মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এই তো সময়
সংগ্রাম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগের ৬৭ বছর পূর্ণ হতে চলছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালির যা কিছু অর্জন জাতির আত্মপরিচয়, ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র সব কিছুরই রূপকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করান।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় একসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী দূরদর্শী, প্রতিভাবান নেতা আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন বলেই এই দলের পক্ষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সর্বগ্রাসী শোষণের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্গঠন করে জাতির পিতা যখন সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই ’৭১-এর পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। থেমে যায় দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকা। শুরু হয় হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। দেশমাতৃকার টানে ১৯৮১ সালে দলের সভাপতির দায়িত্ব নেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার অবর্তমানে নেতৃত্বের শূন্যতা পূর্ণ হয়। শুরু হয় জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার নতুন সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রায় তিন যুগ ধরে আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাচ্ছে দীপ্ত পায়ে, সৃষ্টি করেছে নব নব ইতিহাস।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। গত ৬৭ বছরে এই দল অঙ্কুর থেকে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। স্বল্প পরিসরের লেখায় ঐতিহ্যবাহী এই দলের অনেক কিছুই বিধৃত করা সম্ভব নয়। এ সীমাবদ্ধতা আগেই উল্লেখ করে নিচ্ছি।
১৯৪৭ সালে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রবর্ধমান বৈষম্যের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার শুরুতেই বাঙালির মোহ ভঙ্গ হয়। বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষণে বলেছেন, ‘৪৭ সালেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছি। এর মধ্য থেকেই আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।’
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার ওপর আঘাত করে। সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হয়। এই ছাত্র সংগঠনই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় বাঙালির জাতীয় আন্দোলনের অগ্রসর শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম লীগের প্রচণ্ড দুঃশাসন ও দমননীতির মুখে এক বৈরী পরিবেশে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’ এক কর্মী সম্মেলনের ভিতর দিয়ে আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে বন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক একটি মাইলফলক। আওয়ামী লীগই ধারাবাহিকভাবে সব মাইলফলক অতিক্রম করে জাতিকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নার ঢাকা সফরের প্রাক্কালে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সচিবালয়ের সামনে ছাত্র-গণবিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। শেখ মুজিবসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে গণজাগরণে পরিণত হয়। অব্যাহত রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার তরুণ সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান কারান্তরালে থেকে ভাষা আন্দোলনে পালন করেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিকসহ অনেকে শাহাদাতবরণ করেন। আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৫৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান সারা জেলায় চিঠি দিয়ে নির্দেশনা প্রেরণ করেন। সেদিনের সেই সিদ্ধান্তের কারণেই দলমত নির্বিশেষে সবাই আজ আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করি।
১৯৫৪ সালে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাস্ত করে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে বাঙালি শোষণ মুক্তির আন্দোলনে নতুন পথের সন্ধান পায়। কুটিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিভেদের কারণে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার ১৯৫৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত টিকে ছিল। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়।
প্রায় দুই বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পূর্ববঙ্গে এক মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই মাতৃভাষা আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। এ সময় আওয়ামী লীগ দেশের জন্য অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। সংবিধান বাতিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বাতিল, রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। শেখ মুজিবসহ অসংখ্য রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ছাত্র সমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৪ সালে সামরিক শাসকের চক্রান্তে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়।
দীর্ঘ বঞ্চনা, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ ৬-দফা পেশ করেন। ৬-দফার পক্ষে সারাদেশে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী দমন নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা গর্জে ওঠে। ছাত্রসমাজ তাদের ১১-দফা দাবি ঘোষণা করে। আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসে আরেক মিলিটারি শাসক ইয়াহিয়া খান। নতুন সামরিক শাসক সার্বজনীন ভোটাধিকার মানতে বাধ্য হন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার মানসে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহনা শুরু করে ক্ষমতাসীনরা। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে বাঙালি জাতি অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আহ্বানে জাতি স্বাধীনতার মন্ত্রে চূড়ান্তভাবে উজ্জীবিত হয়।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চে প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন; বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করেন এবং তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেন। একই সঙ্গে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে গঠন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। দীর্ঘ ৯ মাস বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রামের পর ৩০ লাখ শহীদ ও ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বন্দিদশা থেকে স্বপ্নের স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় নতুন পথচলা।
৯ মাসের যুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা বাংলাদেশকে ধ্বংস স্তূপে পরিণত করেছিল। শূন্য হাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ যখন নতুনভাবে গড়ে উঠেছে, দেশ যখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তখন ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মুনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে। জাতির বুকে আবার চেপে বসে সামরিক শাসন। হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির নিগড়ে নিপতিত হয় দেশ। জেনারেল জিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় এক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে।
ইতোমধ্যে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার অবর্তমানে নেতৃত্বের শূন্যতা ও জাতির পিতার আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করার মানসে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে বরণ করে নেওয়া হয়।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা শাসরিক শাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তীব্র দমন-পীড়ন, অগণিত শহীদের আত্মদান, জেল-জুলুম উপেক্ষা করে সৃষ্টি হয় গণ-অভ্যুত্থান। ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয় জেনারেল এরশাদ। ষড়যন্ত্র ও আঁতাতের অংশ হিসেবে জামাতের সমর্থনে সরকার গঠন করে বিএনপি। সেনাশাসক জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া পুরনো স্বৈরাচারী ধারায় দেশ পরিচালনা করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয় বিএনপি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলার মানুষ গর্জে ওঠে। অপ্রতিরোধ্য গণ-অভ্যুত্থানের মুখে খালেদা সরকার ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১২ জুন অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। অবসান হয় ২১ বছরের দুঃসহ স্বৈরশাসনের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় পুনবর্তনের ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সূচিত স্বৈরশাসন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
এই সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে ১.৫৯ শতাংশে। দারিদ্র্য হ্রাস পায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া সর্বোপরি উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। এরপর ২০০১ সালের ষড়যন্ত্র ও কারচুপির নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। এ সময় দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে জোট সরকার সারাদেশে কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব।
আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এএসএম কিবরিয়াসহ হত্যা করা হয় ২১ হাজার নেতাকর্মীকে। হাওয়া ভবনের নীলনকশায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো হয় পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা। গুরুতরভাবে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তবে এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ নেতাকর্মী এবং চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান অসংখ্য নেতাকর্মী।
এ সময় বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে ধর্মীয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে পরিণত করা হয় মৃত্যু উপত্যকায়। এই অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান অকুতোভয় শেখ হাসিনা, রাজপথে নেমে আসে বাংলার আপামর মানুষ। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অবসান ঘটে।
খালেদা-তারেকের দুর্নীতি-অনিয়ম, ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা, কারচুপির নির্বাচনের নীলনকশা, বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন না করে বিএনপির রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখলসহ নানা অপতৎপরতায় গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৈরী পরিবেশে সৃষ্টি হয় মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের ওয়ান-ইলেভেন সরকার। ঘোষিত হয় জরুরি অবস্থা। তথাকথিত সংস্কারের নামে আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার চেষ্টা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে বন্দি রাখা হয়। জনমতের প্রবল চাপে একপর্যায়ে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। শুরু হয় রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের কাজ। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পাঁচ বছরে সবগুলো সূচকেই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত তিনি। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।
দেশরত্ন শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সুশাসন, স্থিতিশীল অর্থনীতি, কৃষির আধুনিকায়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ঈর্ষণীয় সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নে শীর্ষ পাঁচ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ৫ কোটি মানুষ নিম্ন আয়ের থেকে মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে। খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য রফতানিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ধারাবাহিকভাবে ৭ শতাংশের ওপর রয়েছে প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয়েছে ২৯ বিলিয়ন ডলার। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭১ বছর। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। প্রায় শতভাগ শিশু আজ স্কুলে যায়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৫০০০ মেগাওয়াট। ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে মানুষের দোরগোড়ায়। সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে সাড়ে ৪ হাজার ডিজিটাল কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সাত বছরে ১৯৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার, ঘরে ফেরা কার্যক্রম, দুস্থ ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যক্রম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে। বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলজুড়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বাংলাদেশ-ভারত সামীন্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। আজন্মের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী।
একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জননেত্রী শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বে শান্তি, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বহু পদক ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে গর্বের ধন।
৬৭ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বলতে হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বলেছিলেন ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ৪টি জিনিসের প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে নেতৃত্ব, ম্যানিফেস্টো বা আদর্শ, নিস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন। আওয়ামী লীগের ১৯৪৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নেতৃত্ব ছিল আদর্শ, নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন। এই ভিত্তির ওপরই সংগ্রামে এগিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছে।’
আজও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আদর্শিক সংগঠন আওয়ামী লীগের মূল শক্তি তার নিঃস্বার্থ নেতাকর্মী। দলের যে কোনো দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সময়োচিত সিদ্ধান্তে সমূহ বিপদ থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা তার এক লেখায় বলেছেন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্যাগী কর্মীদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে, তা কেবল সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী কর্মীদের দ্বারাই, সুসংগঠিত এই সংগঠনের মাধ্যমে।’
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ তারই যোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এক পবিত্র আমানত। শেখ হাসিনার হাতেই এই সংগঠন সবচেয়ে নিরাপদ। তার নেতৃত্বেই ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এক উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। ৬৭ বছরের বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সম্মুখপানে ধাবমান। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আত্মপ্রত্যয়ী জাতির শির উঁচু করে দাঁড়াবার এখনই সময়।
লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
জেএইচ/বিএ