হিলারি ক্লিনটনের ট্রাম্প-কার্ড
ডোনাল্ড ট্রাম্প-মুখর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের যাত্রামঞ্চ শুরুতে একটি গুজবে মুখরিত হয়েছিল, গত বছরের শুরুর দিকে। স্বয়ং ট্রাম্প বাক্যবাগীশ হিসেবে এমন ভাবে জমিয়ে দিলেন যে, যাত্রায় আর কোন ট্রাম্পেট বাজলেও সেদিকে কান পাতবার সময় খুব একটা ছিল না কারোর। কেবল মনের ভেতর পুঁটি মাছের কাঁটার মতো ছোট্ট খচ্ বিঁধিয়ে শুয়ে ছিল। ট্রাম্পফায়ারে পুড়তে পুড়তে বছর পার হ’ল, এ বছরেও হোয়াইট হাউজের দেয়ালের গায়ে সূর্যের আলো কতবার ছুঁয়ে গেল আর এই তো জানা গেল কেবল, আমেরিকার সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ডেমোক্রাটদের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এই প্রথম একজন নারীকে বেছে নেওয়া হচ্ছে।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেই নিজের যোগ্যতায় পায়ের তলায় মাটি শক্ত করে দাঁড়ানো হিলারি রডহাম ক্লিনটন নামের সেই নারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে মনোনীত করাতে পেরে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ট্রাম্প-ফায়ারে পানি ঢেলে যদি তিনি আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান, তবে ইতিহাস নতুনভাবে রচিত হবে আমেরিকার, সেই সাথে হয়তো বা গোটা বিশ্বের। ঠিক তক্ষুণি মনে পড়ে গেল গুজবটির কথা। ডালপালা মেলে দেওয়া গুজবের গাছে ইতোমধ্যে ফুল ধরেছে, ফল ধরবে কি না তা জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
গুজবটি হিলারি ক্লিনটন আর ডোনাল্ট ট্রাম্প সম্পর্কিত। ৬৯ বছর বয়সী ন্যুয়র্ক রিয়েল এস্টেট মোগল ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাণ্ডজ্ঞানহীন নানা রকমের বক্তব্য যখন বিস্ময় সৃষ্টি করছিল, তখন সত্যিই কি ট্রাম্প ভেবেচিন্তে এসব যা তা বলছেন, না হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী বৈতরণী পার করানোর জন্য ‘ফল্স ফ্লাগ ক্যাম্পেনিং’ চালাচ্ছেন, তিনি ডেমোক্রাটদের সিক্রেট ডাবল-এজেন্ট হয়ে রিপাবলিকান দলকে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন কি না, এমন সব প্রশ্ন উঠেছিল। ট্রাম্পকে ভোটারদের সস্তা আবেগের সাথে বেঁধে ফেলে জেব বুশ বা স্কট ওয়াকারের মতো রিপাবলিকান শিবিরের যোগ্য (হিলারি ক্লিনটনের চেয়েও যোগ্য) প্রার্থীকে উঠে আসার সুযোগ নষ্ট করতেই কি কাজ করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? এই ভদ্রলোকের (কেউ কেউ বলছেন ‘ক্যারিকেচার’) আসল মিশন কি নিজে প্রেসিডেন্ট হওয়া নাকি হিলারি ক্লিনটনকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেওয়া?
গত বছরের ১৩ জুলাই তারিখে, জেব বুশকে ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে দেওয়া ট্রাম্প-উত্তোরনের সামান্য কিছু দিন পরে জাস্টিন রাইমন্ডো নামের ক্লিনটন শিবিরের যুদ্ধ-বিরোধী কর্মী নিজের ব্লগে এক বিশাল স্ট্যাটাস দেন। ক্লিনটনের ‘প্যারালাল ক্যাম্পেইনিং’-কে সাহায্য করার জন্য ডেমোক্রাটদের গোপন ‘রেকিং অপারেশন’-এর অংশ হিসেবে হঠাৎ রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প, এমনি ইঙ্গিত মিলল। ব্যবসায়ী ট্রাম্প হঠাৎ রাজনীতিক বনে গেলেন, রিপাবলিকান দলের সাথে আগে সম্পৃক্ত না থাকলেও একবারেই দান মেরে দিতে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। ফলে রিপাবলিকান দলের এজেন্ডা পেছনে রেখে হিলারি ক্লিনটন এবং ক্লিনটন সমর্থক মিডিয়া ট্রাম্প যা কিছু বলছেন, কেবলি তা নিয়েই ভোটারদের মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছেন, আর তখন তাদের আনন্দ যেন আর বাঁধ মানতে চাইছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, সফল ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবার গুঁটি কেন হলেন? হিলারি ক্লিনটন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু, ডেমোক্রাট দলের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক, এই জন্য কি? আর তাই তিনি এমন সব ইস্যু নিয়েই গন্ধ ছড়াচ্ছেন, যে সব ইস্যুতে ডেমোক্রাট দলের পরিচ্ছন্ন বক্তব্য রাখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। মাস্টার অভিনেতার শেখানো সংলাপে ট্রাম্প আসলে রক্ষণশীলতার ‘ক্যারিকেচার’ প্রকাশ করে নিজেকে ব্র্যান্ডিং করছেন এভাবে, তিনিই একমাত্র রিপাবলিকান, যার সাহস আছে! সাহস আছে বৈকি! সেই সাহসেই তিনি অভিবাসীসহ নানান সফ্ট ইস্যুতে সাহসী বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন। এতে অবশ্য ভোটাররাও সাহসী হয়ে হাতাহাতি শুরু করে দিল!
যা-ই হোক, জাস্টিন রাইমন্ডো যা বললেন, তা নিয়ে খুঁতখুতি শুরু হ’ল, রিপাবলিকান দলটাও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ২৩ জুলাই তারিখে জনপ্রিয় লেখক এলেন গিনসবার্গ রাইমন্ডো’র কথাবার্তার সারাংশ নিয়ে টুইট করলেন, যা রিটুইটেড হয়েছিল ৪০০ বারেরও বেশি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কলামিস্ট জেমস টারান্টো এ নিয়ে সম্পাদকীয়ও লিখে ফেললেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবার গুঁটি হতে পারেন, এর পেছনে তিনটি মূল্যবান পয়েন্ট উঠে এল নানান আলোচনায়। এক. ট্রাম্প রিপাবলিকান কিংবা কনজারভেটিভ, পুরোপুরি কোনটাই ছিলেন না কখনো, অন্ততঃ সম্প্রতি যা বলছেন তা তিনি কখনো বলেছেন বলে কেউ বলতে পারছে না। অতীতে তিনি নাকি ডেমোক্রাট প্রার্থীকে ভোটও দিয়েছেন। গত ১৪ বছরে এই দুই দলে তিনি বারবার ঢুঁ মেরেছেন। অভিবাসী ইস্যুতে তিনি সরাসরি রিপাবলিকান মতামতকে নাকচ করে দিচ্ছেন, যা কিনা হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান মতামত বলে ভোটারদের সামনে তুলে ধরে প্রকারান্তরে রিপাবলিকান সুনামেরই বারোটা বাজাচ্ছেন।
দুই. হিলারি ক্লিনটন এবং তাঁর স্বামী বিল ক্লিনটনের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক বিরাজমান আর সেই সম্পর্কের জেরে অতীতে তিনি ব্যবসায়ের মুনাফার অংশ হিলারি ক্লিনটনকে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ব্যয় জোগাতে বা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের কাজকে এগিয়ে নিতে তো বটেই, অন্য অনেক ডেমোক্রাটদের নির্বাচনী ব্যয় জোগাতে দান করেছেন। ট্রাম্পের সর্বশেষ বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ক্লিনটন পরিবার, ক্লিনটন তনয়া চেলসি ক্লিনটন ট্রাম্প তনয়া ইভানকা ট্রাম্পের বন্ধু। ক্লিনটন পরিবারের প্রশংসা করে একাধিকবার টুইট করেছেন ট্রাম্প। আর সেই তিনি কিনা হিলারিকে আক্রমণ করে তাঁকে ‘জঘন্য মহিলা’ বলছেন! গুজব বলছে, এসব নাটক! দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা গত আগস্টে জানায় বিল ক্লিনটন নাকি ট্রাম্পকে টেলিফোন করে তার ভেতর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। উভয় পক্ষ একে স্রেফ হাই-হ্যালো মার্কা বললেও ক্লিনটন আসলেই যে ট্রাম্পকে রিপাবলিকান দলের হাল ধরতে উজ্জীবিত করেছেন, তা অস্বীকৃত হয়নি।
নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানো রিপাবলিকান জেব বুশ টুইট করেছেন এভাবে, `Maybe Donald negotiated a deal with his buddy @HillaryClinton. Continuing this path will put her in the White House.`
তিন. রিপাবলিকান টিকিট না পেলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে বুঝিয়েছেন বহু বার, যার ফলে রিপাবলিকান মনোনয়ন অন্য কেউ পেলেও ট্রাম্পফায়ারের আঁচ আমেরিকাকে পেতেই হ’ত, যার প্রভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হ’ত আসলে। এই কারণেই হয়তো বা রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প মনোনয়ন পেতে না পেতেই কট্টর ট্রাম্প-বিরোধী রিপাবলিকান হাউজ স্পিকার পল ডেভিস রায়ান পর্যন্ত ট্রাম্পের হাতকে শক্তিশালী করে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ১৯৯২ সালে বিল ক্লিনটন যখন নির্বাচনে দাঁড়ালেন, তখন রস পেরো নামক ভদ্রলোকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নামক একই আঙ্গিকের খেলা সম্ভবতঃ ডোনাল্ড ট্রাম্পও খেলতে প্রস্তুত ছিলেন। পাল্টা দানে ডেমোক্রাট দল গোটা বিশ্বকে ট্রাম্পম্যানিয়ার ভয় দেখিয়ে হিলারিতে মনোযোগ দিতে মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলছে। কেননা, ট্রাম্পের বদলে রিপাবলিকান দল আর যাকেই মনোনয়ন দিত, তার আঁচ যে ট্রাম্পের মতো ভোটারদের তাঁতাতে পারত না, এ তো বলাই বাহুল্য। বরঞ্চ পুরো ব্যাপারটাই হয়তো বা রিপাবলিকান দল ও সেই প্রার্থীর জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হ’ত।
এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্প-কার্ড খেলতেই হবে। রিপাবলিকান দলকে নিজের নীতি বদলে দিয়েও এই খেলায় অংশ নিতে হবে। হিলারি ক্লিনটন নিজেই কি খেলছেন কার্ডটি? আসলে বছরের পর বছর ধরে ঝেড়ে না কাশা রিপাবলিকানরা আমেরিকার সাদা চামড়ার আধিপত্য বিস্তারের খায়েশ দেখেছে বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর মতো কণ্ঠস্বর সোচ্চার হতে পেরেছে এই রিপাবলিকান আলোয়ান গায়ে ঝুলিয়েই। এই ধরনের কণ্ঠস্বরদের জন্য দরজা খুলতে যারা পেরেছে, তারাই এখন হাত কামড়াতে কামড়াতে হিলারি-ট্রাম্প ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে বাতাস গরম করছে। ‘ডানপন্থীরা’ তাঁর এবং তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ করছে বলে সেই ১৯৯০ সালে হিলারি ক্লিনটন আওয়াজ উঁচুতে তুলেছিলেন। এত কাল পর সেই তিনিই ‘ষড়যন্ত্র’ করলেন ‘ডানপন্থী’ কেন্দ্রের একদম মাঝখানে টান মেরে! আর এই ষড়যন্ত্র যদি তাঁকে হোয়াইট হাউজতক পৌঁছে দেয় তো সাব্বাশ!
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
এইচআর/এবিএস