সফলদের সঙ্গ আপনাকে সফল করবে
মানুষ তার পরিবেশের তৈরি একটি প্রতিচ্ছবি। আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকে অবচেতনভাবেই প্রভাবিত হই। আপনি যদি হতাশাগ্রস্ত, ব্যর্থ বা নেতিবাচক চিন্তার মানুষদের সাথে চলেন, তবে সেই হতাশা এবং ব্যর্থতা আপনার মনোজগৎকেও গ্রাস করবে। ঠিক তেমনই, যদি আপনি সফল, ইতিবাচক ও লক্ষ্যনিষ্ঠ মানুষদের সাথে চলেন, তাদের জীবনদর্শন, পরিশ্রম এবং উদ্যম আপনাকেও বদলে দেবে। পৃথিবীর সফল মানুষেরা কখনোই একা সফল হননি। তাদের আশেপাশে ছিল এমন কিছু মানুষ, যারা তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, গাইড করেছে, এবং প্রয়োজনীয় সময়ে সহযোগিতা করেছে।
আজকের পৃথিবীতে সফল হওয়া শুধু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে না, বরং সেটি অনেকটাই নির্ভর করে আপনার সঙ্গী কারা, আপনি কার সাথে মিশছেন এবং আপনার আশেপাশের পরিবেশ আপনাকে কতটুকু অনুপ্রাণিত করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সফল মানুষদের জীবনে কমন একটি বিষয় হলো—তাদের আশেপাশে এমন মানুষ ছিল, যারা তাদের বিশ্বাস করত, উৎসাহ দিত এবং ইতিবাচক চিন্তাভাবনা প্রচার করত।
পরিবেশের প্রভাব: ব্যর্থতা বনাম সফলতা
আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোর আচরণ, চিন্তাধারা এবং সিদ্ধান্ত আমাদের উপর একটি অদৃশ্য প্রভাব তৈরি করে। এটি বিজ্ঞানের ভাষায় "Mirror Neuron Effect" নামে পরিচিত। নিউরোসায়েন্সে প্রমাণিত হয়েছে যে আমরা যাদের সাথে বেশি সময় কাটাই, তাদের আচরণ এবং চিন্তার সাথে আমরা অবচেতনভাবে মিশে যাই। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি এমন মানুষের সাথে থাকেন যারা প্রতিনিয়ত ব্যর্থতার কথা বলে, হতাশার চর্চা করে, আর কোন কাজ শুরু করার আগেই নেগেটিভ চিন্তায় ডুবে যায়, তাহলে আপনার মধ্যে তাদের মতো ভাবনাগুলোও প্রবেশ করবে।
সফলদের সঙ্গী হলে আপনি বুঝতে পারবেন, জীবনে বড় কিছু করা সম্ভব। ব্যর্থতা, হতাশা আর নেতিবাচক চিন্তার জাল থেকে বেরিয়ে এসে আপনি নতুনভাবে বাঁচতে শিখবেন। তাই আজ থেকেই আপনার আশেপাশের মানুষদের মূল্যায়ন করুন এবং সফলদের সঙ্গী হন—কারণ সফলতা আপনাকেও স্পর্শ করবে।
এর বিপরীতে, সফল মানুষদের সাথে চললে কী হয়? তাদের ইতিবাচক চিন্তাধারা, বড় স্বপ্ন দেখা এবং পরিশ্রম করার মানসিকতা আপনাকেও প্রভাবিত করবে। সফলদের সাথে সময় কাটালে আপনি বুঝতে পারবেন, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আপনি তাদের জীবনযাত্রা দেখে অনুপ্রাণিত হবেন এবং সেই অনুপ্রেরণা আপনার মধ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা সফল উদ্যোক্তা, তাদের ৮৫% মানুষের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অন্য সফল ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়েছে এবং তাদের সাথে সময় কাটিয়েছে। এটি তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলেছে।
সফলদের সঙ্গের শক্তি
সফল মানুষেরা তাদের জীবনে যে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন তা তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম করে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বখ্যাত মোটিভেশনাল স্পিকার এবং লেখক টনি রবিনস বলেছেন, “আপনি যে পাঁচজন মানুষের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটান, তাদের গড় আপনি নিজে হয়ে যান।” অর্থাৎ আপনার আশেপাশের মানুষদের মানসিকতা এবং জীবনযাত্রাই আপনাকে গড়ে তোলে। যদি আপনি এমন একটি গ্রুপে থাকেন যেখানে সবাই ইতিবাচক চিন্তা করে, বড় স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করে, তাহলে আপনার মধ্যেও একই মানসিকতা তৈরি হবে।
সফল মানুষদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা ব্যর্থতা থেকে শিখে উঠে দাঁড়ায়। তারা ব্যর্থতাকে কখনোই তাদের গন্তব্য মনে করে না। বরং সেটিকে তারা পরবর্তী সফলতার একটি ধাপ হিসেবে দেখে। আপনার যদি এমন মানুষদের সাথে চলার সুযোগ হয় যারা ব্যর্থতার মাঝেও সম্ভাবনা খুঁজে পায়, তাহলে আপনিও শিখবেন কীভাবে সংকটকে শক্তিতে রূপান্তর করতে হয়।
ব্যর্থদের সঙ্গ
অনেকেই জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে এত বড় করে দেখে যে তাদের দৃষ্টি আর সামনে এগোতে পারে না। তারা নিজেদের সমস্যার মধ্যে আটকে পড়ে, এবং তাদের এই ব্যর্থ মানসিকতা আশেপাশের মানুষদেরও সংক্রমিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি আপনি এমন একটি গ্রুপে থাকেন যেখানে সবাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত, নতুন উদ্যোগ নেওয়ার আগেই হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে তার প্রভাব আপনার মধ্যেও পড়বে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা হতাশাগ্রস্ত মানুষের সাথে সময় কাটায় তাদের মধ্যেও হতাশার মাত্রা বেড়ে যায়। এমনকি নেতিবাচক মানুষদের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা করলে এটি আপনার আত্মবিশ্বাস এবং মনোবলকে ধ্বংস করতে পারে।
সফল মানুষদের সাথে চলার কৌশল
অনেকেই বলে থাকেন, "আমি তো এমন কোনো সফল মানুষের সাথে পরিচিত নই, তাহলে কীভাবে তাদের সঙ্গী হবো?" বাস্তবিক অর্থে সফল মানুষদের সাথে চলার জন্য সরাসরি তাদের সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি নয়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে সফল মানুষদের চিন্তাভাবনা এবং জীবনদর্শন সহজেই অনুসরণ করা যায়। ইউটিউব, পডকাস্ট, বই এবং অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ অবারিত।
বিল গেটস বা স্টিভ জবসের মতো ব্যক্তিদের চিন্তাধারা এবং জীবনের গল্প পড়লে বুঝতে পারবেন কীভাবে তারা শূন্য থেকে শুরু করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছে। তাদের গল্প শুনে আপনি অনুপ্রাণিত হবেন এবং বুঝবেন যে সাফল্য কখনোই একদিনে আসে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যেখানে পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং ধৈর্যই মূল চাবিকাঠি।
নিজেকে সফল পরিবেশে রাখুন
নিজের চারপাশের মানুষ এবং পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার নিজের। আপনি যদি সফল হতে চান, তবে প্রথমেই আপনার আশেপাশের মানুষদের মূল্যায়ন করুন। যদি দেখেন আপনার বর্তমান গ্রুপে হতাশাগ্রস্ত, নেতিবাচক চিন্তার মানুষ বেশি, তাহলে ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে আসুন। সফল এবং ইতিবাচক মানুষদের খুঁজে বের করুন এবং তাদের সাথে মেলামেশা শুরু করুন।
আপনি যদি এমন একটি সার্কেলে থাকেন যেখানে মানুষ বড় স্বপ্ন দেখে, সমস্যা নয় সম্ভাবনার কথা বলে, তাহলে তার প্রভাব আপনার উপর পড়বে। আপনি নিজেও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করবেন এবং একদিন নিজেকে সফল মানুষদের সারিতে দেখতে পাবেন।
সফল মানুষদের সাথে সময় কাটানো মানে শুধু তাদের গল্প শোনা নয়, বরং তাদের জীবনদর্শন এবং মানসিকতা থেকে শেখা। তারা আপনাকে দেখাবে কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যেতে হয়, কীভাবে নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্য অর্জন করতে হয়।
সফলতা আসলে একটি অভ্যাস, এবং এই অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আপনাকে সফল মানুষদের সঙ্গী হতে হবে। তারা আপনাকে টেনে উপরে তুলবে, আপনার সম্ভাবনাকে উজ্জীবিত করবে এবং আপনাকে সফলতার পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
সফলদের সঙ্গী হলে আপনি বুঝতে পারবেন, জীবনে বড় কিছু করা সম্ভব। ব্যর্থতা, হতাশা আর নেতিবাচক চিন্তার জাল থেকে বেরিয়ে এসে আপনি নতুনভাবে বাঁচতে শিখবেন। তাই আজ থেকেই আপনার আশেপাশের মানুষদের মূল্যায়ন করুন এবং সফলদের সঙ্গী হন—কারণ সফলতা আপনাকেও স্পর্শ করবে।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/এএসএম