ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কর্মেই ফল

প্রকাশিত: ০২:২৩ এএম, ১০ জুন ২০১৬

প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যসূচিতে সাধারণত অনেক নীতিবাক্য, উপদেশমূলক গল্প থাকে যা শিশু কিশোরদের মানবিক বিবেক জাগ্রত করতে সহায়তা করে। ‘মানুষ বাঁচে তার কর্মের মাধ্যমে বয়সের মাধ্যমে নয়’ স্কুলের ছেলেমেয়েরা হয়ত এই কথাটার গভীরতা ওই বয়সে অনেকেই বুঝতে পারে না। আর ছোটবেলার পাঠ্য পুস্তকের পড়া, বড় হয়ে অনেকেই মনে রাখে না। কারণ আমরা পড়ালেখা করি ভালো নম্বর পাবার জন্য, প্রকৃত মানুষ হবার জন্য নয়। প্রত্যেকেই তাদের বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত। নিজেদের ভালো থাকার বাইরে অন্য কিছু নিয়ে আমরা ভাবতে নারাজ। একটি বারও চিন্তা করি না ক্ষণিকের এই পৃথিবীতে সৃষ্টির কল্যাণের জন্য যারা নিবেদিত তারাই স্রষ্টার সন্ধান পায়।

কথিত আছে একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) হজ্জ্ব পালন করতে এসে কিছু সময়ের জন্য হরম শরীফেই শয়ন করলেন। এমন সময় তিনি স্বপ্নে দেখলেন, দু’জন ফেরেশতা একজন অন্যজনকে জিজ্ঞেস করছে, এবার হজ্জ্বে কত লোক শরীক হয়েছে বলতে পার কি? অন্যজন জবাব দিল, ছয় লক্ষ। আবার প্রথম ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, কত লোকের হজ্জ্ব কবুল হয়েছে? দ্বিতীয় ফেরেশতা বলল, কারও হজ্জ্বই কবুল হয়নি। হযরত আবদুল্লাহ (রহঃ) অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠলেন, পৃথিবীর এত দেশ থেকে এত মানুষ কষ্ট করে হজ্জ্ব করতে এসেছে কিন্তু সব বৃথা হয়ে গেল। তখন ফেরেশতাদের একজন উত্তর দিলেন, দামেশক নগরে একজন মুচি আছেন। যদিও তিনি হজ্জ্বে আসেন নি, কিন্তু তার হজ্জ্ব কবুল হয়েছে। আল্লাহর রহমতে ঐ মুচির উছিলায় হজ্জ্ব পালন করতে আসা সকলের হজ্জ্বই কবুল হয়েছে।

এই স্বপ্ন দেখার পরই আল্লাহর অলীর ইচ্ছা হল সেই মুচির সাথে দেখা করার। তিনি দামেশকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন এবং সেখানে পৌঁছে  সেই মুচির বাড়ির সন্ধান পেয়ে তার বাড়ির বাইরে থেকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। ডাক শুনে ভিতর থেকে একজন লোক বের হলে আবদুল্লাহ (রহঃ) লোকটির পরিচয় পেলেন এবং নিশ্চিত হলেন ইনিই সেই মুচি। আবদুল্লাহ (রহঃ) লোকটিকে তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন। লোকটি বললেন, প্রায় তিরিশ বছর ধরে আমার মনে হজ্জ্ব করার করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তা সফল হয়নি। এতদিন পরে বহু কষ্টে তিন হাজার মুদ্রা সংগ্রহ করে এবার হজ্জ্বের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে আমার গর্ভবতী স্ত্রী পাশের বাড়ি হতে রান্না করা গোশতের ঘ্রাণ পেয়ে তা খাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে। পাশের বাড়ি হতে গোশত নিয়ে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ জানায়।

স্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করার জন্য নিজের লজ্জা ত্যাগ করে পাশের বাড়ি গিয়ে আমার উদ্দেশ্য প্রকাশ করলাম। আমার কথা শুনে পাশের বাড়ির গৃহকর্ত্রী জানালেন,আপনার ইচ্ছা আমি সানন্দে গ্রহণ করতাম কিন্তু বিশেষ কারণে তা সম্ভব নয়। কেননা এ গোশত আপনাদের জন্য নাজায়েজ । গত সাত দিন ধরে আমি আমার সন্তানদের জন্য কোন খাবার জোগাড় করতে পারি নাই। ক্ষুধায় তারা সজ্ঞাহীন। এমন অবস্থায় একটি মৃত গাধার সন্ধান পেয়ে তা থেকে কিছু অংশ এনে সন্তানদের প্রাণ রক্ষার জন্য রান্না করেছি। এখন তাই তাদের খেতে দেব। মুচি বলে যেতে লাগলেন, এই কথা শুনে আমার অন্তরে কষ্টের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আমি আমার বাড়ি এসে হজ্জ্বের জন্য জমানো মুদ্রা ঐ মহিলার হাতে দিলাম তার এতীম সন্তানদের ভরণ পোষণের জন্য। ঘটনাটি শুনে আবদুল্লাহ (রহঃ) ফেরেশতাদের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলেন।

এ পৃথিবীতে অবিনশ্বর কোনো কিছুই নেই। প্রকৃতির এ নিয়ম থেকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষও বাদ পড়েনি। মৃত্যুর পর মানুষের এ মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যায়। তবে এ পৃথিবীতে মানুষের কর্ম কখনও বিনষ্ট হয় না। প্রতিবেশি অনাহারে থাকলে আমরা আয়েসি ভোজন বিলাস সম্পন্ন করে কোন ইবাদত করলে আল্লাহর দরবারে কখনও কবুল হবেনা। সম্পদের পাহাড় না গড়ে অন্যের মাঝে বিলিয়ে যে দিতে পারে সেই মহান হৃদয়ের মানুষ। অর্থই সকল অনর্থের মূল এত কিশোর বয়সের মৌলিক শিক্ষা। আমাদের মনে রাখা উচিত, মৃত্যুর সময় আমরা কিছুই নিয়ে যেতে পারব না। সবকিছুই রেখে যেতে হবে। শুধু আমাদের ভাল কাজই আমাদের সঙ্গী হবে।

আমাদের কর্মই আমাদের অমরত্ব দান করবে। হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) একদা তাঁর শিষ্যদের বললেন, দেখ মানুষ সুস্বাদু খাবার আহারের জন্য এত আগ্রহী, কিন্তু কোন বস্তুর স্বাদ বিস্বাদ কতক্ষণ থাকে? খাদ্যবস্তু কন্ঠনালীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই এর স্বাদ কিংবা বিস্বাদ। এর নিচে গেলে  আর কিছু থাকে না। তবে এই ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি এত মোহ রেখে কি লাভ?

বর্তমান সময়ে আরেকটি বিষয় যা মহামারী আকার ধারণ করেছে তা হল ফিৎনা ফ্যাসাদ। ফিৎনা ফ্যাসাদ ব্যক্তি থেকে সমাজ জীবন সকল স্তরে শুধু ধ্বংসই ডেকে আনে। সামান্য ধৈর্য্যটুকুও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্বরতার চরম সীমায় আমরা পৌছে গেছি। কেউ গালি দিলে তাকে যেন গালি না দিলে শোধ ওঠে না। কুকুর কামড়ালে প্রতিশোধ নেবার চিন্তা তো পাগলরাই করে। প্রতিটি দেশেই নিজস্ব আইন কানুন আছে। আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের আইনের উপর শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। যারা আইন পরিচালনা করেন, তাদেরও উচিত প্রত্যেক নাগরিকের আইনি অধিকার নিশ্চিত করা। ফিৎনা ফ্যাসাদ কখনও কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে না বরং পরিবার, সমাজ থেকে দেশের সব স্তরে সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করা সঙ্গত মনে করছি। তৎকালীন সময়ে অলী-আউলিয়াদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ)। একদা তিনি কবরস্থান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় পথে তাঁর সাথে এক যুবকের দেখা হল যে বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে আমোদ ফূর্তিতে মেতে ছিলেন এবং এলাকার অন্যরাও বিরক্ত হচ্ছিল। অন্যের সমস্যা হবার কারণে বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ) তাকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করলেন। কিন্তু যুবকটি অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ শুরু করল।

আল্লাহর অলী তখন ‘লা-হাওলা অলাকুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ পাঠ করলেন। এতে সেই যুবক আরও বিরক্ত হয়ে হাতে থাকা বাদ্যযন্ত্র দিয়ে জমানার শ্রেষ্ঠ অলীর মাথায় জোরে আঘাত করল। এতে বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ) এর মাথা ফেটে সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল এবং যুবকের বাদ্যযন্ত্রটিও ভেঙ্গে গেল। পরেরদিন সকালে আল্লাহর অলী একজন লোক মারফত যুবকটির নিকট বাদ্যযন্ত্রটির মূল্য বাবদ কিছু মুদ্রা এবং মিষ্টি হালুয়া পাঠিয়ে দিলেন। যথাসময় বাহক প্রেরিত জিনিসগুলো যুবকের কাছে পৌঁছে দিলে যুবক বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। মনে মনে খুবই লজ্জিত হল। বিলম্ব না করে সে তখনই বায়েজীদ (রহঃ) এর নিকট স্বীয় অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল। বলা বাহুল্য অলীদের সরদার তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

একটু ধৈর্য্য ধারণ করলে অনেক অনাকাংখিত সমস্যা দূর করা সম্ভব। ফিৎনা-ফ্যাসাদের কারণেই ঘটছে এত খুন, হানাহানি, সংঘর্ষ। সামান্য টাকা পয়সার জন্য একজন অন্য জনের বুকের উপর ছুরি চালাতে কুন্ঠাবোধ করে না। সব সম্পর্ক এখন টাকা পয়সা দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। মানবিক বিচার বিবেচনা সবই আমাদের লোপ পেয়েছে। এই যে সামান্য পার্থিব লাভের আশায় আমরা অন্যের ক্ষতি করি, মৃত্যুকালে কিছুই কি আমরা সাথে নিয়ে যেতে পারব? অন্যের হক নষ্ট করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে কোন লাভ নাই বরং আমাদের পাপের পাল্লাই ভারী হচ্ছে।  সম্পদ কখনও চিরস্থায়ী হয়না। এসব নিয়ে গর্ব করার কিছুই নেই। সবকিছুর মালিক তো এক আল্লাহ।

আমরা তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। এর বেশি কিছু নই। আমরা মানুষের কষ্ট লাঘব করলে দয়াময় আল্লাহ আমাদের কষ্ট লাঘব করবে। আমরা মানুষের কল্যাণের জন্য অর্থ ব্যয় করলে, আল্লাহ আমাদের সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবেন। ক্ষণিকের পৃথিবীতে ফিৎনা-ফ্যাসাদ শুধু অশান্তিই বাড়াবে না, জীবনকে করবে অর্থহীন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) মসজিদে নববীতে একবার বলছিলেন, যদি কোন ঈমানদার মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পর ৪ জন লোক ঐ ব্যক্তিতে ভালো বলে সুপারিশ করে তবে মৃত ব্যক্তি জান্নাতী হবে। ওমর ফারুক (রাঃ) প্রশ্ন করলেন, যদি ৩ জন ভালো বলে সুপারিশ করে? নবীজি বললেন, হ্যাঁ জান্নাতী হবে। ওমর ফারুক (রাঃ) পুনরায় প্রশ্ন করলেন, যদি ২ জন ভালো বলে সুপারিশ করে? নবীজি বললেন, হ্যাঁ তবুও জান্নাতী হবে। ওমর ফারুক (রাঃ) লজ্জায় আর প্রশ্ন করতে পারেন নি। মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষের মূল্যায়ন তার কর্মের উপর ভিত্তি করে হবে। পৃথিবীর কর্মই মূল্যায়নের মাপকাঠি।  নিজেদের প্রয়োজনেই দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের ফিৎনা-ফ্যাসাদ বাদ দিয়ে মানব কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করা উচিত।

লেখকঃ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন