প্রাণ ও প্রকৃতির বিপন্নতা
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রকৃতি একটি নিজস্ব নিয়মে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি কিছু উপাদান বর্জন করে আর কিছু গ্রহণ করে। কিংবা এভাবেও বলা যায় যে, বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি নিজের প্রয়োজনে একটি পথ তৈরি করে নেয়। এই পথ অনেকটা বিরাণ কোনো মাঠের ওপর তৈরি করা নতুন সড়কের মতো। নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের ফলে যেখানে স্থানীয় লতা-গুল্ম বা ঝোপঝাড়গুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার যুক্ত হয় গবেষণাগার থেকে উদ্ভাবিত কোনো বৃক্ষের উন্নত রকমফের। কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব শক্তি থেকে বেঁচে থাকা আর কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। ফলে প্রাণবৈচিত্রের ধারাবাহিকতা চরমভাবে ব্যাহত হয়।
অব্যাহতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, নানামাত্রিক দূষণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং সর্বোপরি নির্বিচারে বনউজাড় প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টে সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অবশ্য বড় মাত্রায় পরিবেশ দূষণে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা খুব একটা নেই। উন্নত দেশগুলোই এমন আত্মঘাতি কাজে সরাসরি জড়িত। আমাদের দেশের কলকারখানার দূষিত বর্জ্য ও ধোঁয়া পরিবেশের যে পরিমাণ ক্ষতি করে তারচেয়ে কয়েকশগুণ ক্ষতি করে উন্নত দেশগুলো। অথচ এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদেরকেই বেশি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে তারাই আবার পরিবেশ সুরক্ষার কাজে বেশি সোচ্চার। আর এসব তোড়জোড়ের অধিকাংশই লোক দেখানো।
বিভিন্ন সভা সমিতি সম্মেলন ও কর্মশালার আয়োজন করে উন্নত দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। তাদের সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু সারাবিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারেন না। বিভিন্ন দেশগুলোকে ক্ষতিকর গ্যাস প্রবাহের যে মাত্রা বেঁধে দেয়া হয় শেষ পর্যন্ত কেউ আর তা মেনে চলে না। এমনকি প্রায় সব সম্মেলন শেষ হয় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই। তাই বলে সভা সমিতির কাজ থেমে নেই এবং এব্যাপারে উৎসাহেরও কমতি নেই।
এই সম্মেলনে কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছে উন্নত দেশের প্রতিনিধিরা। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আলোচনা, তর্কবিতর্ক ও দর-কষাকষি শেষে ১২ ডিসেম্বর জলবায়ু চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বিশ্ব। ফ্রান্সের প্যারিসে আইনি বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তির চূড়ান্ত খসড়ায় সম্মতি দেয় ১৯৫টি দেশ। তবে এ বিষয়ে চুক্তিটি প্যারিসে স্বাক্ষরিত হয়নি। এবছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ সভায় রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা তাতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রির বেশ খানিকটা নিচে রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বের সবক’টি শিল্পোন্নত দেশসহ ১৯০টি দেশ কার্বন নিঃসরণের স্বতঃপ্রণোদিত অঙ্গীকার বা আইএনডিসিকে চুক্তির অংশ হিসেবে অনুমোদন করেছে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার এবং ২০১৬ থেকে ২০২০-এর মধ্যে মোট ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার যে অঙ্গীকার শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো কানকুন সম্মেলনে করেছিল, তা থেকেও তারা পিছিয়ে এসেছে। চুক্তিতে অর্থায়ন কে করবে, কীভাবে হবে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
নাসার সাবেক বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন প্যারিসের জলবায়ু-সংক্রান্ত আলোচনাকে জোচ্চুরি বলে আখ্যায়িত করেছেন। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এটা নিশ্চিতভাবেই একটি প্রবঞ্চনা। এটা বলা একটা ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই না যে, দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আমরা সীমাবদ্ধ থাকবো। আর প্রতি পাঁচ বছর পরপর পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করব। এসব কথা একেবারে অর্থহীন। পরিস্থিতির উন্নয়নে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নেই। আছে শুধু প্রতিশ্রুতি।
কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের পরিচালক বিজর্ন লুমবুর্গ বলেন, প্যারিস চুক্তিতে নানা ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এই চুক্তির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, এই চুক্তিতে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ১০ হাজার কোটি ডলারের যে তহবিলের কথা হয়েছে, তা খুবই কম। কেননা এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রির নিচে রাখতে হলে প্রতিবছর রাষ্ট্রগুলোকে এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিষাক্ত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে তা আমাদের দেশকে প্রতিনিয়তই দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালোথাবায় প্রকৃতির অনবদ্য ধারাবাহিকতাও বিঘিœত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন একসময় আসবে যখন ঋতু বৈচিত্র্য বলে আর কিছু থাকবে না। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে। তার কিছু ইংগিতও আমরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। শীতকালে শীতের তীব্রতা কম থাকা, বর্ষায় বৃষ্টির স্বল্পতা, কিংবা অমৌসুমে বৃষ্টিপাত, আবার প্রলম্বিত গ্রীষ্মকাল। অন্যদিকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে শরৎ ও হেমন্তকালের পরিধি। আমাদের অনুভবে শরৎ বা হেমন্ত এখন আর আগের মতো প্রাণময় হয়ে ধরা দেয় না। এতদিন প্রকৃতি যে নির্দিষ্ট ছকে হেঁটেছে তার থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এখন। বিশেষত বৃক্ষ জগতেও নানামাত্রিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে সারাবিশ্ব এক ঘোরতর দুর্দিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আসলে জলবায়ু পরির্বতনের ভয়াবহতা কতটা তীব্র ও ভয়ঙ্কর হতে পারে তার কিছুই আমরা এখনো উপলব্ধি করে উঠতে পারিনি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য আরো একশ বছর আগেই শিল্পোন্নত দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতার বাজারে বিজ্ঞানীদের এসব সতর্ক বার্তা কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। আর আমাদের দেশে এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তীব্র ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আমাদের করণীয় কি, নোনা জলে কোন ধরনের শস্য ফলানো যাবে, কিভাবে অন্নসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে ইত্যাদি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি।
প্রযুক্তিগত দূষণ ছাড়া আমাদের দেশে যে গর্হিত কাজটি দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে তার নাম বনউজাড় ও বৃক্ষ নিধন। গাছপালা হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রাণ। যেখানে কোনো গাছ নেই সেখানে কোনো প্রাণ নেই। গাছপালা আছে, সব কিছু আছে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিদের জীবনে গাছপালার ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা দুএক কথায় বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন তা গাছপালাই শোধন করে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেয়। প্রতিবছর আমাদের উপকুলীয় এলাকাগুলোতে যে সব ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে তা থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারে গাছপালার নিবিড় ও নিশ্চিদ্র বুনন। গাছের আচ্ছাদন ঝড় ও জলের গতি কমিয়ে দিতে পারে। তেমনি তাপমাত্রাও কমিয়ে দিতে পারে। মাটির ক্ষয়রোধ করে ভূ-ভাগের উচ্চতা সমুন্নত রাখতে পারে। প্রাণিদের খাবার দাবারের যোগানও গাছপালা থেকেই আসে। তা ছাড়া বনভূমিই হচ্ছে জীবজন্তুর সবচেয়ে প্রিয় আবাস। আমাদের প্রতিদিনের খাবারদাবারের বেশিরভাগই আসে তরু জগতের মাধ্যমে। সর্বোপরি সমগ্র প্রতিবেশব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করছে বনভূমি। এসব তো কেবল বনভূমির অতি দরকারি কতগুলো দিক। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে মানুষ যখন ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুরে পথে বের হয় তখন গাছের ছায়া খোঁজে। গাছের ছায়ায় দু-দণ্ড বিশ্রাম নেয়। ভালোবেসে সুন্দর ফুল ও ফলের গাছগুলো ঘরের পাশে লাগিয়ে রাখে। গাছের ফুল ফল পাতা থেকে ওষুধ বানায়।
কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল উপকূলের ২৮ ভাগ মানুষ যে কোনো সময় ঘরবাড়ি হারাতে পারে, দুর্যোগ মোকাবিলায় খাপ খাইয়ে নিচ্ছে উপকূলবাসী”। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, উপকূলে বসবাসকারী দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। যে কোনো সময় তারা উদ্বাস্তু হয়ে যেতে পারে। এই গবেষণাপত্রে আরো বলা হয় বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা বজায় না থাকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফসল উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে এবং এ কারণে খাদ্যঘাটতিও মারাত্মক আকার ধারন করবে।
এই গবেষণা তথ্যেও সর্বোচ্চ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে উপকূলকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু দুর্যোগ অঞ্চলের এসব মানুষ কি স্থায়ীভাবে না অস্থায়ীভাবে উদ্বাস্তু হবেন তার কোনো স্পষ্ট বক্তব্য সেখানে পাওয়া যায় না। শুধু বলা হয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার কথা। কিন্তু এই তিন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আমাদের নিত্য সঙ্গী। কিন্তু তার মাত্র কয়েকদিন আগে আরেকটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ ডুববে না, বড় ঝুঁকিতে খাদ্য নিরাপত্তা।” এই প্রতিবেদনে অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ ভাগ এলাকা ডুবে যাবে বলে যে প্রচারণা চলছে তা ঠিক নয়। দেশের উপকূলজুড়ে থাকা বাঁধ ও পোল্ডার আমাদের রক্ষা করবে। তবে কিভাবে তাঁরা এ ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত হলেন তার উৎস সম্পর্কে কিছুই জানান নি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এমন দুটি পরস্পর বিরোধী প্রতিবেদন আমাদের বিভ্রান্ত করে।
বছর কয়েক আগে ঢাকায় জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৮টি দেশের ২১০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকালোয় কি কি করণীয় এবং পাশাপাশি খাদ্য ঘাটতি কমাতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সে সম্পর্কে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয় সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সেমিনারে জানানো হয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে শতকরা ৩০ ভাগ খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে। খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় ৬ দিনের এই সিম্পোজিয়ামে পরবর্তী কর্মকৌশল নিয়েও প্রতিনিধিরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।
দক্ষিণ এশীয় এই জলবায়ু সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তার শিরোনাম ছিল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ৫০টি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেবে।এতে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় রাখার কথা বলা হয়। আর এখানেও অগ্রাধিকারে রাখা হয় বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের বিষয়টি। অনুষ্ঠানে যে প্রাসঙ্গিক শব্দগুলো বার বার উঠে এসেছে সেগুলো হচ্ছে- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ঘাটতি ইত্যাদি। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হচ্ছে উষ্ণতা। অর্থাৎ আমাদের সবাইকে উষ্ণতা হ্রাসে একযোগে কাজ করতে হবে। কিন্তু একানে উষ্ণতা হ্রাসের উপায় নিয়ে খুব বেশি কথা হয়নি।
শুধু বিষাক্ত গ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই কি এর সমাধান সম্ভব, বা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিংবা অতীতে যা হয়েছে সেগুলো কিভাবে শোধন করা সম্ভব। আমরা জানি উষ্ণতা কমাতে বিশ্বব্যাপী বৃক্ষ রোপণের কোনো বিকল্প নেই। দুঃখের বিষয় যে এসব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গাছপালার ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রতিনিধিত্বশীল কর্মকৌশল দেখা যায় না। মাঠ পর্যায়ের কোনো উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সম্পৃক্ততাও চোখে পড়ে না। সাধারণত কর্মকৌশল নির্ধারণে কিছু মুখস্ত বুলি আউড়ানো হয়। এসব সম্মেলনকে ঘিরে থাকে একদল স্বার্থপর, অদক্ষ, মেরুদন্ডহীন মানুষ। যারা নিজের দেশের স্বার্থের চেয়ে বিদেশি স্বার্থের কথা বলে বেশি তৃপ্তি পান। এসব অদক্ষদের দাপটে আমাদের সমাজের যোগ্য প্রতিনিধিরা কখনই কথা বলার সুযোগ পান না। একারণে সমস্ত কর্মপরিকল্পনায় থাকে শুভঙ্করের ফাঁকি।
প্রায় দশ বছর আগে গাজীপুরে একটি ফল বাগান দেখতে গিয়েছিলাম। বাগানের কর্তাব্যক্তি গাছপালা ঘুরে দেখানোর ফাঁকে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন এখানে দেশীয় সব রকম ফলগাছই আছে, কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন কোনো একটি দেশি ফলের গাছ নেই, তাঁকে দশহাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। আমি সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বললাম গাছ তো অনেক কিন্তু ফল দেখছি না কোনো গাছে। তিনি কোনো ভণিতা না করেই সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের ইটভাটাগুলোকে দায়ি করলেন। চিমনির ধোঁয়া থেকে নির্গত বিষাক্ত কণিকা গাছের কোনো ফুলকে আর ফলে পরিণত হতে দেয় না। ইটভাটায় চিমনির উচ্চতা যতটা হওয়া উচিত ঠিক ততটা না হওয়ায় এই সমস্যা আরো গুরুতর হয়েছে। আবার ইটভাটাগুলো অবৈধভাবে লোকালয়েই গড়ে ইঠেছে। তাই সমস্যা শুধু ফল বাগানেই নয়, ফসলের ক্ষেত্রেও।
আমাদের মতো একটি অনুন্নত দেশে রাতারাতি পরিবেশ বদলে ফেলা প্রায় অসম্ভব। শিল্পনগরী খুলনার কথাই ধরা যাক। সেখানকার কলকারখানার বর্জ্যগুলো শোধন ছাড়াই পরিত্যক্ত মাঠ কিংবা জলা বা খাল হয়ে নদীতে যায়। অদূরেই মংলা বন্দর। বন্দরে ভেড়া জাহাজগুলোর বর্জ্যও ফেলে দেয়া হয় নদীতে। ইতোমধ্যেই এসব বর্জ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের হাতে এমন কোনো ম্যাজিক নেই যে রাতারাতি সব কিছু বদলে দেয়া যাবে। কাজেই আগাতে হবে পরিকল্পিত উপায়ে।
শুধুমাত্র সমন্বিত উদ্যোগই এমন একটি জটিল সমস্যা থেকে উত্তরণের সহজ পথ হতে পারে। প্রথমত গণসচেতনতা, দ্বিতীয়ত সরকারের নজরদারি, তৃতীয়ত আইনের কঠিন প্রয়োগ, চতুর্থত অর্থনৈতিক ভারসাম্যতা। উলি¬খিত সকল উপাদানগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির সমন্বয় তৈরি হলে আমরা কেবল উন্নয়নের পথে কয়েক পা আগাতে পারি। সচেতনতা এ ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক। মানুষ সুশিক্ষিত হলেই কেবল সচেতন হতে পারে। সঙ্গে যদি সচ্ছলতা যোগ হয় তার ফলাফল নিঃসন্দেহে ভালো। যে কারণে আমরা উন্নত দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের কোনো দৃশ্য সচরাচর দেখি না। সবাই সচেতন, এক টুকরো কাগজও কেউ নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে ফেলবে না। ইচ্ছা করলেই একটা গাছ কাটা যায় না, বন উজাড় করা যায় না, খাল-নদী এসব দখল করা যায় না, যেখানে সেখানে বাড়ি কিংবা কারখানা বানানো যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে এর সবই সম্ভব।
ফরাসী লেখক জাঁ গিওনোর ‘দি ম্যান হু প্লান্টেড ট্রিস’ গল্পটির কথা মনে পড়ে? এই অমর গল্পের মূল নায়ক একজন মেষ পালক, নাম অ্যালজার্ড বুফিয়ের। যিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে ফ্রান্সের এক বিজন ও রুক্ষ উপত্যকায় গাছ লাগিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন শত শত ওক ও বার্চের বীজ বুনতেন পাহাড়ের ঢালু উপত্যকায়। এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন সেই মরুময় উপত্যকা সহস্র বৃক্ষে সুশোভিত হয়ে ওঠে। বুফিয়ের একা একাই স্বত:প্রণোদিত হয়ে এমন অসাধ্য সাধন করেছিলেন। যে কোনো পরিবর্তনের জন্য মাত্র একজন নিষ্ঠাবান মানুষের উদ্যোগই বেশ বড়সড় পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের দেশে হয়ত বুফিয়ের-এর মতো কাউকে পাওয়া যাবে না কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও নিভৃতে সমাজ পরিবর্তনের কাজটি করে চলেছেন। তারা যেমন সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছেন আবার দেখাচ্ছেনও। এরাই আমাদের বুফিয়ের। পত্রিকার মাধ্যমে আমরা এমন খবরগুলো প্রায়ই জানতে পারি।
ইচ্ছে করলেই আমরা এই দেশটাকে আবারো সবুজে মুড়িয়ে দিতে পারি। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমাদের এই ভূ-ভাগ তুলনামূলকভাবে অনেক নবীন। এটা আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ। এই সুযোটাই যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখা দরকার, মানুষ কখনো বন তৈরি করতে পারে না। বন তৈরি হয় নিজস্ব প্রাকৃতিক নিয়মে। শত শত বছরের প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতায় কেবল বনভূমি গড়ে উঠতে পারে। অন্য কোনোভাবে নয়। এ কারণেই মানুষ শুধু বৃক্ষায়নের কাজটিই করতে পারে। প্রসঙ্গত বনায়ন শব্দটিও আক্ষরিক অর্থে ভিত্তিহীন ও ভুয়া। আমাদের মাটি এতই উর্বর যে কোথাও দুটি গাছ রোপণ করলে কয়েক বছর পর দেখা যায়, সেখানে আরো দশটি গাছ আপনাআপনিই জন্মেছে। এটা আমাদের মাটির গুণ। গাছপালা লাগানোর ক্ষেত্রে সমগ্র উপকুলকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। উপকুলীয় অঞ্চলগুলো সংরক্ষিত থাকলে আমরা অনেকটাই নিরাপদে থাকব।
একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, খুবই স্বল্প পরিসরের কোনো একটি পতিত স্থান হরেকরকম তৃণ-গুল্মে আচ্ছাদিত। এত স্বল্প পরিসরে গাছপালার এত বিচিত্রতা সত্যিই দুর্লভ। দেশজুড়ে একই চিত্র চোখে পড়বে। মৃত্তিকার আপন গুণই এখানে গাছপালার অফুরাণ প্রাণশক্তি। পুরনো দালান কোঠার ফাঁকফোকরে জন্ম নেয় অনেক পরজীবী; বট, অশ্বত্থ, ফার্ণ। তাছাড়া উষ্ণমণ্ডলের বীজগুলো অপেক্ষাকৃত কষ্টসহিষ্ণু। এরা বংশবিস্তারের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে পারে। আমাদের দক্ষিণের নোনা জলের বন এবং বিল-হাওরের উদ্ভিদরাজিরও প্রজনন প্রক্রিয়া একই। বর্ষার উপচেপড়া পানিতে আশপাশের তৃণ-গুল্ম আপাত দৃষ্টিতে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু পানি শুকিয়ে যেতে যেতে আবারো নবজন্মে উদ্বেলিত হয় নতুন প্রাণ। সবচেয়ে বড় কথা এখানে সবুজায়নের জন্য খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। অথচ একবার শীত প্রধান দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। তাদের গ্রীষ্ম মাত্র তিন-চারমাস। যদি কপাল মন্দ হয়, তাহলে মাঝে মাঝে গ্রীষ্ম উপভোগ করারও কোনো সুযোগ হয় না। সেখানে যখন গ্রীষ্ম একটু একটু করে উঁকিঝুকি দিতে শুরু করে তখন থেকেই শুরু হয় বাগান সজ্জার কাজ। গোটা শীতকাল বাগানটা যখন বরফের নিচে চাপা থাকে তখন সেখানে আর কোনো প্রাণের স্পন্দন থাকে না। ফলে গ্রীষ্মে ওদেরকে অনেকটা শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়। ওরা দশটা গাছের পরিচর্যার জন্য যে অর্থ ব্যয় করে আমাদের একটি বাগানের জন্যও তা ব্যয় হয় না বা করা যায় না। প্রকৃতির এই অফুরাণ প্রাণসম্পদকে আমরা খুব সহজেই কাজে লাগাতে পারি।
লেখক : প্রকৃতিবিদ
[email protected]
এইচআর/পিআর