ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রাণের ঋতু বর্ষা

প্রকাশিত: ০৫:২২ এএম, ২১ জুলাই ২০১৬

ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে / পাছে সে আসবে তবে কেমন করে / এলে সে ঝরো না-হয় অঝরো ধারে / যাতে সে ফিরতে চেয়েও যেতে নাহি পারে.. মান্না দে যখন সুরের লহরি তুলে গাইতে থাকেন, মনে হয় সত্যি বর্ষা কত সর্ববিস্তারী, তা না হলে এতো প্রার্থনা কেন তার কাছে! বর্ষা কতটা সর্বব্যাপী শক্তির আধার হলে কবি তার কাছে আবেদনে অবনত হতে পারেন, গায়ক সুরের পসরা সাজিয়ে বলতে পারেন, বর্ষার কারণেই যেন অভিসার দীর্ঘস্থায়ী হয় তাঁর প্রেমিকা প্রেমিকের সঙ্গে মিলনে এসে সহজে ফিরে যেতে না পারে! সত্যি কি তবে বর্ষা বিচ্ছিন্ন করে দেয় মানুষ থেকে মানুষে, বর্ষা সংযুক্ত করে মানুষের মন? বোধ হয় তাই।

বিচ্ছিন্ন করে সমষ্টি থেকে তাকে বেঁধে ফেলে শুধু একজনেরই আত্মার বন্ধনে। এই বন্ধনকে যুক্ত করাও বলা চলে একের হৃদয়পুরে অন্যের অধিকার যেন। মেঘদূত-এর কথা আমরা কে না জানি? সেই যক্ষ-কান্তার উপাখ্যান! মেঘকে বাদ দিলে মেঘদূতে কিছু থাকে? থাকে না। আসলে ওটা বাতাসে ভেসে থাকা আকাশের নামমাত্র মেঘ নয়, জীবনেরই আরেক নাম প্রেমের জন্যে উড়ে উড়ে চলা। মেঘ এখানে দূত ঠিকই, এ দূত জীবনের প্রণোদনা যার কাছ থেকে বার্তা না এলে জীবন ফুরায়ে যায়। বর্ষাকে সামনে রেখে কালিদাস সেই কবে লিখেছেন মেঘদূত কিন্তু তার আবেদন কি নিঃশেষিত আজো? কালিদাসের কথা তুললে অনেকে বলতে পারেন, কালিদাস সংস্কৃত কবি আদিরস সংস্কৃত কাব্যে আদরণীয়, তাই তিনি মেঘ নিয়ে যক্ষ-কান্তার প্রেমোপাখ্যান তৈরি করেছেন। বাঙালি জীবনের সঙ্গে এর যোগ সামান্যই।

কথাটি সর্বার্থ সত্য নয়। বাঙালির প্রথম গ্রন্থ চর্যাপদে বর্ষার উল্লেখ নেই সত্য, কিন্তু এখানে কোথাও কোথাও এমন আবহ আছে, জল-নৌকার এমন বর্ণনা আছে নৈরামণি তার প্রেমিককে নিয়ে এ পরিবেশেই হারিয়ে যায় আপন খেয়ালে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, বর্ষাই জমিয়েছে তাদের হৃদয়ে উত্তাপ। গেলো কয়েকদিন হয় বাইরে বৃষ্টি অঝরে ঝরছে, ঘরে খাবারও নেই। কিন্তু মনকে বেঁধে রাখবে কে? বর্ষার আরবণে শবর-শবরীর পেটের ক্ষুধা মনের ক্ষুধার কাছে হার মানে। আর মধ্যযুগের কবিতাবলিতেতো বর্ষাই ভাসিয়ে দিয়েছে রাধাকে। কৃষ্ণ আর রাধা মিলে যে প্রেমবন্যা জাগিয়েছে, বর্ষার ইন্ধন আছে তাতে। এ বর্ষাকে আজ আর ঢাকায় জীবনযন্ত্রণার পলিথিনে ঢাকা থেকে কল্পনা করা যাবে না। সত্যি আমরা ঢাকা পড়ে আছি বিরূপ পরিবেশের ঢাকনার নিচে। ঢাকায় এখন বর্ষা আসে না, বৃষ্টি আসে। টানা বর্ষণের অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের রাজধানীবাসীর খুব একটা নেই। আমরা জানিই না কখন এলা বর্ষা, কখন চলে গেল বর্ষাকাল!

এক সময় কবি যে আর্তনাদ করেছেন: ‘ই ভরা বাদর মাহ ভাদর শুন্য মন্দির মোর’ বলে (‘ভরা ভাদ্রের বর্ষায় আমার ঘর সঙ্গীহীন’), সেই ভাদ্র মাস এখন কখন আসে কখন যায় আমরা জানি-ই না! বোঝা যায়, ভাদ্র মাসটা প্রচুর বর্ষণের মাস ছিল। ভারতীয় পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকালওতো ভাদ্র মাস। তাঁর জন্মের সময়ও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বিশ শতকে নজরুল ইসলাম বর্ষাকে লক্ষ্য করে লিখছেন: ‘ওগো বাদলের পরী! / যাবে কোন্ দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী! / ওগো ও ক্ষণিকা, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজি তব? / পহিল্ ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব?’ ভাদ্র আসার আগেই বর্ষা যেন পালাই পালাই করে। মধ্যযুগের সময় থেকে নজরুল অর্থাৎ প্রায় পাঁচশ বছর পরে বর্ষা ভাদ্র মাসকে যেন ত্যাগ করেছে। আজ নজরুল থেকেও একশ বছর পেরিয়ে বলতে হয় ভাদ্র মাসে বর্ষা আর নেই-ই যেন! তার মানে, ঋতু পরিবর্তনের ছবিটা কবিদের কবিতাতে স্পষ্ট। বর্ষা কি সত্যি পালিয়ে যাবে বাঙালির এই জনপদ থেকে? তা হয়তো নয়। কারণ দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামে গেলে এখনো বর্ষার দেখা মেলে। রাধার মুখ দিয়ে যে আর্তনাদ কবি করিয়েছেন, গ্রামে ভাদ্র মাসের অবিরাম বৃষ্টিতে এখনো কি বাঙালির মনকে তা স্পর্শ করে যায় না?

বর্ষা যে শুধু মিলন নিয়েই আসে তা নয়, তা কখনো মিলনে প্রতিবন্ধকতাও ঘটায়। মান্না দে-র গানে যেমন বর্ষার কাছে মিনতি ছিল, সে যেন অঝরো না ঝরে! অঝরো ঝরলে প্রেয়সী আসতে পারবে না তাঁর কাছে। মনে হতে পারে, এটা পুরুষের মিথ্যে কল্পনামাত্র। আসলে এ যে পুরুষের মিথ্যে কল্পনামাত্র নয়, নারীর মনোবেদনাও রাধা তার প্রমাণ। প্রচুর বৃষ্টিতে চারিদিক যখন ছেয়ে গেছে, বাইরে বের হবার জো নেই, তখন রাধা তার সখিকে বলেছে: ‘ঝর ঝর বরিষ সঘন জলধার / দশদিশ সবহু ভেল আঁধিয়ার? / এ সখি কিয়ে করব পরকার / অব জনু বারএ হরি অভিসার!’ অর্থাৎ বৃষ্টিতে চারিদিকে প্রচুর জল জমে যাচ্ছে, অন্ধকারও হয়ে যাচ্ছে চারিধার, সখি এখন আমি কি করব, আমার অভিসার যেন পণ্ড হতে বসেছে। সত্যি তো, রাধার বড় বিপদ! রাধার এ অস্বস্তি বর্ষার কারণে প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত না হতে পারার আশঙ্কায়। আর এমন আশঙ্কা-কাতরইতো মান্না দে তাঁর গানে।

আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে তরুণতম কবি চাণক্য বাড়ৈ- কার ভাবনায়-না বর্ষা এসেছে? রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ব্যতিক্রম সব দিক থেকে। ঋতুভিত্তিক লেখা ছিল তাঁর পরিকল্পনার অংশ। বর্ষার বহুবিচিত্র রূপরেখা তাই তাঁর মত করে আর কেউ তুলে ধরতে পারেন নি বাঙালির কাছে। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ মূলত বর্ষার কবিতা। জীবন আর দর্শনের এমন অনিন্দ্যসুন্দর কবিতা শিলাইদহে এক বর্ষার অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘নববর্ষা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে হৃদয় নাচে রে’- তখনই বোঝা যায় বর্ষা রবীন্দ্রনাথকে কেমন আকর্ষণ করেছিল। তাই ‘বর্ষামঙ্গল’ও রচনা করেন তিনি। বর্ষাকে তিনি মনে করতেন বাঙালির জীবনের ভরসাদায়ক ঋতু। তিনি লিখেছেন: ‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা, / গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা / দুলিছে পবনে সন সন বনবীথিকা, / গীতিময় তরুলতিকা।’ সত্যি, বর্ষা যে সম্ভাবনার ভরসা দেয়, নির্ভরতা দেয় বেঁচে ওঠার এবং বেঁচে থাকার তা অন্য কোনো লেখকের কবিতায় এতোটা বিস্তৃতভাবে আর আসে নি। শুধু প্রেম-অপ্রেমের খুনসুটিই রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নয়, তাঁর বর্ষা নবধারা জলে স্নান করে স্নিগ্ধ হবার বর্ষা, শুষ্ক মাটির বুক লাঙল দিয়ে ফসল বোনার মত উপযুক্ত করার বর্ষা।

রবীন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথ’ বলেই হয়তো বর্ষাকে তিনি করেছেন সর্ববিস্তারী, তুলে এনেছেন নানা লেখায়, নানা ভাবে। কিন্তু কবিদের কাছে বর্ষার আবেদন মূলত হৃদয়-কেন্দ্রিক। এ দিক থেকে কালিদাস বা চণ্ডীদাস অথবা হালের চাণক্য বাড়ৈ একই পথের মহাজন। তরুণতম কবি চাণক্য তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন: ‘আসছে বরষার মাস। / কণ্টকময় স্মৃতির আষাঢ়। চতুর কৃষ্ণের ফাঁদে মুর্ছা যায় সরলিনী রাধা / কোথায় নিষ্ঠুর কালা প্রাণের কানাই?’ বর্ষা এখনো আসে নি আসছে। বর্ষার আগমনের কথা চিন্তা করে এ তরুণ কবির অনুভবে কি বৃশ্চিকদংশন রাধাপুষ্পদলে!

আসলে রাধা প্রতীকমাত্র। বৈষ্ণবতাত্ত্বিকগণ বলেন, প্রতিটি মানুষই রাধা। কারণ মানুষমাত্রই মুক্তি-কামনায় ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হন। ‘রা’ মানে আওয়াজ বা শব্দ বা প্রাণ, আর ‘ধা’ মানে ধাবিত হওয়া। যে প্রাণ ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হয় সে প্রাণ-মাত্রই রাধা। রাধার মনোবেদন কি তবে প্রতিটি মানুষেরই অন্তরের আহাজারি নয়? বর্ষা আসলে বাঙালির প্রাণের ঋতু, উর্বরতার ঋতু। কৃষিপ্রধান এই দেশে এখনো বর্ষাই প্রার্থনীয় গ্রামীণ বাঙালির ঘরে ঘরে। আর কোনো ঋতুর জন্য তারা হাহাকার করে না, কাতর হয় না, যেমনটা কাতর হয় বর্ষার জন্য। সময় মতো বর্ষা না এলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার হাত ওঠে তাদের- ‘মেঘ দে, পানি দে’ বলে তারা সমলয়ে তোলে গান। এতো আগ্রহ যার জন্য, সেই বর্ষা এই জনপদ থেকে একেবারে হারিয়ে যাবে না। যেহেতু মানব-মানবীর হৃদয়ে এর অধিষ্ঠান সেহেতু এই ঋতু হারাতে পারে না কিছুতেই।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এবিএস

আরও পড়ুন