সামাজিক বৈষম্য ও গণতান্ত্রিক সংস্কার
১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে অনেক চড়াই উতরাই এর মধ্যে দেশের গণতন্ত্র তেমন ভাবে সূদৃঢ় হতে পারেনি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলছে। স্বাধীনতার পর থেকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। যার প্রমাণ আমরা গত ১৬ বছরের শাসন আমলে দেখেছি। ফলে গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে ভাবে অনুভূত হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক সংস্কার
• গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাঃ আমাদের অনেকেরই ‘কী প্রয়োজন’ এবং ‘কেন প্রয়োজন’ সেটা সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমিত। সমস্যা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারলে, কাঠামোবদ্ধভাবে সমাধানে পৌঁছানো সহজ হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বাংলাদেশে এই সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে উদ্ভূত অগণতান্ত্রিকতা’। স্বাধীনতার পর যারা এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে, তারাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জন আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে পরিচালিত করেছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং স্থিতিশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজন। নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই সংস্কার প্রক্রিয়া সফল হতে পারে। বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে যদি সরকার এবং নাগরিকরা একযোগে কাজ করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়।
একই সাথে কাজ করেছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার এবং সুশাসনের অভাব এবং বৈষম্য। আমরা যারা দায়ত্বে থাকি বা পাই বা আন্দোলনে যাই তাদের কতজন ‘কি দরকার, কেন দরকার এবং কিভাবে’ সে দরকার পূরণ করা যাবে সে ব্যাপারে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখি? আবার অনেকেই যাদের জ্ঞান আছে তাদের একটা দুষ্টু চিন্তা কাজ করে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গোষ্ঠিকে সুবিধা দেয়ার জন্য। ফলে তাদের একধরনের ‘পক্ষপাত’ কাজ করে। সমস্ত দেশ এবং জনবান্ধব সংস্কার করতে ‘পক্ষপাত’ কাজ করলে ঐ সংস্কার কোনোভাবেই টেকসই হয় না। যাই করা হোক না কেন- সংস্কার বা পরিবর্তন, সেটা অবশ্যই টেকসই এবং জনবান্ধব হতে হবে।
• নির্বাচন ব্যবস্থা এবং বহুদলীয় সংস্কারঃ বাংলাদেশে জাতীয় বা সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতি আসনভিত্তিক। এই পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নির্দিষ্ট প্রতীকে দাঁড়ানো প্রার্থীদের মধ্যে। নির্দিষ্ট আসনে যে প্রার্থী ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে’ জয়ী হন, তার জয় দলের কেন্দ্রীয় হিসাবের সাথে যুক্ত হয়। ফলে যখন কোনো আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কেবল একজন ‘বিজয়ী’ নির্ধারিত হয়, তখন সেই আসনের বৃহদংশের ভোট একপ্রকার গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক নামে পরিচিত হলেও এই সংখ্যাগরিষ্ঠভিত্তিক ‘একমাত্র বিজয়ী’ নির্বাচন পদ্ধতি আসলে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে বৃহদাংশের মতামতের প্রতিফলন জরুরি। ‘একমাত্র বিজয়ী’র চেয়ে ‘বহু বিজয়ী’র অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে আরও সুসংহত করবে।
• শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাঃ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন রয়েছে যা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, এবং সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন যাতে তারা রাজনৈতিক চাপ মুক্ত থেকে জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে পারে।
• স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থাঃ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন। দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট হওয়া এবং জনগণের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা সমাধানের জন্য স্বচ্ছ ও গণমুখী নীতি গ্রহণ অপরিহার্য।
• মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হওয়া উচিত এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং আইনের শাসন দৃঢ়ভাবে কার্যকরী নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে সম্ভব।
• মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সুশীল সমাজের মাধ্যমে জনগণ যাতে তাদের মত প্রকাশ করতে পারে, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
সংস্কারে নাগরিকদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের টেকসই উন্নয়ন এবং সংস্কারে নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি জনগণ, এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণই একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের সংস্কারে বা পরিবর্তনে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার চর্চা নেই। ‘সুশীল সমাজ’ নামে একটি দল সৃষ্টি করে তাদের মতামতকেই দেশের জনগণের মতামত হিসাবে ধরে নেয়া হয়-যা বৈষম্যমূলক। দেশের নাগরিকরা যখন দেশ পরিচালনা এবং গনতন্ত্র চর্চা সম্পর্কে সচেতন থাকেন না তখনি গনতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে যায়। গণতন্ত্র সংস্কারে এবং প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
• ভোটাধিকার প্রয়োগঃ নাগরিকদের অংশগ্রহণের অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে ভোটাধিকার প্রয়োগ। প্রত্যেক নাগরিকের ভোট গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যা তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে।
• নাগরিক সমাজের ভূমিকাঃ সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুশীল সমাজ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে নীতিগত পরিবর্তনের জন্য। তারা সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক।
• সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিবাদঃ গণতন্ত্রে নাগরিকদের অধিকার আছে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করার এবং শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার। সামাজিক আন্দোলন গণতন্ত্রকে সজীব রাখে এবং সরকারের ওপর দায়িত্বশীল হতে চাপ তৈরি করে। শিক্ষিত তরুণ সমাজের নেতৃত্বে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিবাদ, গণতান্ত্রিক সংস্কারের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে আসতে পারে।
• রাজনৈতিক অংশগ্রহণঃ নাগরিকরা সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে স্থানীয় সরকার, উপজেলা নির্বাচন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। তরুণ প্রজন্মের জন্য রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে অংশগ্রহণ করা জরুরি, কারণ তারা আগামী দিনের নেতৃত্বকে প্রতিনিধিত্ব করে।
গণতান্ত্রিক সংস্কারে নাগরিকদের দায়িত্ব
• সচেতনতার প্রসারঃ প্রতিটি নাগরিকের উচিত গণতন্ত্রের মূলনীতি, সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা। গণমাধ্যম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় নাগরিকদের মধ্যে গণতন্ত্রের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
• দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানঃ দুর্নীতি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। জনগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে এবং স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ জানালে সুশাসনের পথ প্রসারিত হবে। নাগরিকদের উচিত দুর্নীতির কোনো ঘটনা জানালে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা।
• সমবেদনা ও সহমর্মিতাঃ গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা তৈরি করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি বজায় রেখে সকলের মতামত গ্রহণ এবং সহনশীলতার সাথে কাজ করতে হবে।
• ইতিবাচক রাজনৈতিক অংশগ্রহণঃ সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে নাগরিকরা ইতিবাচক রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমালোচনা করতে পারে। সরকারের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারে।
• নির্বাচিত সরকার যেন ফ্যাসিস্টে রুপ না নিতে পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকাঃ মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, এবং গণতন্ত্রের পক্ষে প্রচারণা চালানো গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও, ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একত্রিত হতে হবে নাগরিকরা সরকারের অপশাসন এবং অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন, যা ধীরে ধীরে গণজাগরণের সৃষ্টি করবে এবং ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং স্থিতিশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজন। নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই সংস্কার প্রক্রিয়া সফল হতে পারে। বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে যদি সরকার এবং নাগরিকরা একযোগে কাজ করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। দেশ এবং জনগণের চাহিদা পুরনে সক্ষম এমন গনতান্ত্রিক সংস্কার বা পরিবর্তন হতে হবে। যা আমাদের জন্য নয় সেটা যেন না করি। মনে রাখতে হবে,‘টয়োটা গাড়ির কাঠামোতে মার্সিডিজ-এর ইঞ্জিন লাগানো যায় না, তাতে গাড়ি চলবে না বা টেকসই হবে না।‘
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
এইচআর/এএসএম