ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও টেকসই সংস্কারের ভবিষ্যৎ

লে. কর্নেল খন্দকার মাহমুদ হোসেন, এসপিপি, ‍পিএসসি(অব.) | প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা, বৈষম্য ও দায়মুক্তির মধ্যে আটকে আছে। যদিও ছাত্রজনগণের আন্দোলন একটা পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছে তবুও দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসনে গড়ে উঠা অজাচার শাসন ব্যবস্থা প্রায়ই হতাশার জন্ম দেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সমস্যা উত্তরণে কাজ করে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের ফলপ্রসূতা এবং টেকসই সংস্কার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, আইন এবং সুশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন ।

বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি-
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং চর্চা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত প্যাট্রিমোনিয়াল এবং ক্লায়েন্টেলিস্টিক চরিত্র ধারণ করে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি, দলীয় আনুগত্য, এবং পারিবারিক প্রভাব রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। প্যাট্রিমোনিয়াল রাজনৈতিক চরিত্রে দেশের ক্ষমতা, সম্পদ এবং সুবিধা ব্যক্তিগত বা পরিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। এর মধ্যে শাসনব্যবস্থার নেতা তার ক্ষমতা বা সম্পদ তার পরিবারের সদস্যদের বা নির্দিষ্ট গ্রুপের মধ্যে বিতরণ করেন। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকার বা প্রশাসন ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো পরিচালিত হয়। যেটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান।

ক্লায়েন্টেলিস্টিক চরিত্রে দেশের শক্তিশালী গ্রুপ বা নেতা দুর্বল গ্রুপ বা জনগণের কাছে তাদের সমর্থন অর্জন করার জন্য কিছু সুবিধা বা প্রস্তাবনা প্রদান করা সহ সাধারণ জনগণকে নিজ দলে সমর্থন দেয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা, অর্থনৈতিক সাহায্য বা রাজনৈতিক সাহায্য প্রদান করে। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল এটা করে থাকে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পরিবারতন্ত্র, এবং জবাবদিহিতার অভাব এখানে স্পষ্ট। প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বই এখানে একমাত্র উপায়। তবে ছাত্রজনতার আন্দোলনের পরে তরুণ নেতৃত্বের সম্ভাবনা বিকশিত হয়েছে দারুণ ভাবে।

গণতন্ত্র নিয়ে জনধারণাঃ বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে জনমানসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ প্রবল থাকলেও প্রায়শই এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলছে। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট দেখা দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবের কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি : বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি বেশ জটিল। দলীয় রাজনীতি, ক্ষমতার ভারসাম্য, এবং জনগণের অংশগ্রহণ এই গতি প্রকৃতির মূল উপাদান। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো বা প্রক্রিয়া বাইনারি কেন্দ্রিক যেখানে দুটি পক্ষ বা দ্বিদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে সরকারের নীতি ও প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক দলের প্রভাবে রাষ্ট্রে এক ধরনের বেসরকারিকরণ পদ্ধতি চলমান। এ ছাড়াও ব্যবসায়ী, বিভিন্ন এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা এবং মিডিয়া রাজনৈতিক গতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাইনারি বিভাজন এবং রাজনৈতিক মেরূকরণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাইনারি ব্যবস্থার একটি অর্থ আছে যেমন "আমরা বনাম তারা"। যেখানে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় এক পক্ষের বিপরীতে আরেক পক্ষের অবস্থান। আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি এমনভাবে বিভাজিত যে প্রায় সব বিষয় দুই দলের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বিচার করা হয়। এই ধরনের বিভাজন গণতান্ত্রিক আলোচনা ও সমঝোতার পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে সমাজের রাজনৈতিক মতামত, আদর্শ, এবং দলগুলো একে অপরের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায় এবং উভয়ের মধ্যে বিভাজন গভীর হয়।

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর, কারণ এটি সমঝোতা ও মধ্যপন্থা খুঁজে পাওয়ার পথ সংকীর্ণ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ দীর্ঘদিন ধরে তীব্র মেরুকরণের মধ্যে রয়েছে। ফলে দলীয় অবিশ্বাস, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ধর্মভিত্তিক দল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মতপার্থক্য, নির্বাচনে কারচুপি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে দেশ বিতর্কের মধ্যে নিমজ্জিত।

ছাত্রজনতার আন্দোলনের ফলপ্রসূতা এবং স্থায়ীত্বের মূল্যায়ন
বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই আন্দোলনের ফলপ্রসূতা এবং স্থায়িত্ব নির্ধারণে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল বৈষম্যমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়ন। এ ব্যাপারে কাজ হচ্ছে-তবে বাস্তবায়নের অগ্রগতি নির্ভর করছে সরকার ও প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর।

আন্দোলনের জনসমর্থনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক মহলে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে নীতি পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে অনুমেয়। আমরা যদি এটি একটি সুসংগঠিত এবং কাঠামোগত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারি, তাহলে এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হব। যদি প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আন্দোলন নতুন করে জেগে উঠতে পারে। যদি সাধারণ জনগণ এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ এই আন্দোলনকে পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করে যায়, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের রূপ নিতে পারে।

আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি বিভক্ত বা অগোছালো হয়, অথবা একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্য না থাকে, তবে আন্দোলনের সফলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতে হবে। একই সাথে নতুন শাসনব্যবস্থা যদি অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করতে না পারে, তবে জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। জনগণ তাদের জীবিকার সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন হারিয়ে ফেলতে পারে। যেমন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটা বিরাট সমস্যা- এর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ছাত্রজনতার আন্দোলনের পরপরই ভারত আমাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা এবং উসকানি দিয়ে যাচ্ছে । দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, হস্তক্ষেপ এবং পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ কাজ করছে। বিষয়টি নতুন সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে দেশের মিডিয়ার ভূমিকা ব্যাপক। তাই এর বিরুদ্ধে সরকারকে রাজনৈতিক এবং কৌশলগত অবস্থান তৈরি করে কার্যকর পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে জোট তৈরি করা যেতে পারে।

টেকসই সংস্কারে সম্ভাব্য সমস্যা-
আমাদের দেশের গ্রামীণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়নি। দেশের মানুষ আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় চাঁদাবাজদের টাকা দিতেন। এখন তাঁরা বিএনপিকে টাকা দিচ্ছেন। এই জন্য আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী। নির্বাচনে যে জয়লাভ করে সে–ই সব ছিনিয়ে নেয় অন্য সকলেই কেমন যেন এক ধরনের শত্রুতে পরিণত হয়।

স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনকে ক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনকে জনগণের নিকটবর্তী করতে হবে। প্রশাসনের দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতির বলয়মুক্ত করা খুবই জরুরি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং প্রশাসনিক যন্ত্রে হিসাবেও খুব দুর্বল। দেশের বিরাট একটা অংশে কার্যত রাষ্ট্রের ভূমিকা নেই। দেশের মানুষ সংস্কৃতি হল ক্ষমতাধর বা শক্তিশালী সংযোগকারী কাউকে ভোট দিবে যেন প্রয়োজনে সে ভোটারকে রক্ষা করবে এবং হস্তক্ষেপ করবে। যেমন প্রশাসন কথা না শুনলে বা ব্যক্তির স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে সে তার ক্ষমতাধর নেতার কাছে যাবে সমাধানের জন্য যেটা এক ধরনের বেসরকারীকরণ।

এই দুর্বলতা মানে নেতাই সব প্রশাসন কিছুই না। ফলে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এটা এক ধরনের নেতা কেন্দ্রিক নেটওয়ার্কিং। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই একজন সৎ এবং নৈতিকতা সম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তিকে নেতা হিসাবে বাংলাদেশের জনগণ বেছে নিতে চায় না। বাংলাদেশের মানুষ ‘ক্ষমতা’ এবং ‘নেতা’ এই দুটি শব্দকে খুবই পছন্দ করে।

বাংলাদেশে সরকারি জনবলের ঘাটতি প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রধান কারণ। প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাব থাকে, ফলে সেবাপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যা অনেক কম। এটা জনগণের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে বাধা সৃষ্টি করে। উন্নয়ন প্রকল্প বা নীতিমালা অনেক সময় দুর্বল পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের অভাবে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং ফলপ্রসূ উন্নয়নের আরেকটি অন্তরায় হলো দুর্নীতি এবং বৈষম্য। নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফলে দুর্নীতি এবং বৈষম্য আকাশছোঁয়া।

বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারি সেবার অপ্রতুলতা লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কৃষি সহায়তা, কিংবা নিরাপত্তার মতো মৌলিক সেবাগুলো পৌঁছায় না। এই ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের ৬০-৭০% জনগণকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর (NGO) ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের গ্রামীণ এবং দূরবর্তী এলাকায় রাষ্ট্রের সরাসরি উপস্থিতি খুবই কম। এর ফলে ঢাকার বাইরের মানুষ নিজেদের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে অনুভব করতে পারে না। রাষ্ট্রের দুর্বলতার কারণে জনগণের একটি বড় অংশ সরকারকে "দূরের বিষয়" মনে করে।

গত ১৬ বছরের শাসনে রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরাই ভেঙ্গে পড়েছিল। একদল অলিগার্ক, প্রশাসন এমনকি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে একত্বতা প্রকাশ করেছিল। এমনকি এদের একটা বড় অংশ এখনও চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং কাজ করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উন্নত ভবিষ্যতের মানসে দেশ গড়ার কাজ খুবই বাধাগ্রস্ত হবে। আবার হঠাৎ করে এসব সম্পূর্ণ দূর করার চেষ্টা কতটুকু সফল হবে সেটাও সন্দিহান।

টেকসই ব্যবস্থা বাস্তবায়নে করণীয়-
গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন : ছাত্রজনতার একদফা আন্দোলনের এক দফা অ্যাজেন্ডা ছিল স্বৈরশাসকের বিলুপ্তি, যা এক ধরনের জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি করেছিল। এখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টানাপোড়ন শুরু হয়েছে, যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক দাবি দাওয়ার ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে – এটাই গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণতন্ত্র হতাশাজনক, আবার কিছু ব্যাপারে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা ঈর্ষণীয়- অনেক কিছুই তাদের দ্রুত হয়; কিন্তু স্বৈরাচার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় না যেমন গত ১৬ বছরে আমরা বাংলাদেশে দেখেছি। তাই গণতন্ত্র বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গণতন্ত্রই প্রকৃতপক্ষে একমাত্র সমাধান- তবে সেটা যেন স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র না হয়।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা (Proportional Representation - PR)ঃ এই পদ্ধতিতে কোনো দলের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার অনুযায়ী সংসদে তাদের আসনের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এটি প্রথম-স্থানে-যে-গেলে-সে-জিতে (First-Past-the-Post বা FPTP) পদ্ধতির বিপরীতে একটি বিকল্প ব্যবস্থা। এখানে সংসদে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি থাকবেন। দলগুলো নির্বাচনে যতগুলো ভোট পাবে, তাদের প্রাপ্ত আসনের সংখ্যাও সেই অনুপাতেই নির্ধারিত হবে। ফলে ছোট দল এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। এই পদ্ধতিতে "আমরা বনাম তারা" ধাঁচের দ্বিদলীয় মেরুকরণের আশঙ্কা কমে যায়। ভোটারদের দেওয়া প্রতিটি ভোট মূল্যবান হবে, ভোট নষ্ট হবে না। এর ফলে ছোট দলও সুযোগ পেতে পারে। এই ব্যবস্থার কিছু জটিলতা হতে পারে তবে দলীয় সমঝোতা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এই সমস্যার উত্তরণ সম্ভব।

রাজনৈতিক মেরুকরণের বিলুপ্তিঃ বাংলাদেশ শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতাদের মেরুকৃত সমাজ ব্যবস্থায় আক্রান্ত। হঠাৎ করেই এই মেরূকরণ সম্পূর্ণ দূর করার কষ্টকর হতে পারে। তবে শক্তভাবে এই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং দুর্নীতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সে ব্যবস্থাকে দ্রুত প্রয়োগ করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান হবে। সবকিছুই একটি যুক্তিসংগত স্তরে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্র কোনো নিখুঁত সমাজ গঠন করে না, তবে সমাজের দ্বন্দ্বগুলোকে সভ্য পদ্ধতিতে পরিচালনা করে।

অলিগার্ক নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিংসাত্মক ও দায়মুক্ত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেন অপ্রতিরোধ্য, যা বৈষম্যমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে। কিছু অলিগার্ক বিপুল সম্পদ দখল করেছে, আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়ে ঐ সব অলিগার্কদের দ্বারস্থ হচ্ছে। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করে স্বাভাবিক কাজের সুযোগ দিলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। আমাদের দেশের জনগণ শক্তিশালী নেতা চায়, আবার ভোটের মাধ্যমে তাদের পরিবর্তনের ইচ্ছাও রাখে।

শক্ত এবং কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো : বাংলাদেশে রাষ্ট্রের দুর্বলতা জনবল ঘাটতি, প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি কেবল উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং জনগণ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। তবে সঠিক পরিকল্পনা, জনবল বৃদ্ধি, এবং প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনকে ক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনকে জনগণের নিকটবর্তী করতে হবে। প্রশাসনের দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতির বলয়মুক্ত করা খুবই জরুরি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।

এইচআর/জেআইএম