ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রাণঘাতী ডেঙ্গু : দায় ও দায়িত্ব

ইয়াহিয়া নয়ন | প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে। এ বছর প্রথম ৯ মাসে ১৬৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শুধু গত সেপ্টেম্বরেই মারা গেছেন ৮০ জন। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও প্রতিদিন বাড়ছে। প্রতি সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ২০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে।

বুধবার (২০ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৪২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৩ হাজার ১৫৪ জন। হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখা যায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের হাহাকার।

জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আগামী মাসে আরও বাড়তে পারে। কারণ, রোগটি বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ের অভাব বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

তাঁদের পরামর্শ, পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আগে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারের জোর প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। অবশ্য গত সোমবার ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্রতিটি কমিটিতে দেশের তিনজন বিশেষজ্ঞকে সদস্য করা হয়েছে।

কথা হচ্ছে, কমিটি দিয়ে কি করবো? যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হয়। কমিটি বসে বৈঠক করবে, সুপারিশপত্র তৈরি করবে। তারপর তা সরকারের কাছে যাবে। সরকার সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিবে। তারপর কি হবে তানিয়ে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের কথা হচ্ছে, এখনই মৃত্যুর স্রোত রুখতে হবে। কারণ যার বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে তারাই যানে দুর্ভোগ কাকে বলে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের কারণে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কাজগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আন্দোলনের সময় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌরসভা কার্যালয়ে ভাঙচুর হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। জনপ্রতিনিধিদের এভাবে ঢালাও অপসারণের ফলে ডেঙ্গু রোধের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। এর ফলে মশা নির্মূল করার সব কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নজরের বাইরে চলে গেছে।

আমরা বার বার শুনছি, ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই সমন্বয় হয়নি। প্রতিবছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা তিন দফায় ডেঙ্গুর লার্ভা জরিপ করে তা স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বর্ষাপূর্ব জরিপ হয়েছিল। কিন্তু বর্ষা ও বর্ষাপরবর্তী জরিপ হয়নি। গত বছর অক্টোবরের মধ্যে এই দুই পর্যায়ের জরিপ সম্পন্ন হয়েছিল। এবার তা হয়নি।

এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। কিন্তু এবার জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে ডেঙ্গুর অবস্থার এতোটা দীর্ঘ হয়েছে।

এবছর দেখা যাচ্ছে, ভাইরাস মিউটেশনের ফলে বদলে গেছে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, বেড়েছে স্থায়ীত্বও। নভেম্বরের মাঝামাঝি এসেও কমছে না প্রকোপ। এমনকি, প্রাদুর্ভাব আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। শিশু, গর্ভবতী নারী এবং প্রবীণদের জ্বর হলেই পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎকরা। সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখতে বলেছেন ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্তদের। একইসাথে, এসেছে ঘরোয়া অপচিকিৎসা বাদ দেয়ারও তাগিদও।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনটা ডেঙ্গু আর কোনটা সাধারণ জ্বর তা আলাদা করতে পারছেন না অনেক রোগীই। ডেঙ্গু জ্বরকে যেমন অনেকেই পাত্তা দিচ্ছেন না, তেমনি অনেকেই সাধারণ জ্বরেও নিচ্ছেন সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। সমস্যা হচ্ছে নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে বলাও যাচ্ছে না কোনটা ডেঙ্গু আর কোনটা স্বাভাবিক জ্বর।

গেল বছরের তুলনায় এবার প্রাদুর্ভাব কম হলেও মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। যদিও বছরের এই সময়ে এসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকার কথা না। তবে কি ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপ্তি বছরব্যাপী হয়ে যাচ্ছে? একই সাথে ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিষ্ঠিত লক্ষণের বাইরেও নতুন কিছু লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামসুল কবীর বলেন, প্রচুর রোগী আসছেন ডায়রিয়া নিয়ে, ডায়রিয়া-জ্বর, দেখা গেল ডেঙ্গু পরীক্ষায় তারা পজেটিভ। আবার অনেকেই আসছে বুকে ব্যথা নিয়ে, কিন্তু নিউমোনিয়া বা হার্ট অ্যাটাকের সমস্যা নয়। পরে দেখা যাচ্ছে, তারও ডেঙ্গু পজেটিভ। তিনি বলেন, এমন রোগীও আসছে তার প্লাটিলেট লেবেল কম কিন্তু পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু নেই। ডেঙ্গু রোগীদের হাত-পা ফুলে যাচ্ছে, যেটি আগে ছিল না।

গেল বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। এবার এতোটা ভয়াবহ না হলেও দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এতো মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামসুল কবীর বলেন, অনেক রোগী খারাপ হয়ে আইসিইউতে গেছে বা মারা গেছে বাসায় অপচিকিৎসা নেয়ার কারণে। ডেঙ্গুর একটাই চিকিৎসা, সেটি হচ্ছে প্যারাসিট্যামল খেয়ে জ্বর কমাতে হবে আর শরীর যেন পানিশূন্য না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। তিনি বলেছেন, অহেতুক আখের রস বা ডাবের পানি বেশি বেশি খাওয়ার প্রয়োজন নেই।

মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে গবেষণা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গুকে সাধারণ জ্বর মনে করা, একদম শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে আসা এবং আগে থেকেই জটিল রোগে আক্রান্ত থাকাই প্রধান কারণ বলছে অধিদফতর।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ পরিচালক শেখ দাউদ আদনান বলেছেন, আমরা সহজে হাসপাতালে যেতে চাই না। যখন একেবারেই হচ্ছে না, তখনই হাসপাতালে নেয়া হয়। ফলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যায়। মারা যাওয়াদের অধিকাংশই হাসপাতালে নেয়ার ২৪ ঘণ্টার আগেই মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এবারের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দীর্ঘায়িত হতে পারে আরও মাস দুয়েক। সেজন্য দিয়েছে মশক নিধনের তাগিদ। রাজধানীসহ দেশের সব শহরেই প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে। কেউ এসে আমাদের আশেপাশের ডেঙ্গু মশা বিনাশ করবে না। কাজটা আমাদেরই করতে হবে। নইলে ছোট একটা মশার কারণে হারাতে হবে পরিবারের আপনজনকে।

এখনও রাজধানীসহ সারাদেশেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। সবাই সচেতন না হলে সহসা ডেঙ্গু থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। একইসঙ্গে জ্বর হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। জ্বরের কারণ নিশ্চিত হয়েই ওষুধ খেতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস