জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারই পারে তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে
তথ্যই ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রধান পন্থা। যার কাছে তথ্য আছে, তিনি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তথ্য দিবেন না। আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন, তথ্য আসলে পাওয়া যাবে না। আমাদের মাঝে সেই ব্যক্তি স্মার্ট যার কাছে বেশি তথ্য এবং খবর আছে। কাজেই যার কাছে বেশি তথ্য রয়েছে তিনি ক্ষমতাবান এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যই তিনি তথ্য নিজের কাছে রাখতে চাইবেন। অন্যকে দিবেন না। এমন অবস্থার জন্য তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজন ছিল।
মানুষের শাশ্বত প্রবৃত্তি হচ্ছে তথ্য না দেওয়া। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত এবং সংরক্ষণ করার প্রধান উপায় তথ্য। ফলে গাড়িবাড়ি, টাকা, পয়সাসহ অন্যান্য বিষয় যেমন সম্পদ তেমনি তথ্যও বড় সম্পদ। ফলে তথ্য নামক এই সম্পদ মানুষ ভাগাভাগি করবে না বলেই তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজন ছিল। সাধারণত আমরা বলি আইন হাতে তুলে নিবেন না। কিন্তু তথ্য অধিকার আইনের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, দ্রুত এই আইনটি মানুষের হাতে তুলে দিতে হবে। কোথায় কোথায় মানুষের তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে, সে লক্ষ্যেই এই আইনটি বাস্তবায়ন করা দরকার। নানা দিক থেকে তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যের স্বচ্ছতা থাকলে জবাবদিহিতা, সততা, দুর্নীতিসহ অন্যান্য বিষয়গুলো সামনে আসবে না।
বর্তমান যুগে অনলাইনে কোনো বিষয় গোপন রাখা যায় না। অনলাইনে যুক্ত থাকার ফলে উইকিলিক্স, পানামা পেপাসরস কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটবেই। অর্থাৎ কম্পিউটারে কোনো কিছু কম্পোজ করলে বা অন্য কোনোভাবে সংরক্ষণ করা হলে তা অন্যজনের কাছে যাবেই। কারণ তথ্য নেওয়ার অনেক প্রযুক্তি মানুষের হাতে চলে এসেছে। বর্তমানে গোপনীয়তা রক্ষা করাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের হাতে আরো প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা চলে আসছে। ফলে তথ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। এক সময় আইন করা হলো জাতীয় নির্বাচনের সময় এমপি প্রার্থীরা তাদের সম্পদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশ করবেন না। পরে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন এমপি প্রার্থীদেরকে সব তথ্যই প্রকাশ করতে হবে। যদি এমন হয় যারা এমপি প্রার্থী হবেন, তাদেরকে কাগজে কিছুই করতে হবে না। অনলাইনে করতে হবে। আর সেই অনলাইনের সংযোগ কোনো একটি লাইনে থাকবেই এবং তা মানুষ জেনে যাবে । এটাই বাস্তবতা।
বর্তমানে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে গঠিত তথ্য কমিশনকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করার জন্য এর সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এই সক্ষমতা না থাকার কারণে ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তথ্য কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানো বলতে আমি একটি জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার গঠনের বিষয়ে জোর দিবো। ন্যাশনাল ইনফরমেটিকস সেন্টার নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই তথ্য সংরক্ষণ এবং আহরণের একটি দক্ষ ডিজিটাল ব্যবস্থা রয়েছে।
যেমন- কেরানীগঞ্জে একজন ব্যক্তি জমির দলিল করার জন্য যে পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হন, তা থেকে মুক্তি পেতে তথ্য কমিশনের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়টি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু যদি এমন ব্যবস্থা করা হয় যে, কেরানীগঞ্জের ভূমি ব্যবস্থাপনার সকল তথ্যই জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে চলে আসবে। এভাবে তথ্য কমিশনের অধীনে দেশের প্রত্যেক উপজেলা অফিস থেকে তথ্য জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে যোগ হবে। এই ভাবেই একটি শক্তিশালী তথ্য ভাণ্ডার গড়ে উঠবে। এই তথ্য ভাণ্ডার হবে আনলিমিটেড এক্সেস এবং ব্যাপক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। মানুষ সকল তথ্য এই জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার থেকেই পেতে যাবে। স্থানীয় পর্যায়ে দিনের পর দিন তথ্য পেতে অপেক্ষা করতে হবে না। এতে স্থানীয় প্রশাসন পর্যায়েও সুবিধা হবে। কেরানীগঞ্জে নয়, বরং তথ্য কমিশনের ভূমি ব্যবস্থা সংক্রান্ত একটি আলাদা সেল থাকবে। এখান থেকেই সবার তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। কাজেই তথ্য না দিলে মামলা হবে, বিচার জরিমানা ব্যবস্থা করা হবে- এই সব না করে বরং জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার গঠনের দিকে নজর দিতে হবে। বর্তমানে ভূমি ব্যবস্থা এবং হাসপাতালগুলো এখন ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে খুনের ঘটনা তদন্তে সেখানে গিয়ে হাসপাতাল থেকে তথ্য নেওয়ার দরকার নেই। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে দেশের হাসপাতালগুলোর দৈনিন্দন তথ্যাবলী ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেক্টরের সাথে সমন্বয় করে জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে যোগ হবে।
কাজেই সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে তথ্য কমিশনের পাশাপাশি একটি তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। ব্যক্তি আর কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য চাইবে না বরং তথ্য কমিশনই সমস্ত তথ্য জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে। সেখান থেকে প্রত্যেকে যার যার প্রয়োজন মতো তথ্য পাবেন। স্বচ্ছতার জন্য ডিজিটালাইজের কোনো বিকল্প নেই। কোনো তথ্যই গোপন রাখা যাবে না এবং গোপন রাখার সুযোগও নেই। অনলাইনে যা কিছুই হবে তার সবই জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে চলে আসবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তখন অনেক সহজ হবে, কারণ অনেক তথ্যই তখন হাতের কাছে পাওয়া যাবে।
যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়টি ভিন্নভাবে পড়াতে হবে না। গ্রামগঞ্জের যারা তথ্যসেবা পেতে চায়, তারা যদি শিক্ষিত না হয় তাহলে তথ্য পেতে অসুবিধা হবে। তথ্য বাংলা ভাষাতেই সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যাংকের হিসাব ও চেক ইংরেজিতে লেখার কোনো কারণই নেই। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সাথে ইংরেজির কী সম্পর্ক আছে। এখন টাকা জমা এবং উত্তোলন করার সকল কাগজ ইংরেজিতে। আর একটি বিষয় ব্যাংকসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন কেন ইংরেজিতে ছাপাতে হবে? এর মানে এই যে আমরা হয়ত তথ্য গোপন করছি না, তথ্য দিচ্ছি তবে তা না বোঝার মতো করে। সে তথ্য জনগণের কোনো কাজে আসবে না।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/এবিএস