ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কেন প্যারিস রক্তাক্ত হয় বারবার?

প্রকাশিত: ০৫:৪৮ এএম, ১৬ জুলাই ২০১৬

আবারো ফ্রান্স, আবারো হামলা। ছবি, কবিতা, সৌন্দর্য আর শান্তির দেশ হঠাৎ যেন কেমন আতংকের জনপদ হয়ে গেলো। শুক্রবার জাতীয় উৎসবের মাঝে হঠাৎই দানবের আগমন। বোমা আর বিষ্ফোরক বোঝাই ট্রাক নিয়ে উঠে গেলো নিরপরাধ নারী, পুরুষ আর শিশুর উপর। মারা গেলো অসংখ্য মানুষ। শার্লি এ্যাব্দো, নাইট ক্লাব, বাস্তিল দুর্গ পতনের উৎসব। ফ্রান্স হয়ে উঠছে সন্ত্রাসী আর জঙ্গি গোষ্ঠির টার্গেট।
 
কেন ফ্রান্স টার্গেট? বিভিন্ন মুসলিম দেশের সাথে ফ্রান্সের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। অন্য অনেক পশ্চিমা দেশের তুলনায় মুসলিম দেশগুলোর সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক পুরোনো এবং নিবিড়। সেই ১৮৩০ সালে, যখন দেশটি আলজেরিয়া বিজয় করলো, তারপর থেকে মুসলিম আফ্রিকার সাথে যোগাযোগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সিরিয়া এবং লেবাননও আসে ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে। বহু ফরাসি নাগরিক উত্তর আমেরকায় পাড়ি জমায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর আমেরিকা থেকে অনেকে আসে ফ্রান্সে। এরা মূলত প্যারিস, লিয়ন এবং ফ্রান্সের উত্তর অংশে শিল্প ও ব্যবসা-বানিজ্য গড়ে তুলে। একটা সময় এরাই হয়ে উঠে ফরাসি জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ। ফরাসি সংস্কৃতির বাইরে থেকে এলেও এদের সাথে জাতিগত বা ধর্মীয় কোন সমস্যা দেখা দেয়নি।   

দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আলজেরিয়াকে ছাড়ে ফ্রান্স। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ আলজেরিয়ানদের মধ্যে যারা ফরাসিদের পক্ষে ছিল এরা দক্ষণাংশে আস্তানা গাড়ে এবং দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রাখে। দক্ষিনপন্থি জাতীয় ফ্রন্টের সূচনা সেখান থেকেই। ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের মতো মতো ফ্রান্স কখনোই তার সাবেক উপনিবেশদের পুরোপুরি ছেড়ে দেয়নি। অর্থনৈতিক এবং সামরিক হস্তক্ষেপ বরাবরই বজায় রেখেছে। মালি, ইরাক এবং সিরিয়ায় আল কায়েদা ও আইসিস বিরোধী যুদ্ধেও ফরাসি ভূমিকা জোরালো। তাই জেহাদি ধারণায় উদ্বুদ্ধ তরুণরা সহজেই ইরাক বা সিরিয়ায় বা সামাজিক মাধ্যমে ফরাসি ভাষায় কথা বলা মানুষ পায় যারা মনে করিয়ে দেয় উপনিবেশ আমলে ফরাসিদের আচরণের কথা। আর ২০১০ সালে মুখ ঢেকে রাখা বোরখা নিষিদ্ধ করার পর ফ্রান্স হয়ে উঠে অনেক বড় টার্গেট।
     
আধুনিক ফ্রান্স অনেকদিন থেকেই সচেষ্ট নাগরিকদের ধর্মীয় গোড়ামি থেকে সরিয়ে রাখার। এই প্রচেষ্টায় সমাজে তারা চার্চের গুরুত্বও অনেক কমিয়ে এনেছে ধীরে ধীরে। শার্লি এ্যাব্দো সাময়িকীর মতো প্রকাশনাও আছে যারা সব ধর্ম নিয়েই কটাক্ষ করে থাকে। একদিকে এমন প্রচেষ্টা, অন্যদিকে এই ফরাসিদের মাঝেই চরম ডানপন্থিদের উথ্যান দেখা যাচ্ছে। “the time for hypocrisy was over,” বলে যারা এখন ফ্রান্সে সক্রিয় তারা মনে করছে ইসলামই আধুনিক ফ্রান্সের আগামীর পথে সবচেয়ে বড় সমস্যা।

ইউরোপ থেকে আইসিসের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া সংখ্যাও রীতিমত উদ্বেগজনক। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্রিটেনের ৭৫০, বেলজিয়ামের ৫২০, জার্মানির ৬০০ নাগরিক সিরিয়া এবং ইরাকে আইসিসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছে। ব্রিটেনের অন্তত ৫০ জন মারা গেছে। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিলের হিসাবে ফ্রান্স থেকে আইসিসে যোগ দিয়েছে ১৫৫০ জন।
 
বিষয়টি খুবই বিস্ময়কর যে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এমন হারে জেহাদি গ্রুপে যোগ দেয়া। ফ্রান্সে অনেক মুসলমান রয়েছে। দেশটির জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মুসলিম এবং জেলে আটকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মুসলমান। মুসলমানরা অপরাধপ্রবণ হিসেবে সমাজে চিহ্নিত সেখানে।

আইসিস ইউরোপীয় দেশ হিসাবে ফ্রান্সকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। আইসিসের শীর্ষ মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল-আদানি একবার বলেছিলেন, ‘তোমরা অবিশ্বাসী আমেরিকান কিংবা ইউরোপীয়ান কাউকে হত্যা করতে পারো বিশেষ করে ফ্রান্সের ওপর, সেটা যে উপায়ে হোক’। ফ্রান্স আইসিসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র।
 
পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করে। সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে দেশটি আইসিসের অন্যতম প্রধান উৎস। যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব অল্প কিছু লোক আইসিসে যোগ দিতে সিরিয়া এবং ইরাকে গেছে। আইসিস মূলত ফ্রান্সে মুসলিম বিরোধী উস্কানি বাড়িয়ে দিতে চাইছে। তারা চায় এখানে মুসলমানদের হত্যা করা হোক, এখানে গৃহযুদ্ধ হোক, তবেই মুসলিম জনগোষ্ঠি আইসিস সমর্থক হয়ে উঠবে।

দীর্ঘ দিন ধরে ফ্রান্সে বসবাস করলেও মুসলমানদের একটা বড় অংশ মূলধারার ফরাসী সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের মাঝে ইসলামিক স্টেটের প্রতি এক ধরণের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। যে পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে আইসিসের আসল সংঘাত সেই পশ্চিমা সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে প্যারিস। পশ্চিমা সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র প্যারিসে হামলার মধ্য দিয়ে তারা এই লড়াই টিকে দুটো সভ্যতার লড়াই হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তারা জানে এই লড়াইটিকে দুটো সভ্যতা ও সংস্কৃতির লড়াই হিসেবে তুলে ধরতে পারলে যুদ্ধটি আরো এক ধাপ এগিয়ে একটি বৈশ্বিক রুপ পাবে। এটি বিশ্ব জুড়ে মুসলিমদের মাঝে ‘জেহাদী জোশ’ বাড়িয়ে দিতে পারবে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া ওঁলাদের নির্দেশে ফরাসী বিমান বাহিনী সিরিয়ায় আইসিসকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাচ্ছে। শুক্রবারের ট্রাক হামলার পরও ওঁলাদ বলেছেন হামলা বন্ধ হবে না। আইসিসের সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকা। কিন্ত ভৌগলিক অবস্থান এবং বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে তাদের পক্ষে সেখানে হামলা চালানো কঠিন। ভৌগলিকভাবে সুবিধাজনক হওয়ায় ফ্রান্সই সহজ টার্গেট হয়ে উঠেছে। বিপুল সংখ্যক মুসলিমের আবাস স্থল হওয়ায় তাদের পক্ষে সেখানে আত্মগোপনে থেকে হামলার পরিকল্পনা করাও খানিকটা সহজ। ইউরোপে ভিসাবিহীন অবাধ মুক্ত চলাচলের সুযোগ এবং অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতাকেও তারা এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ এবং তার সোশালিস্ট পার্টি এখন দুর্বল অবস্থানে আছে। তার বিরোধী দক্ষিণপন্থি মেরি লে পেনের ন্যাশনাল ফ্রন্ট রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে আছে। আগামী ডিসেম্বরে আঞ্চলিক নির্বাচনে জিতে যায় তাহলে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে মেরি লে পেনের দল একধাপ এগিয়ে যাবে। ফলে ওলাঁদের রাজনৈতিক জীবনের জন্য সংকটময় মুহূর্ত এখন। ওলাঁদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে আইসিস। তাদের এই হামলা যে বিশ্বে, বিশেষ করে ফ্রান্সের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিকভাবে প্রভাব ফেলবে সেটা আইসিস খুব ভালো করেই জানে। আইএসিস এও জানে, ওলাঁদ তার দুর্বলতা ঢাকতে এবং রাজনৈতিক সংকট কাটাতে বড় ধরনের অভিযান চালাবে আইএসিসের বিরুদ্ধে। এখান থেকেও সুবিধা নিতে চায় আইসিস। আইসিস ধারণা ফ্রান্স যত যুদ্ধে যাবে আইসিসের বিরুদ্ধে, ততই বেশি বেশি করে ফরাসি মুসলমানরা তাদের দলে যোগ দেবে।

shtiaque-Reza-Porichi

এআরএস/এমএস

আরও পড়ুন