ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তোর কপালে খারাবি আছে

প্রকাশিত: ০২:১৩ এএম, ১৫ জুলাই ২০১৬

ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনে আসছি। ‘তোর কপালে খারাবি আছে’ এই কথাটা শুনতে শুনতেই যেন জীবনটা পার করে দিচ্ছি। মনে পড়ে আমি তখন বেশ ছোট। পুরানো ঢাকায় আমাদের বাড়ির পাশেই বস্তি। সেখানে একটি মেয়ে থাকতো। নাম সুফি। বয়সটা আমারই মতো। ওর বাবা রিকশা চালাতো। একদিন চালায় তো পরদিন জুয়ায় সেই টাকা উড়ায়। সুফির মা ‘ছুটা বুয়া’র কাজ করে আমাদের বাড়িতে। সুফি আসে মায়ের সঙ্গে। আমার সঙ্গে খেলা করে। যদিও আমার মায়ের একদম ইচ্ছা নয় যে, বস্তির মেয়ে আমার খেলার সাথী হোক। সুফি আসে, তাকিয়ে থাকে আমার খেলনাগুলোর দিকে।

একদিন একটা পুতুল ওকে দিয়ে দিলাম। কিন্তু ওর মা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি সেটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রেখে দিল। ভয়, পাছে মেয়ের চুরির অপবাদে তার চাকরিটা চলে যায়। আরেকদিন ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে ওর হাতে দিতেই আমার মা দেখে ফেললেন। বললেন, ওকে এটা দিচ্ছ কেন? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘আমি খাবো, ও খাবে না কেন?’ না, প্রশ্নের উত্তরটা সেদিন পাইনি। বরং অন্য কিছু পেয়েছিলাম। আর শুনেছিলাম, এত প্রশ্ন যে করে তার কপালে খারাবি আছে। যতই কথাটা শুনি না কেন, তবু আমার মাথা থেকে প্রশ্নগুলো যায় না। অকারণে অজায়গায় আমার মাথায় প্রশ্ন কিলবিল করে ওঠে।

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন দেখতাম, মেয়েদের হলের গেট সন্ধ্যা হতে না হতেই বন্ধ হয়ে যেত। বাড়িতেও সন্ধ্যার পর মেয়েদের একা চলাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ। অনেক বাড়িতে অবশ্য শুধু সন্ধ্যার পর নয়, দিনের বেলাতেও মেয়েদের একা চলা নিষেধ। অথচ আমাদেরই সহপাঠী ছেলেরা বাড়ি ফিরতো রাতে। তাদের হলের গেট বন্ধ হতো না মোটেই। রোকেয়া হলের গেট বন্ধ হলেই ছেলেবন্ধুরা আওয়াজ দিত, ‘বেলা গেল সন্ধ্যা হলো হাঁসমুরগি ঘরে তোলো।’

আমি প্রশ্ন তুলতাম, কেন মেয়েরা সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারবে না? জবাব পেতাম নিরাপত্তার অভাবে। নিরাপত্তার অভাবটা কেন? সন্ধ্যায় কি ঢাকার রাস্তায় বাঘ ভালুক বের হয়? কারা তৈরি করে এই নিরাপত্তাহীনতা? কতিপয় পুরুষ? তাহলে তাদের কেন সন্ধ্যার পর আটকে রাখা হয় না? বাঘ ভালুকে মানুষের উপর হামলা করে, তাই তাদের খাঁচায় আটকানো হয়। ভালো মানুষ তো খাঁচায় থাকে না। তাহলে যারা মেয়েদের উপর হামলা করে, তাদের খাঁচায় আটকানো হোক। নিয়ম করা হোক সন্ধ্যার পর রাস্তায় কোনো পুরুষ বের হতে পারবে না। যদি সঙ্গে কোনো নারী থাকে তবেই সে বের হতে পারবে। এমন নিয়ম করলে তো আর মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় জাগে না।

যখন দেখতাম আমার কোনো বান্ধবীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো কারণ রাস্তাঘাটে কতগুলো বখাটে ওকে দেখে আজেবাজে কথা বলতো। আমি বলতাম, যারা বিরক্ত করে তাদের ধরে শাস্তি দেওয়া হোক, ওর লেখাপড়া কেন বন্ধ হলো? সব সময় দেখেছি দোষ থাক না থাক ঘুরে ফিরে শাস্তি পেতে হয় নারীকেই। অপবাদও জোটে নারীরই বেশি। আর একটু কিছু হলেই বলে দেওয়া হয় , ‘মেয়েটা খারাপ’। যেন ‘খারাপ মেয়ে’ হলেই তার আর কোনো বিচার চাওয়ার অধিকার নেই। আর ‘খারাপ মেয়ে’ না ‘ভালো মেয়ে’ সেটা নির্ধারণই বা করলো কে? কিসের ভিত্তিতেই বা এই ভালো-খারাপের সংজ্ঞা দেওয়া হলো?

যখন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হলো তখনও শুনলাম রুনির নাকি ‘পরকীয়া’ প্রেম ছিল। যেন পরকীয়া প্রেম করলে সে নারীকে হত্যা করার লাইসেন্স পাওয়া যায়। বলা হয়নি কিন্তু সাগর পরকীয়া করতো, কিংবা সেই কথিত প্রেমিকের নামও শোনা যায়নি। অথচ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য একজন মৃত মানুষকে অসম্মানিত করা হলো, তার প্রতি কৃত অপরাধের গুরুত্বকে লঘু করার প্রচেষ্টা নেওয়া হলো। আর আজও পর্যন্ত কেন অপরাধীদের ধরা হলো না, কেন শেষ হলো না আজও সেই ৪৮ ঘন্টা? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব বোধহয় কখনোই পাওয়া যাবে না।

তনুর হত্যাকারীদের আজও পর্যন্ত ধরা গেল না। উপরন্তু ধর্ষণের মতো অপরাধকে লঘুভাবে বলা হলো ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’। কি অদ্ভুত কথা! নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতরে টিউশনি শেষ করে বাড়ি ফেরার পথেই যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার এবং খুন হলো তার খুনিদের তো এখন পর্যন্ত ধরা হলোই না উপরন্তু  এমন কথা বলা যেন ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ করে বেড়ানোই ছিল মেয়েটির কাজ। প্রশ্ন জাগে, কাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এখানে? শেষ পর্যন্ত অপরাধীদের কি ধরা যাবে? নাকি পুরো ঘটনাটিই ধামাচাপা পড়ে যাবে?

মাদকাসক্ত তরুণী ঐশীকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে আমাদের সমাজের বাধে না, কিন্তু আজও পর্যন্ত একজন মাদক ব্যবসায়ীকে ফাঁসির মঞ্চে দেখতে পেলাম না কেন, সে প্রশ্নটি অবিরল মাথায় ঘুরপাক খায়। মিতু হত্যা নিয়েও একগাদা প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে। এখানে মিতু ‘পরকীয়া প্রেম’ করতেন কি না করতেন সে কথা তো অবান্তর। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে কেউ যদি অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে যান তার জন্য ডিভোর্সের পথ তো খোলাই রয়েছে। রয়েছে সেপারেশনেরও পথ। প্রেমের শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড নয়। তিনি প্রেম করতেন অতএব তাকে হত্যার অধিকার স্বামীর রয়েছে একথা বলে শুধু অপরাধের গুরুত্বকে লঘু করার অপচেষ্টাই করা হয়, তার বেশি কিছু নয়। বড় কথা হলো, সন্তানকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে হত্যা করা হলো মাকে। খুনিদের ধরাও হলো। কিন্তু কার নির্দেশে কেন এই হত্যাকাণ্ড তা ঢেকে রাখার কি প্রাণপণ চেষ্টা। বাবুল আক্তারের নির্দেশেই যদি খুন হয় তাহলে ‘চাকরি ছাড়া’, ‘বিদেশ যাওয়া’ তো তার শাস্তি নয়। তার শাস্তি হবে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। নাকি পুলিশ বাহিনীর জন্য পেনাল কোড আলাদা? আর যদি তিনি অপরাধী না হয়ে থাকেন তাহলে এত ঢাক ঢাক গুড়গুড় কেন? কাকে বাঁচাতে?
নাহ আর প্রশ্ন করবো না, তাহলে কপালে সত্যিই হয়তো খারাবি আছে।

লেখক: কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর