শান্তিরক্ষা মিশনে উজ্জ্বল নাম বাংলাদেশ
২৯ মে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা দিবস।’ দিবসটি আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যবহ একটি দিন। এদেশের সশস্ত্রবাহিনীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শান্তিরক্ষা সর্বত্রই তাদের বিচরণ সমুন্নত রয়েছে এখনও। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে তাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেম। অনুরূপভাবে বর্তমান বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী একটি পরিচিত ও আস্থার প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্যোগময় পরিবেশে শান্তি স্থাপন করে অপরিচিত দেশের অচেনা মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ শান্তিরক্ষী সততা, শৃঙ্খলা ও সাহস নিয়ে প্রশংশনীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়া সৈন্যদের প্রশিক্ষণে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস সাপোর্ট ট্রেইনিং’ (বিপসট) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গোত্রে গোত্রে সংঘাত নিরসন, যুদ্ধাঞ্চলে মানবিক সাহায্য সামগ্রীর কনভয় এবং জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরে আক্রান্তদের উদ্ধারে শান্তিরক্ষা বাহিনী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এসব কর্মযজ্ঞে নিবেদিত প্রাণ কর্মী। ‘শান্তিরক্ষা মিশনের সদস্য নির্বাচনের আগে সম্ভাব্যদের বিষয়ে স্বাগতিক দেশ ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বিভাগ পর্যালোচনা করে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’ অর্থাৎ যাচাই-বাছাই করেই বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের শান্তিরক্ষা কাজে পাঠান হয়। প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং মীমাংসিত; অনেকদিন থেকেই তা অনুসৃত হয়ে আসছে।
দুই.
জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দুপক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের উপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তি চুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে ১,১৮,৯৮৫ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছে। শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সদস্যসংখ্যা ৮,৯৩৬ জন যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এদেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্রিত হয়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবাদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা/রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর মোট ৯৬ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন; পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন ১৪জন। অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আয় হয়েছে ২০ হাজার ৪৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। স্মরণীয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৩ সালে ছিল ১৬.৩ বিলিয়ন ডলার। শান্তি মিশন থেকে আয় এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কারণ বিশ্বে সকল প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এ শান্তিরক্ষীদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে।
শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে-‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কার সাথে বৈরিতা নয়।’ বিশ্বের বিরোধপূর্ণ স্থানে জাতিসংঘের ডাকে শান্তি স্থাপন করা এজন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জরুরি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। জাতিসংঘকে শান্তি স্থাপনে সহায়তা দেয়া এবং পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্ররকম আবহাওয়ায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় তাদের পদচারণা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহনীয় গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সাথে মানিয়ে নিয়ে রাত-দিনের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে চলেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী।
বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর রয়েছে অসামান্য অবদান। কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী রয়েছে; রয়েছে বিচিত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ। এসব সামাজিক ভেদাভেদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে সকলকে নিয়ে সহাবস্থান নিশ্চিত করছে শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় দুশত আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী দুটি যুদ্ধজাহাজ ওসমান ও মধুমতি লেবানন এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সর্বদা টহলের কাজে মোতায়েন রয়েছে। মিশন এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোতেও তাদের সতর্ক প্রহরা দেখা যায়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বিআর-১৩০ এয়ারক্রাফট, এমআই-১৭ ও বেল হেলিকপ্টারের মাধ্যমে কঙ্গো ও আইভরিকোস্টে জরুরি সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন, উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তৎপরতায় দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্য মিশন এলাকার স্থানীয় প্রশাসনকে দাঙ্গা দমনে সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বের বিশৃঙ্খল এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে শান্তি স্থাপনে সাফল্য অর্জন করাও বাংলাদেশ মিশনের শান্তি প্রকল্পের অন্যতম কাজ। শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশী নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে একটি মাইলফলক। শান্তি রক্ষা মিশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের অবদানের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ উৎসাহব্যঞ্জক। শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা মোতায়েনের সংখ্যার বিচারেও অনেক দিন ধরে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে আমাদের দেশ। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমুন্নতি বিধানের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর বিশ্বশান্তি স্থাপনের ভূমিকাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা দরকার। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ও শান্তি রক্ষা মিশনের দায়িত্বে থাকা হার্ভে ল্যাডসাউ-এর ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সফর সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আরো একবার। অন্যদিকে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন শান্তিরক্ষার কাজে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এ দেশের অংশগ্রহণের ওপর প্রভাব সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও শান্তিরক্ষা কার্যক্রম- দুটি ভিন্ন বিষয়।’ অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ- দুটি আলাদা বিষয়।
দেশপ্রেমিক বিশিষ্টজনরা বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম আছে। যারা ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করছেন তাঁদের প্রশ্নের ভিত্তিতে জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয় না। জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয় গভীর বিশ্লেষণ, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক ২৩ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ ক্ষেত্রে একটি রিভিউ প্রক্রিয়া রয়েছে যার মধ্য দিয়ে এসব ইউনিটকে যেতে হয়। আর সেই প্রক্রিয়ায় ডিপিকেও (ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশনস) এবং স্বাগতিক দেশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং এটাই হলো প্রক্রিয়া। রিভিউ করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। অন্যদিকে পোশাকশিল্পে ব্র্যান্ড হওয়ার আগেই শান্তিরক্ষায় ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। যে দেশের শান্তিরক্ষীরা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোয় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, প্রাণ দেয়, এখন সেই দেশে রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে সংঘাত-সহিংসতা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মোটেও কাঙ্খিত নয়।
তিন.
মূলত শান্তি মিশনে সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যে কোনো সংস্থার সদস্যদের সম্পৃক্ততা কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে নয় বরং তার সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত। শান্তি রক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যে অর্থ উপার্জন হয় তা রেমিটেন্স হিসেবে গণ্য হয়। আর রাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীর সরঞ্জাম অন্য দেশে নিয়ে ব্যবহারের ভাড়া বাবদ বিপুল অর্থ প্রাপ্তি ঘটে। রাষ্ট্রের এই উপার্জন ছাড়াও বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির জন্য শান্তিরক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দরকার।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
এইচআর/এমএস