জঙ্গিবাদ দমনে এত উদ্যোগ, নিষ্ফল সবই!
গত ১১ জুলাই ক্ষমতাসীন ১৪ দল জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ করেছে। তারা ২০ জুলাই ঢাকায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিভাবক সমাবেশ এবং ২১ জুলাই নারী সমাবেশ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। সন্তানদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অভিভাবক ও নারীদের সচেতন করতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সমাবেশ থেকে ২৪ জুলাইয়ের পর পর্যায়ক্রমে জেলায় জেলায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচি পালনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়।
উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এতদিন পরে কেন? এদেশে কী জঙ্গিবাদ গুলশান ট্র্যাজেডির পরই দেখা দিয়েছে। বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরেও সরকারের কেউ জঙ্গিবাদের বিস্তারকে গুরুত্ব দেয়নি। দেরি হলেও রাজনৈতিক শক্তি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে, কিন্তু সন্দেহ রয়ে যায় এইসব কর্মসূচি লোক দেখানো কিনা? জঙ্গিরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন রাজনৈতিক শক্তি যদি মাঠে নামে তাহলে জঙ্গিরা পালাবেই।
রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি প্রশাসনিক উদ্যোগও একই তালে চলতে হবে। কিন্তু সেরকম উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। বিভিন্ন সময় সরকার যেসব উদ্যোগের কথা বলেছে তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হতে দেখিনি। সরকার ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। প্রথম কয়েক বছর ওই কমিটি বৈঠকই করেনি। ২০১৩ সালে তৃতীয় বৈঠকে জঙ্গি দমনে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয় ওই কমিটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাংলাদেশে কোনো নাগরিক বা সংগঠনের অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক তহবিল (সিএসআর) থেকে জঙ্গিবাদে কোনো অর্থ ব্যয় হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকীকরণ ও পাঠ্যসূচিতে জঙ্গিবাদবিরোধী লেখা অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নিবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাদ্রাসার বইগুলোর সঙ্গে কোরআন ও হাদিসের কী কী বৈপরীত্য রয়েছে তা চিহ্নিত করার কাজটি করবে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন। জঙ্গিবাদবিরোধী তথ্য চিত্র ও স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং জঙ্গিবাদের নেতিবাচক দিক ও এর প্রভাব নিয়ে নিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করবে তথ্য মন্ত্রণালয়।
তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, জঙ্গিবাদ নিয়ে নাটক নির্মাণ করে সেগুলো প্রচারের ব্যবস্থা করার। গণযোগাযোগ বিভাগের সহায়তা নিয়ে সেগুলো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রদর্শনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে প্রতি মাসে একটি করে জঙ্গিবাদবিরোধী নাটক প্রচার করে সে ব্যবস্থা নিতেও তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই কমিটি পুলিশের বিশেষ বিভাগ, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, ডিজিএফআইসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল দেশের সব ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কঠোর নজরদারি করার জন্য। আল কায়েদা ও আইএসসহ অন্যান্য জঙ্গিসংগঠনের তৎপরতার বিষয়ে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
কমিটির পরবর্তী বৈঠকে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। পুলিশ আর ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়া কোনও সংস্থাই প্রতিবেদন জমা দেয়নি। পরবর্তী বৈঠক হয়েছে তিন বছর আগে, এই তিন বছরেও কী কোনো অগ্রগতি আছে ওইসব সিদ্ধান্তের। যদি সরকারের ওইসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হতো তাহলে এখন সারাদেশে যে চাপাতি অভিযান চালাচ্ছে জঙ্গিরা সেটা নিশ্চয়ই এত ভয়াবহ আকার নিতে পারতো না।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটির ওই বৈঠকেই জেলা উপজেলাগুলোতে জনসভার মাধ্যমে দেশব্যাপী জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত তিন বছরে কোনো সভা সমাবেশ হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এখন ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সারাবিশ্ব যখন কাপিয়ে দিয়েছে জঙ্গিরা তখন টনক নড়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জোটের, কিন্তু সরকার চালায় যে আমলাতন্ত্র তাদের কি টনক নড়বে? নয়তো এতগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও কেন তা বাস্তবায়নে কোনো গরজ ছিল না।
আমরা শুনেছি প্রধানমন্ত্রীও এসব কমিটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জঙ্গি বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোর খবর জানতে চেয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন এগুলো কি কাজ করছে? কাজ না করলে নতুন করে কমিটি গঠন করা হোক। আমরা এও দেখেছি জঙ্গিবাদ দমনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হলেও তদারকির অভাবে একসময় সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এসব কমিটির নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নেয় অপরাধীরা।
আশা করি রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবার প্রশাসনের ভেতরের জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের খুঁজে বের করবেন, নয়তো কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।
লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ
এইচআর/পিআর