ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মিতু হত্যা রহস্যের উদঘাটন!

প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ০৯ জুন ২০১৬

বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে বিদেশে বসেও মুহূর্তের মধ্যে আমরা দেশের খবর জানতে পারি। সেই খবর কখনও আনন্দের, কখনও বিষাদের আবার কখনও শিহরণ জাগানিয়া। সম্প্রতি চট্টগ্রামে মিতু নামে পুলিশের এক কর্মকর্তার স্ত্রীকে যেভাবে নিজ সন্তানের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা সকল হত্যাকাণ্ডকে হার মানিয়েছে। কাপুরুষিত এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই, তাছাড়া নিন্দা জানাতে আজ আমি কলম ধরিনি। আমি ভীত, সন্ত্রস্ত অবস্থায় নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইতে এই কলম ধরেছি।

মিতু হত্যা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একাধিক সংবাদ এবং প্রকাশিত সংবাদের সমালোচনামূলক সংবাদ আমি পড়েছি। প্রতিটি লেখায় লেখকরা সরকারের কাছে হত্যাকারীকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের চাক্ষুস সাত খুন প্রমাণ করতে যেখানে প্রসিকিউশন হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অনুমাননির্ভর করে পলাতক আসামি শনাক্ত আর আইনের আওতায় নিয়ে আসা কতটা সম্ভব তা এ পেশায় জড়িতরা ভালো করেই জানেন।

ইতোমধ্যেই খবর বেড়িয়েছে, ঘটনার কূলকিনারা করতে পারছে না পুলিশ। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কীভাবে বাঁধা হবে জরুরি হলেও সে ব্যাপারে কোন লেখাতেই কেউ কোন আলোকপাত করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই মিতু খুনে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেছেন। অতীতে তিনি সাগর রুনী এবং ইলিয়াস আলীর পরিবারকেও এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু আজ অবধি তার সেই আশ্বাসকে বাস্তবতায় রূপ দেয়া যায়নি। অনেকেই এর মাঝে সদিচ্ছার অভাব খুঁজে পান। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশ্বাসের পরও কেন তা আলোর মুখ দেখল না সেটি জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ফরেনসিক সাইন্স কি এবং দেশের ফরেনসিক সাইন্সের বর্তমান দুরাবস্থার চিত্র।

ফরেনসিক বলতে মোদ্দা কথায় যা বোঝায় তা হলো, এplication of scientific principles and practices to the adversary process where specially knowledgeable scientists play a role" যা চারটি শক্ত পিলারের উপর দাঁড়িয়ে একে অন্যের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। ফরেনসিক বিষয়ের প্রধান এই চারটি পিলার যথাক্রেমে ১. ফরেনসিক সাইন্স, ২. ফরেনসিক মেডিসিন, ৩. ফরেনসিক সাইকোলজি এবং ৪. ফরেনসিক কেমিস্ট্রি যা আবার অনেকগুলো শাখা উপশাখায় বিভক্তে হয়ে কাজ করছে। যেমন :
১. ফরেনসিক সাইন্স:
ফরেনসিক টক্সিকোলজি : যা বিষ বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে
ফরেনসিক ওডন্টোলজী : যা দাঁতের মাধ্যমে শনাক্তকরণ বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে
ফরেনসিক ইঞ্জিনিয়ারিং : যা কোন সরঞ্জামাদি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে
ফরেনসিক সাইকোলজি : যা মানুষের ক্রাইমে দায়িত্ব বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে
ফরেনসিক এন্থ্রোপলজি : অস্থি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে

২. ফরেনসিক মেডিসিন :
1. Forensic Ballistics : আগ্নেয়াস্ত্র আর বোমা সংক্রান্ত
2. Forensic Criminology : অপরাধ আর অপরাধী সংক্রান্ত
3. Forensic Dactylography : হাতের ছাপের ব্যাবহারে শনাক্তকরণ সংক্রান্ত
4. Forensic Osteology : অস্থি বিষয়ক জটিলতার সংক্রান্ত
5. Forensic Pathology : মৃত্যুর কারণ ও ধরণ বিষয়ক জটিলতার সংক্রান্ত
6. Forensic Toxicology : বিষ সংক্রান্ত
7. Forensic Thanatology : মৃত্যুর চিকিৎসা ও আইনগত সমস্যার সমাধান
8. Forensic radiology : রঞ্জন রশ্মির মাধ্যমে জটিলতা নিরসন সংক্রান্ত
9. Forensic Odontology : দন্ত বিষয়ক জটিলতা সংক্রান্ত
10. Forensic Serology : রক্ত ও বীর্য নির্ণয়ের মাধ্যমে জটিলতা সংক্রান্ত
11. Forensic Psychiatry : মানসিক সুস্থতা ও আইনের প্রয়োগ সংক্রান্ত
12. Forensic Obstetrics : প্রসবজণিত আইনি জটিলতা সংক্রান্ত

৩. ফরেনসিক সাইকোলজি :
ফরেনসিক বিজ্ঞানের এই শাখাটি অপরাধীর বর্তমান আর অপরাধ ঘটনকালীন মানসিক অবস্থা নির্ণয়ের পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মানসিকতাকে চাঙ্গা করে কোর্টে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত করে থাকে। অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে আছে :

• অপরাধীর উপযুক্ততা নির্ণয়
• শাস্তির সুপারিশ করা
• পুন:অপরাধ সংঘটনের সম্ভাব্যতা যাচাই
• আদালতে বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান
• শিশু জিম্মার উপযুক্ততা নির্ণয়

৪. ফরেনসিক কেমিস্ট্রি
ক্যামিস্ট্রির পাঁচটি মুল শাখা হলো ১. ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ২. এনালাইটিকাল কেমিস্ট্রি ৩. বাইয়ো কেমিস্ট্রি ৪. অরগানিক কেমিস্ট্রি এবং ৫. ইনরগানিক কেমিস্ট্রি। এই শাখাগুলোকে ঘিরে আছে বিভিন্ন উপশাখা যেমন Materials Chemistry, Theoretical Chemistry, Macromolecular (Polymer) Chemistry, Nuclear Chemistry, Metallurgy, Forensic Chemistry, Medicinal Chemistry and more. এই পিলার এবং তার শাখা উপশাখাগুলি বিভিন্ন অবস্থায় একাকী কাজ করলেও যে কোন প্রতিবেদনের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। এরা একে অন্যের পরিপূরকও বটে। এগুলোর কোন স্থানে ঘাটতি থাকলে সেই ফাঁক দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে আসে। যেমনটি আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই হচ্ছে। আইনেই তো বলা আছে, দশজন অপরাধী মুক্ত হয়ে গেলেও একজন নিরপরাধী যেন সাজা না পায়।

অনেকেই হয়ত তর্কের স্বরে বলবেন, বাংলাদেশে কি পলাতক অপরাধী ধরা পরেনি? অথবা ঘটে যাওয়া ঘটনার সফলভাবে পুনর্গঠন হয়নি ? হ্যাঁ , পুরনো পুলিশ সোর্স আর পুলিশের লাঠির বারিতে কিছু ঘটনার সুরাহা হয় বৈ কি তবে তার সংখ্যা খুবই সীমিত। এই সংখ্যা আধুনিক যুগে বড়ই বেমানান। আপনার গায়ে কেউ বোমা মারলো আর আপনাকেই যদি সন্দেহ করে চালান দেওয়া হয় সেটি কত অবমাননাকর ভাবতে পারেন?

ফরেনসিক বিজ্ঞানে লোকার্ডস সূত্রে বলা আছে, অপরাধী ঘটনাস্থলে তার কৃতকর্মের কিছু আলামত রেখে যাবেই। এজন্যই কোন ঘটনা ঘটে গেলে পুলিশ সেই ঘটনাস্থলকে অবিকল রেখে দেয় যেন ফরেনসিক এক্সপার্ট সেই কর্মস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করতে পারে। ইরাক যুদ্ধের বদৌলতে আমরা সবাই আমেরিকানদের চোখে রাতের চশমা দেখেছি। সেই চশমা যারা পড়েন তারা অন্ধকারেও দেখতে পান। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের বিশেষজ্ঞতাই এমন যেখানে সাধারণ মানুষের চোখে কিছু দৃশ্যমান না হলেও তারা ঠিকই ঘটনাস্থল থেকে আলামত/ অপরাধের সূত্র খুঁজে পান যার মাধ্যমে পরবর্তীতে মূল ঘটনা বেরিয়ে আসে। এখন প্রশ্ন হল আমাদের দেশের ফরেনসিক বিদ্যা আর বিজ্ঞান কতটুকু উন্নত?

প্রিয় পাঠক, আপনি কি বলতে পারেন উপরে বর্ণিত ফরেনসিক পিলারের সকল শাখা প্রশাখা কি বাংলাদেশে বিদ্যমান? ফরেনসিক মিডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি নিশ্চয়তার সাথে বলেতে পারি স্বয়ং ফরেনসিক মেডিসিন পিলারটি বড্ড নড়বড়ে। শাখা প্রশাখাগুলো বিশেষজ্ঞের অভাবে নাম কাওয়াস্তে বেঁচে আছে। অনেক শাখা প্রশাখায় কোন বিশেষজ্ঞ পদ অদ্যাবধিও সৃষ্টি হয়নি।

সুতরাং পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা কাকে ধরবে? কিভাবে ধরবে? অপরাধীরা তো শনাক্তের অভাবে ধরাছোঁয়ার বাহিরেই থেকে যাচ্ছে। ব্যবহারিক ফরেনসিকের প্রকট অভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। শিশু জেহাদ যেদিন পাইপের ভেতর পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর তখন শুনলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা দিলেন জেহাদ পাইপে নেই! মিতু হত্যাকাণ্ডের পর ঘোষণা দিলেন, মটরসাইকেলে তিনজন ওঠা নিষিদ্ধ হচ্ছে। চিলে কান নিয়েছে শুনেই কি চিলের পিছে ছুটতে হবে?

যদি প্রশ্ন রাখি, কবে মোটরসাইকেলে তিনজন বৈধ ছিল? সম্ভবত তার বরাতেই সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে ইসরাইল আর আইএসএস এতে জড়িত। তাই যদি হবে তাহলে তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? সন্দেহের তালিকায় চোরাকারবারি, জামায়াত শিবির ও ইসলামী জঙ্গি দলগুলোর কোনটিই তো আর অবশিষ্ট নেই। স্বয়ংসম্পূর্ণ ফরেনসিক সাইন্স যদি না থাকে তাহলে কোন চালনীতে চেলে এদের দায়মুক্তি দেওয়া হবে? ইতোমধ্যেই চার হেফাজত কর্মীকে ধরে, শুধু কথা বলে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল যুগে এনালগ দায়মুক্তি কি ধোপে টেকে? তারা সন্দেহভাজনই বা হলো কিভাবে? এসব অসংলগ্নই কথাবার্তা বা কর্মকাণ্ড বিজ্ঞানের যুগে অচল এবং তা অচলই থেকে যাবে যদি না দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়া না হয়। আর ব্যবস্থা নিতে হলে তা হতে হবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফরেনসিক জ্ঞানের ব্যবহারে অপরাধী শনাক্ত করা। এ ছাড়া সরকারের সামনে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা কাছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। সরকার যদি সত্যিই অপরাধীদের শনাক্ত করতে চায় তাহলে উপরে বর্ণিত ফরেনসিক বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাকে সুসংগঠিত করতে হবে। আর এটি করতে হলে স্থাপন করতে হবে স্বায়ত্বশাসিত ফরেনসিক সাইন্স ইন্সটিটিউট, যা আগে বহু লেখায় আমি প্রকাশ করেছি।

পরিশেষে জানাতে চাই, বিরোধীদলের আগুনপ্রীতিতে সম্প্রতি সরকার বার্ন ইউনিটকে বার্ন ইন্সটিটিউটে রূপান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। সেইদিন বেশী দূরে নয় যেদিন ইসরাইল আর আইএসএস এর হত্যাপ্রীতিতে সরকার দেশে ফরেনসিক সাইন্স ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায়ও সম্মতি দিবে। দেরি হলে, ততদিনে হয়ত আমাদের আরও কিছু অকাল প্রয়াণের বোঝা বহন করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম, বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া। ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ।

এআরএস/এবিএস

আরও পড়ুন