কী দরকার জঙ্গি নিয়ে কথা বলার?
চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা নতুন বার্তা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব সারাদেশেই পড়বে বলে আমার বিশ্বাস। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এ ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি যতই নির্ভয় দেন না কেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সবার পরিবাবের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াবেই। প্রত্যেক কর্মকর্তার স্ত্রীই বলবেন, কী দরকার জঙ্গি নিয়ে কাজ করার, পুলিশেরতো আরো কাজ আছে। সেগুলো করলেই পারো।
পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারে হয়তো বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে খুন করার পর এই ধরনের মনোভাব দেখা দিবে, কিন্তু যারা জঙ্গিবাদের বিস্তার ও এর দমন নিয়ে লেখালেখি করেন তারা অনেক আগে থেকেই পরিবাবের সদস্যদের কাছ থেকে অমন সতর্কবাণী শুনে আসছেন। যারা ধর্ম নিয়ে লেখেন, যারা সৃষ্টির রহস্য নিয়ে লেখেন তাদের পরিবাবের সদস্যরাও অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন কী দরকার এসব নিয়ে লেখালেখি করার। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো পুলিশ সদস্যদের পরিবার। এরপর আমরা ধরে নিতে পারি একটা সময় পর্যন্ত এমন পরিবারের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়তেই থাকবে। হয়তো এরপর বিচারকদের বেছে নেওয়া হবে। এরপর সাংবাদিক, এরপর……এমন আরো অনেকে….। জঙ্গিদের আপাতত সাফল্য সেখানেই।
পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে খুনের পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থেকে শুরু করে পুলিশ সুপারদের কাছে সতর্কবার্তা এরইমধ্যে পাঠানো হয়েছে। রোববার সকালে মোবাইল ফোনে এসএমএস করে বলা হয়েছে তারা যেন আরও সতর্ক হোন। পুলিশ কর্মকর্তারা হামলার শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কা মাথায় নিয়েই তারা দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু তারা কখনো চিন্তা করেননি তাদের স্ত্রীদের উপর আঘাত আসতে পারে। এরপর হয়তো তাদের সন্তানদের উপর আঘাত আসবে। জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধে সরকার যত না উদ্যোগী তারচেয়ে বেশি উদ্যোগী হয়ে পড়েছে দেশে আইএস (ইসলামিক স্টেট) এর উপস্থিতি নেই প্রমাণে। জঙ্গি হামলায় কাউকে হত্যার পরপরই তার দায় স্বীকার বার্তার সাথে সাথেই সরকারও তা খারিজ করে দিচ্ছে।
দেশে আইএস আছে কী নেই সেই বিতর্ক না করে সমস্যা সমাধানে সমন্বিত উপায়ে কর্মকৌশল বের করাই জরুরি। কারণ আইএস থাকলে যে ঘটনা ঘটতো আইএস না থাকলেও সেই ঘটনাই ঘটছে। আর এর প্রভাবও পড়ছে মানুষের জীবনযাত্রায়, সমাজ সংস্কৃতিতে। এরইমধ্যে বেশ কজন দেশ ছেড়েছেন, অনেকে জীবনযাত্রা পাল্টে ফেলেছেন, আরো কয়েকজন চাকরিও পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ হিসাব করে লিখছেন- জঙ্গিরা যা চেয়েছিল।
সরকার বিদেশি জঙ্গি নেই বলে দাবি করলেও এটা স্পষ্ট দেশিয় জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের যতোদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যাবে ততদিনে আরো কিছু প্রাণহানি ঘটতে পারে। কোন্ ধরনের ব্যক্তির ওপর আঘাতটা আসবে সেটা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে এটা ব্যক্তির ওপর আঘাত হলেও আঘাতটা আসলে রাষ্ট্রের ওপর।
জঙ্গিদের হামলার শিকার হচ্ছেন হিন্দু পুরোহিত, সাধু, খ্রিস্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা, পীরের অনুসারী, মাজারের খাদেম, শিয়া অনুসারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি, ব্লগার এবং সমকামীদের অধিকারকর্মী। ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক মানুষকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই নব্য জঙ্গিদের কূল কিনারাই করতে পারছে না। এটাও ধরে নেয়া যায় জঙ্গিদের এই তালিকা ক্রমশই দীর্ঘ হবে।
তাহলে কী এই রাষ্ট্র জঙ্গিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে? হয়তো না। কখনো না কখনো জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন হবেই, যেমনটি ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ফাঁসিতে ঝুলছে রাজাকার আল বদররা। কিন্তু ততদিনে মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে ঠেকে কে জানে?
লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ
এইচআর/পিআর