শরীর ও মনে আমরাও কি মরছি না?
কি ঘটতে যাচ্ছে তা যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। আচ্ছা একাউন্ট ডিআ্যাক্টিভ করে দেবো? কখন কিভাবে কার অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেলি! আঁখি বললো, সাবিরাকে নিয়ে আমাদের আরেক বন্ধুর একটা লেখা শেয়ার দিয়েছিল। যা-তা গালাগালি করছে লোকজন ফেসবুকে, আর লেখকের গুষ্ঠি উদ্ধার তো আছেই। আমি লেখাটা পড়েছি। খুবই অসাধারণ লেখা। আঁখি বলল, মন্তব্যকারীকে ব্লক করেছে ও। আমি ভাবি, কি হবে! ব্লক করলেই ওই লোক শুধরাবে?
একাউন্ট ডিআ্যক্টিভ করলে, আমি হয়তো মাফ পেতে পারি, আমার মতো আরও আরও ঢোঁড়াসাপেরাও। কিন্তু ঐ প্রান্তিক মানুষগুলো? কুষ্টিয়ার বাউলেরা? নড়াইলে সুলতানের বাড়ি? শিলাইদহের কুঠিবাড়ি? রঞ্জন, বগুড়ার শিবগঞ্জে "স্বপ্ন" নামে একটা স্কুল চালায়। ও? নেত্রকোণায় প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের আগে ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করিয়ে ওদেরই শিল্পকর্ম দিয়ে পহেলা বৈশাখে মঙ্গলশোভাযাত্রা বের করে বিপুল শাহ, তিনি? বরিশালের দুলাল ভাই? নাট্যঅন্তপ্রাণ। সেদিন দেখলাম কয়েক কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখাতে নিয়ে এসেছেন। তিনি?
বাংলার আনাচে-কানাচে এরকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজারও মুখ। যাদের টেলিভিশনে দেখা যায় না, পত্রিকায় যাদের ইন্টারভিউ ছাপা হয় না। যারা পার্টিতে গিয়ে সেলফি তোলে না, যাদের গায়ে বনজ জলজ গন্ধ। যারা এই ভীষণ বিভ্রান্তির "লাল লাল নীল নীল বাতি"র ঢাকা শহরে আসেনি। নিজ নিজ জায়গায় থেকে নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে গেছে, যাচ্ছে। পাশাপাশি সাধ্যমতো অন্যদেরও অতিক্রম যে করা যায় সেই পথ দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাঁচবেন তো তারা?
আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না। কারো সাথে কথা বলে শান্তি পাইনা। কোন মানুষে-নারী বা পুরুষে একনিষ্ঠ হতে পারি না। সারাক্ষণ কি এক ভয় আর নিরাপত্তাহীনতা তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার মেয়ের বয়স যখন ছয়মাস, তখন থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, সুযোগ পেলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। গার্লস ডে আউট। আমি, আমার ছোট্ট মেয়ে আর ওকে যে মেয়েটা দেখাশোনা করে-সে-আমরা তিনজন। ঢাকাতেই, আশেপাশে, যতটা পারা যায়। জীবন থেকে যতটুকু আনন্দ ছেকে নেওয়া যায়। খুব ঘুরলাম বছরখানেক। চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, ইউনিভার্সিটি, বলধা গার্ডেন, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, চন্দ্রিমা উদ্যান, সংসদ ভবন। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। একদিন প্রথম বাধা পেলাম মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়িতে। ওখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আন্ডারে একটা মসজিদ আছে। আমরা ভাবলাম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আন্ডারে যেহেতু সেহেতু নিশ্চয় দেখতে যাওয়াই যায়। কিন্তু গিয়ে কিরকম অদ্ভুত একটা গা ছমছমে অনুভূতি হলো। দাড়িওয়ালা মানুষ কিন্তু আমাদের সবার পরিবারেই আছেন, পাঞ্জাবী পড়া পরিজনও। কিন্তু ওখানকার মানুষগুলো কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিলেন, আর অচেনা রূঢ় ভাষায় বললেন, "এইটা মসজিদ, মেয়ে-ছেলের এইখানে কি?"
মাত্র তিনবছরের মেয়ে আমার। সেও যেন চমকে গেল, ফেরার পথে সারাপথ একই প্রশ্ন, মা ঐ আংকেল এভাবে কথা বলল কেন?
আর এখন তো কেন যেন ইচ্ছাই করে না, কোথাও যেতে। কেন ভয় করে, কেন নিঃশঙ্ক নয় চিত্ত তা আমার ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছে করে না। এমনিতেই দিনে দিনে কমছে ব্রিদিং স্পেস। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ বাইরে ঘুরতে যাওয়া বলতে বুঝে, কোন ফুড কোর্ট অথবা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া অথবা শপিং করা। কি করুণ মানুষের বেঁচে থাকা। ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খাওয়া। একটু খোলা আকাশ নেই, গাছপালা নেই, নদী বা জলাধার নেই। গান-নাটক বা সাংস্কৃতিক এক্টিভিটি যা হয় শিল্পকলা বা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
মিরপুরের একটি তরুণ মেয়ে বা উত্তরার কোন তরুণকে আলী যাকেরের অভিনয় বা বন্যার গান শুনতে হলে পাড়ি দিতে হবে দুস্তর পারাবার। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে এশহরের মানুষকে বোধহীন, সংস্কৃতিহীন, অর্ধমানব বানিয়ে ফেলছে। আর আমরা চিৎকার করছি, বিচ্ছিন্নতা বিচ্ছিন্নতা বলে। অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম সমাজ গড়ে ওঠার সময়ের এই ক্রাইসিস আমরা কিভাবে সামাল দেবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। তাই রেসিং কার নিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় রেস করতে গিয়ে মেরে ফেলছি মানুষ, চড়া মেকাপ নিয়ে যাচ্ছি সেহেরী পার্টিতে, দারুণ আধুনিক পেশায় থেকেও একজন কাউকে বিয়ে করতে না পারলে মরে যাচ্ছি। আমাদের ঘরগুলোও হয়ে উঠছে জাস্ট চারটা দেয়াল। কারো কারো হচ্ছেই না ঘর।
আমরা ভয় পেয়ে কেউ কেউ ছেড়েই দিচ্ছি বাইরে যাওয়া। যারা মারছে তারা সফল হতে চলেছে সব ভাবেই। শরীরে এবং মনেও আমাদের মৃত্যু ঘটাতে পারছে তারা। আমার এখন প্রায়ই মনে হয়, ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা খেদা। উন্নয়নের দরকার নেই মা সহজ-স্বচ্ছন্দ, ভীতিহীন জীবনটা ফিরিয়ে দে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজ
এইচআর/আরআইপি