দিলাম। ভেবেছিলাম আরেকটা পেয়ে যাবো। কিন্তু পাইনি। মিথুন কয়েকদিন কমলাপুর রেলস্টেশনে রাত কাটিয়েছে। আমি একমাস উদ্বাস্তু ছিলাম। প্রতিদিন ব্যাগ কাঁধে ক্যাম্পাসে যেতাম। তারপর কোনো না কোনো বন্ধুর কাঁধে সওয়ার হতাম। পরে যাত্রাবাড়ি একটি মেসে ঠাঁই হয়। একটি নালার ওপরে গড়ে ওঠা সেই মেসে আমরা আসলে থাকতাম মশার ফাঁকে ফাঁকে। কয়েক বছরের টিকে থাকার সংগ্রাম শেষে যখন চাকরি বাকরি নিয়ে একটু থিতু হওয়ার কথা, তখন বাসা নিতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে।
অনেক সত্য মিথ্যা কথা বলে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া নিতে হয়। কেউ কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকে মাকে এনে বাসা ভাড়া নেন। কেউ বান্ধবীকে বউ সাজিয়ে বাসা ভাড়া নেন। আসিও বাড়ি থেকে আম্মাকে এনে ব্যাচেলারত্বের অপরাধ ঢাকতে পেরেছিলাম। ঢাকায় ব্যাচেলরদের এই সংগ্রাম নিত্যদিনের। ঢাকার বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলরদের যতটা অবিশ্বাস করেন, তারচেয়ে বেশি করেন তার স্ত্রী-কন্যাকে। পুরুষ ব্যাচেলরদের চেয়েও করুণ দশা একা নারীদের, হোন তিনি কর্মজীবী বা ছাত্রী। বাড়িওয়ালাদের চোখে ব্যাচেলর পুরুষ মানেই প্রেমিক, নারী মানেই অসামাজিক। কল্যাণপুরের ঘটনার পর ব্যাচেলরদের মরার ওপর এখন খাড়ার ঘা।
মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেয়া যাবে না, এমন কোনো নির্দেশনা দেননি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনানুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের স্থানীয় কর্তারা বাড়িওয়ালাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তাতেই ভয় পেয়ে অধিকাংশ বাড়িওয়ালা ব্যাচেলরদের বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন।
এটা ঠিক, দেশে জঙ্গীবাদের এই ভয়ঙ্কর উত্থানের সময় সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। সব ভাড়াটের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। যারা পুলিশকে তথ্য দেননি, বিপাকে পড়ছেন তারাই। বসুন্ধরায় জঙ্গীদের বাসা ভাড়া দেয়ার অভিযোগে এখন কারাগারে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভিসি। কারাগারে আছেন কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির মালিকও। তারা যদি ভাড়াটের যথাযথ তথ্য পুলিশকে দিতেন, তাহলে তারাও নিরাপদে থাকতে পারতেন, দেশও অনেক নিরাপদ থাকতো।
সতর্কতা আর ঢালাও বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া এক কথা নয়। প্রায় ১১ লাখ ব্যাচেলররা এখন কোথায় যাবেন? কমলাপুরেও তো সবার জায়গা হবে না।
এইচআর/এমএস