মফস্বল সাংবাদিকরা এখন স্মার্ট জার্নালিস্ট
২০০৫ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে হাতের মুঠোয় চলে আসে ইন্টারনেট। ফ্যাক্সের আধিপত্য কমলেও সিনিয়র সাংবাদিকরা তাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তবে টিঅ্যান্ডটির জরাজীর্ণ ইন্টারনেটের চেয়ে দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট দিয়ে ঢাকায় সংবাদ পাঠানো শুরু করেন তরুণ মফস্বল সাংবাদিকরা। সময় বাড়তে থাকে, প্রযুক্তিও এগিয়ে যেতে থাকে। এক ই-মেইলে ৫-৬টি ছবিসহ সংবাদ এক মিনিটেই চলে যেত বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। লন্ডনভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ই-বাংলাদেশে ই-মেইলে নিয়মিত ছবি ও সংবাদ পাঠাতাম। পাঠানোর কয়েক ঘণ্টা পরেই ভার্চুয়াল পাতায় ছবিসহ দেখা যেত নিজের লেখা সংবাদ। সে সময় বিডিনিউজে কাজ করলেও নিজের লেখাগুলো দেখতে পারতাম না। কারণ বিডিনিউজ তখন পাঠকদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত ছিল না। নির্দিষ্ট ইউজার ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সাইটে প্রবেশ করতে হতো।
দুই.
বাড়তে থাকে ইন্টারনেটের গতি। সঙ্গে মফস্বলের সাংবাদিকদের গতিও বাড়তে থাকে। ঘটনার সাথে সাথেই সংবাদ। টেলিভিশনের পর্দায় ভিডিও`র পরিবর্তে প্রচার হতে শুরু করে আলোকচিত্র। ৪-৫টি ছবি দিয়েই মফস্বলের যে কোনো সংবাদ খুব ভালোভাবেই প্রচার করা হতো। জনপ্রিয় হতে শুরু করে মোবাইল নির্ভর ‘লাইভ’। বার্তাকক্ষ থেকে মফস্বল সাংবাদিকদের মোবাইলে সংযোগ স্থাপন করে সরাসরি অডিও প্রচার হতো টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। এখন এই পদ্ধতির ব্যবহার আরো বেড়েছে। সম্প্রতি অনেক টেলিভিশন চ্যানেল স্কাইপের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে।
তিন.
২০০৪-০৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের মফস্বল সাংবাদিকরা ছোট্ট ডিভি ক্যাসেটে ভিডিও ধারণ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠাতেন। শনিবারের খবর প্রচার হতো সোমবার বা মঙ্গলবার। মাস শেষে ঢাকায় এসে সেই পুরনো ক্যাসেটগুলো নিয়ে যেতে হতো। সময় বদলে গেছে। মফস্বলের সাংবাদিকরা এখন এফটিপি (ফাইল ট্রান্সফার প্রটোকল) ব্যবহার করেন। নিজেরাই ভিডিও সংগ্রহ করে সম্পাদনা করে এফটিপিতে আপলোড করেন। আর এই এফটিপি থেকেই ভিডিও ডাউনলোড করে চূড়ান্ত সম্পাদনা করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচার করা হয়। অনেকে আবার ভিডিওর সঙ্গে ভয়েসও যুক্ত করে পাঠান। ঢাকার সাংবাদিকদের মত তাদের সংবাদও এখন ‘স্টোরি’ আকারে প্রচার হয় রঙিন পর্দায়।
চার.
কয়েকদিন আগে একটি লেখা লিখেছিলাম - মফস্বল সাংবাদিকতায় দিন বদলেছে। বলেছিলাম, মফস্বল সাংবাদিকরা এখন ‘স্মার্ট জার্নালিস্ট’। জেলার যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো সময়ে কোনো তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছেন ন্যাশনাল ডেস্কে। টেলিভিশনে চলছে স্ক্রল, অনলাইনে ‘বিস্তারিত আসছে...’। বিস্তারিত জেনে ক্রসচেক করে পুরো সংবাদ পাঠিয়ে দিচ্ছেন এক ঘণ্টার মধ্যেই। পরের দিনের পত্রিকার জন্য অপেক্ষা নয়। এক মুহূর্তেই নিজের লেখা সংবাদ ছবিসহ প্রকাশ হচ্ছে অনলাইনের পৃষ্ঠায়। ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ফেসবুক, টুইটারে।
অনেক ক্ষেত্রে এই স্যোশাল মিডিয়াও এখন সংবাদ উৎস হিসেবে কাজ করছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা হয়ে উঠছেন নাগরিক সাংবাদিক। এসব নাগরিক সাংবাদিকদের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও এখন বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতেও স্থান পাচ্ছে।
পাঁচ.
টেলিফোন, ফ্যাক্স, কুরিয়ার সার্ভিসের দিন শেষ। মফস্বলের সাংবাদিকরা সবশেষ কবে ফ্যাক্স করেছিলেন হয়তো বলতে পারবেন না। চলছে ইন্টারনেট নির্ভর সাংবাদিকতা। যখনই ঘটনা, তখনই সংবাদ। সঙ্গে ছবি, ভিডিও, অডিও। ঢাকার অনেক গণমাধ্যমের সাংবাদিক ঠিকমত ছবি তুলেতে বা ভিডিও করতে না পারেলেও মফস্বলের সাংবাদিকদের সংবাদ লেখা থেকে শুরু করে ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা থেকে শুরু করে ঢাকায় পাঠাতে হয় নিজেকেই। এতো কিছুর পর দেশের হাতে গোনা মাত্র ৪-৫টি টেলিভিশন চ্যানেল মফস্বলের প্রতিনিধিদের নিয়মিত সম্মানী দিচ্ছে। আর অসুস্থ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাছে হার মানছে অনেক যোগ্য সাংবাদিক। এই অশুভ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে অনেক ‘স্টুডিও ক্যামেরাম্যান’ এখন টেলিভিশন সাংবাদিক হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ‘ডান্ডা’র প্রভাব দেখিয়ে যাচ্ছে।
ছয়.
যে সহে, সে রহে। শেষ পর্যন্ত ভালোদেরই জয় হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার জানতেও অনেক পড়াশোনার প্রয়োজন হয়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেভাবে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে শিক্ষিত, তরুণ ও মেধাবীরাই ঠিকে থাকবেন এই পেশায়। জয় হবে স্মার্ট সাংবাদিকতার।
লেখক : সহকারী বার্তা সম্পাদক, জাগোনিউজ২৪.কম
এইচআর/এমএস