উৎকর্ষ
শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। জাতীয় দৈনিকে প্রবন্ধ, নিবন্ধ আর টেলিভিশনের টকশোতে গলা ফাটিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলছেন জিপিএ-৫ পাওয়া আর ভাল শিক্ষার্থী হওয়া এক নয়। এ নিয়ে এখন বিস্তর আলোচনা।
শিক্ষার আসল কথাই হলো ‘শেখা’। তবে প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীর শেখার সামর্থ্য এক নয়। সবাই সমান শেখেনা। আর সেজন্যইতো কতনা পরীক্ষার আয়োজন। প্রমাণ করা যে কে কতটুকু শিখতে পারলো। এসব পরীক্ষা আমাদের দেশে যেমন, উন্নত দেশেও থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে লক্ষ্য থাকে প্রতিটি মানুষকে সুযোগ করে দিতে। সুযোগ পেলে প্রশ্ন আসে কে কতটুকু শিখছে।
আমরা আজও একটি ভারসাম্যপূর্ণ একক শিক্ষা পদ্ধতি করতে পারলাম না। স্কুল আছে নানা ধরনের, নানা মর্যাদার, নানা শ্রেণির, ধনিদের একরকম, দরিদ্রদের একরকম, মধ্যবিত্তদের জন্য আরেক রকম, আছে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা আছে- তাও কয়েক ধরনের।
শহুরে নামী স্কুলের ছেলে মেয়েরা ভাল ফলাফল করে, তাদের দখলেই চাকুরির বাজার। দু’একজন যে প্রতিভা দেখিয়ে সুদূর গ্রাম কিংবা হতদরিদ্র পরিবার থেকে বেরিয়ে আসেনা তাও নয়, কিন্তু তা শুধুই ব্যতিক্রম।
শহরে ছেলেমেয়রা স্কুলে যত পড়ে, তার চেয়ে বেশি দৌড়ায় কোচিং-এ। এই দৌড়ঝাঁপ একা নয়, মা-বাবাসহ। কোচিং না করলে ফলাফল ভাল হবে না। এ যে শিক্ষা নয়, পরীক্ষার ফল কেনা।
শিক্ষার বহু মাপকাঠিতেই বাংলাদেশ বিশ্বমানতো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার মানেও বেশ পিছিয়ে। সেই অবস্থা থেকে উঠে আসার কাজটা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। তার জন্য সময় লাগবে। মান নিয়ে সরকার ভাবছে, তাই এর মধ্যেই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করে প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণিতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষায় প্রধান দুটি সমস্যা সবসময় আলোচনায়। একটি হলো স্কুলে কিছু না শেখা এবং অতি-গৃহশিক্ষকনির্ভরতা বা কোচিং। বিতর্ক আছে সরকারি বা বেসরকারি স্কুলের মান নিয়েও। সরকারি বা বেসরকারি, কোনও স্কুল বা কলেজেই আসলে শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। এদেশে এক সময় ছিল গৃহশিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা, এখন তা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়ে নাম হয়েছে কোচিং। বাস্তবতা এই যে, স্কুলের খাতায় নাম থাকা আর সত্যই লেখাপড়া শেখার মধ্যে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে আসছে। এমন বাস্তব স্বস্তিদায়ক যে নয় তা সম্প্রতি এক টেলিভিশনের বিশেষ রিপোর্টে কিছুটা প্রদর্শিত হয়েছে।
কেন স্কুল বা কলেজে লেখাপড়া শেখা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠলো, এই প্রশ্নটিকে শিক্ষাবিষয়ক আলোচনার মূলে নিয়ে আসা যায়। গবেষণাও করা দরকার। কিন্তু শিক্ষার মূলে রয়েছে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা। আমরা সেরকম শিক্ষক পাচ্ছি কম। বেতনকড়ি কম, তাই ভাল ছাত্রছাত্রীরা এ পেশায় আসেনা। যারা আসেন তাদের ভেতর বাণিজ্যিক মানসিকতা অনেক বেশি। ফলে কোচিং-ও বেশি।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কাজ এখন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত পাঠ্যক্রম শেষ করে দেয়া। তার কি দেখার সময় বা প্রয়োজন আছে কোন ছাত্র/ছাত্রী পিছিয়ে পড়লো, কার কতখানি মনোযোগ প্রয়োজন? এসব কথা ভাববার অবকাশ শিক্ষকদের থাকে না। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষকের উপস্থিতির হার, বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি সমস্যাও আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বড় সমস্যা। বিশেষ করে সরকারি স্কুলে। সরকারি স্কুলের পাকা চাকুরি দৃশ্যত শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা বাড়ায়নি।
গোটা দেশেই স্কুলের অবস্থা খারাপ, সরকারি স্কুল, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের সরকারি স্কুলের অবস্থা আরো খারাপ। অন্যদিকে বেসরকারি স্কুলের বাণিজ্যিক আগ্রাসনও চোখে পড়ার মতো। গৃহশিক্ষক নির্ভরতা বা কোচিং-এর চড়া হার আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার প্রতিই অনাস্থার প্রকাশ। শুনলে অবাক হতে হয় যে, ইংরেজি মাধ্যমে প্রচুর পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে, শুধু কোচিং-এ পাঠায় এবং পরীক্ষা দেয়ায়।
এই সমস্যা সর্বত্র। প্রচুর শিক্ষক পাওয়া যাবে যারা স্কুলের গণ্ডিতেই পা রাখেন না বহুদিন। রাজধানীতে যে সমস্যা, রাজধানীর বাইরেও তা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভাজিত রাজনীতির অসুখ বা মারাত্মক কু-অভ্যাস। শিক্ষকতার চাকুরিকে রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে ব্যবহার করা। প্রাথমিক থেকে কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার প্রধান, কার্যত একমাত্র, যোগ্যতা এখন শাসকদলের ঝাণ্ডা নিয়ে দৌড়ানো। শাসক বদলায়, অভ্যাস থাকে। রাজনীতির ঠিক দিকে থাকতে পারলেই আর কোনও চিন্তা নাই, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত এই বিশ্বাসটি আমাদের সরকারিতো বটেই এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোকেও ধ্বংস করছে।
আজ যখন শিক্ষামন্ত্রী নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলেন শিক্ষা তখন তার ঘারে এই দায়িত্ব বর্তায় যে রাজনীতির এই ছবি তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মুছে দেবেন। শিক্ষকদের দায়বদ্ধ করে তুলেই না কেবল তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব নেয়া যায়। শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে রাখলে উন্নয়নয়ের পথে কতদূর হাঁটবো আমরা?
এইচআর/পিআর