শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ২০২৪
মুক্তির আলোয় ইতিহাসের সাক্ষী
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এ বছর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই গণঅভ্যুত্থান জাতির মধ্যে নতুন এক রাজনৈতিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক আবেগ সৃষ্টি করেছে, যা বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মূল্যবোধের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এ বছরের উদযাপন শুধুমাত্র অতীতের শহিদদের স্মরণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বর্তমান প্রজন্মের নতুন আন্দোলন ও পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান শহিদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ একটি বাংলাদেশের স্বপ্নকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এ বছরের আয়োজনগুলোতে তাই ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণের পাশাপাশি সাম্প্রতিক আন্দোলনের চেতনা প্রতিফলিত হয়, যা জাতির ভবিষ্যত নির্মাণে শহিদদের আত্মত্যাগের গুরুত্বকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করায়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর শোকের এবং একই সঙ্গে গভীর শ্রদ্ধার দিন। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর দিনটি পালিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের দ্বারা নির্মমভাবে হত্যাকৃত দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে। এ দিবস আমাদের জাতির জন্য একদিকে দুঃখের স্মৃতি বহন করে, অন্যদিকে শহিদদের আত্মত্যাগের মহিমা উপলব্ধি করতে অনুপ্রেরণা জোগায়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। তাদের একেকজন ছিলেন জাতির প্রগতির আলোকবর্তিকা। তারা জাতির চেতনায় মুক্তির আলো জ্বালিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বুঝতে পারে যে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তখন তারা একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের মেধাবী মানুষদের হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করে। এই ষড়যন্ত্র ছিল কেবল একটি সাময়িক প্রতিশোধ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি এক আঘাত যা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষিত নেতৃত্বের অভাব ঘটিয়ে দেশকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নে উজ্জীবিত করেছিল। এই সংগ্রামে বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তাদের চিন্তা, আদর্শ এবং কাজের মাধ্যমে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা এটি বুঝতে পেরেছিল যে বাঙালির এই মুক্তির আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী নিধনের উদ্যোগ নেয়।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসটি ছিল এই পরিকল্পিত হত্যার চূড়ান্ত অধ্যায়। পাকিস্তানি সেনারা যখন নিশ্চিত হয়ে যায় যে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই বর্বর পদক্ষেপ নেয়। তারা বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, যাতে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের পর নেতৃত্ব সংকটে পড়ে এবং সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতিজন এবং অন্যান্য পেশাজীবী বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে। তাদের চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির চিন্তার ধারক ও বাহকদের চিরতরে নির্মূল করা, যাতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই বর্বর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি নির্মম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তবে তাদের এই ষড়যন্ত্র বাঙালি জাতিকে থামাতে পারেনি। স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সংগ্রাম সফল হয়েছিল, কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞের ক্ষত ইতিহাসে এক গভীর বেদনার দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাননি, বরং জাতির চেতনাকে জাগ্রত করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের জ্ঞান, শিক্ষা এবং আদর্শের মাধ্যমে জাতির দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালিয়েছেন।
শিক্ষাবিদরা মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক সময়ে ছাত্রছাত্রীদের চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং সরাসরি সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাদের সাহসী রিপোর্টিং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতার দিকগুলো আন্তর্জাতিক মহলে প্রকাশ করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল।
চিকিৎসকেরা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী ছিলেন, যারা আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের চিকিৎসায় অবদান রেখেছিলেন। তাঁরা সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে এবং বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। এর বাইরে আইনজীবী, সংস্কৃতিজন এবং অন্যান্য পেশাজীবীরাও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিককে সমৃদ্ধ করেছেন। আইনজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক এবং আন্তর্জাতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছিলেন, আর সংস্কৃতিজনরা তাদের গান, কবিতা, এবং নাটকের মাধ্যমে জনগণের মনে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তাঁদের আত্মত্যাগের তাৎপর্য অপরিসীম। শহিদ বুদ্ধিজীবীরা জাতির চিন্তা, নেতৃত্ব এবং সংস্কৃতির ধারক ছিলেন। তাদের হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে। তবে, তাদের আত্মত্যাগ শুধু শোকের বিষয় নয়; এটি বাঙালি জাতির জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে জ্ঞানের শক্তি এবং আদর্শের প্রতি আনুগত্য একটি জাতিকে মুক্তির পথে পরিচালিত করতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি তাদের আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাদের ত্যাগের মহিমা চিরকাল জাতির চেতনায় বেঁচে থাকবে।
বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতের স্মারক। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ওই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের অব্যাহত প্রেরণায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে চেয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় জাতির মেধা-শ্রেণিকে পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করতে চেয়েছিল। তাদের এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন এবং চিন্তা-শূন্য করে দেওয়া। যদিও তাদের এই পদক্ষেপ মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করতে পারেনি, তবে এটি এক চরম মানবিক ট্র্যাজেডি হিসেবে স্বাধীনতার পথে একটি অন্ধকার অধ্যায় রচনা করেছিল।
বুদ্ধিজীবী নিধনের ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং সমাজ গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে সব শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, এবং সংস্কৃতিজন দেশের উন্নত চিন্তা ও সৃজনশীলতার ধারক ছিলেন, তাদের নির্মমভাবে হত্যা করায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ মেধাবিদের এক বিরাট শূন্যতায় ভুগতে থাকে। শিক্ষাব্যবস্থায় এই শূন্যতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুভূত হয়েছে। উচ্চতর গবেষণা, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং জাতি গঠনের ক্ষেত্রে তারা যে অবদান রাখতে পারতেন, তা হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। একইভাবে সংস্কৃতিজগতেও একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়। অনেক প্রতিভাবান শিল্পী, সাহিত্যিক, এবং সংস্কৃতিসেবী তাদের সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে জাতিকে আলোকিত করতে পারতেন, কিন্তু তাদের নির্মমভাবে হত্যার ফলে জাতি এই সম্ভাবনাগুলো হারায়।
তবে বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটি প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে একটি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য জ্ঞান ও আদর্শের জন্য লড়াই করা যায়। তাদের আত্মত্যাগের কথা নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কখনোই সহজে আসে না, এবং এটি অর্জনের জন্য মূল্য দিতে হয়। বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনাগুলো ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে শুধু শোকের বার্তাই দেয় না; বরং এটি সাহস, আত্মত্যাগ, এবং ন্যায়ের সংগ্রামের একটি চিরন্তন প্রতীক। তাদের ত্যাগের চেতনা জাতির জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু, মেধাবী, এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারকে শক্তিশালী করবে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজও বাঙালি জাতির জন্য গভীর তাৎপর্য বহন করে। এটি কেবল একটি স্মৃতিচারণ নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেও বাংলাদেশের জন্য এই দিনটির প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত রাখা আজকের দিনের অন্যতম একটি দায়িত্ব। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের গল্প তাদের কাছে শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, এটি একটি জীবন্ত শিক্ষা। তাদের সাহস, আত্মত্যাগ, এবং দেশপ্রেম তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে পারে জাতি গঠনের কাজে। এই দিনটি পালনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারে যে স্বাধীনতা কোনো উপহার নয়, এটি একটি ত্যাগের ফল। এটি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা জাগিয়ে তোলে।
এছাড়া, ঐতিহাসিক সত্য এবং প্রজন্মান্তরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোকে স্মরণে রাখি। এটি ঐতিহাসিক সত্য বিকৃতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধও বটে। তরুণ প্রজন্মকে সত্যের সঙ্গে পরিচিত করানো এবং তাদের মাঝে বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের মূল্যবোধ তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। এই সংযোগ আমাদের জাতিগত পরিচয় এবং স্বাধীনতার ইতিহাসকে দৃঢ় করে।
শহিদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কেবল তাদের স্মরণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারকে জোরদার করে। শহিদ বুদ্ধিজীবীরা যে মূল্যবোধের জন্য প্রাণ দিয়েছেন—ন্যায়, সত্য, এবং মানবতা—তাদের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো সম্ভব তখনই, যখন আমরা সেই মূল্যবোধ আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করি। একটি বৈষম্যহীন, মানবিক, এবং সুশাসনভিত্তিক সমাজ গঠনে শহিদদের আত্মত্যাগ আমাদের চিরকাল প্রেরণা যোগাবে।
তাই শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস কেবল একটি স্মৃতির দিন নয়; এটি জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, আদর্শ, এবং ভবিষ্যতের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক। তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ এই দিনের মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্ব পুনরায় উপলব্ধি করতে পারে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জাতির উন্নতি এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ চিরকাল অনুসরণীয়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে জাতি প্রতিবছর গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে। এই দিনটি স্মরণ করার মাধ্যমে তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং তাদের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার করা হয়। দিনটির কর্মসূচিগুলো শহিদদের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মকে তাদের আত্মত্যাগের গল্প শোনাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক সংগঠনগুলো বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আলোচনা সভা, প্রবন্ধ পাঠ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এসব আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম শহিদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন ও কাজ সম্পর্কে জানতে পারে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ জাতির শোক এবং শ্রদ্ধার চিহ্ন হয়ে রয়েছে। এই সৌধগুলো শুধু একটি স্থাপত্য নয়; এটি বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে। ঢাকা শহরের রায়েরবাজার বধ্যভূমি এবং অন্যান্য জায়গায় স্থাপিত স্মৃতিসৌধগুলোতে লাখো মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। স্মৃতিসৌধের নিস্তব্ধতা একদিকে তাদের নিঃশব্দ আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে জাতির প্রতি তাদের স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানসমূহ শুধু শোক প্রকাশের জন্য নয়, বরং এটি তাদের আদর্শ এবং মূল্যবোধের প্রতি জাতির অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার একটি মাধ্যম। এই দিনে বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। জাতি গঠন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে মানবতার বিজয়ের জন্য এই দিনের তাৎপর্য অপরিসীম।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ এবং সম্মান প্রদর্শনের এসব কর্মসূচি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটি আমাদের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে, বর্তমানকে আলোকিত করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। এটি আমাদের জাতিগত পরিচয়ের একটি শক্তিশালী ভিত্তি এবং জাতি হিসেবে আমাদের একাত্মতার প্রতীক।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গভীর অর্থবহ দিন। এটি শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি শোকের দিন নয়, বরং তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীনতার মূল্যবোধ পুনর্বিবেচনার একটি সুযোগ। বুদ্ধিজীবীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে মূল্যবোধ আর মানবতার চেতনা জাগ্রত করেছে, তা জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।
তাদের আত্মত্যাগের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো সম্ভব তখনই, যখন আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পারি এবং তার যথাযথ মূল্যায়ন করি। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের জাতিগত পরিচয় এবং নৈতিক শক্তির ভিত্তি গঠনে অনস্বীকার্য। তাদের জীবন ও কর্ম আমাদের জাতি গঠনে অনুপ্রেরণা জোগায় এবং আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে জীবন্ত রাখে।
একটি সঠিক এবং ন্যায়পরায়ণ বাংলাদেশ গঠনে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ অনুসরণ করা আমাদের দায়িত্ব। ন্যায়, সত্য, এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি জাতি গঠনের জন্য তারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নের পথে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সঠিক পথ ধরে চলতে সাহস, দায়িত্ববোধ, এবং ত্যাগের প্রয়োজন।
তাই শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের আত্মসমীক্ষার একটি দিন। এটি আমাদের দায়িত্ব ও অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের একটি জ্ঞানভিত্তিক, মানবিক, এবং সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার জন্য অবিরাম কাজ করতে হবে। শহিদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তাদের আদর্শ আমাদের প্রতিদিনের প্রেরণা হয়ে থাকবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
এইচআর/এএসএম