ঢাকার পথেঘাটে আন্দোলন অবরোধ ও মারামারির শিডিউল চাই
গত তিন মাসে অভ্যাসটা এমন দাঁড়িয়েছে যে ঘুম ভেঙেই প্রথমে ট্র্যাফিক এলার্ট লক্ষ করি, নগরীর কোথায়, কী অবস্থা থাকবে তা জানার জন্য। কে, কখন, কোথায় রাস্তা দখল করে নিজ নিজ দাবি নিয়ে বসে পড়বেন বা কারা কার সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন, এটা জানা খুব দরকার। নয়তো ভয়াবহ বিপদে পড়তে হতে পারে, মাথায় ইট-পাটকেল উড়ে এসে পড়তে পারে, পিঠে উচ্ছৃঙ্খল জনতা বা পুলিশের দু’ঘা পড়তে পারে, শিশুরা ভীতিকর অবস্থার শিকার হতে পারে, কর্মস্থলে আটকা পড়তে পারেন এবং সর্বোপরি অকালে প্রাণ হারাতে পারেন। কাজেই জেনে বুঝে পথে নামার প্র্যাকটিস করছেন অনেকেই। যদিও মারামারি, গোলযোগ, অবরোধের ঘটনা ও ঘটনার সময়ক্রম মনে রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেমন সেদিন রাত প্রায় ১১ টার দিকে একজন সতর্ক করে দিয়ে ট্র্যাফিক এলার্ট পেইজে লিখেছেন, তেজগাঁও এভয়েড করুন। এখানে পলিটেকনিক ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে গোলযোগ চলছে এবং প্রচন্ড যানজট। এই স্ট্যাটাসের নিচে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ভাই দিনে-রাতে এত এভয়েড করতে করতে কখন যে দুনিয়াটাই এভয়েড করতে লাগে।’ এটাই এখন ঢাকাবাসীর অবস্থা। সোমবার রাত পৌনে একটার সময়ও উত্তেজনা চলছিল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার বিটাক মোড়ে।
আবার সোমবার সকাল থেকেই আগারগাঁও ছিল অটোরিকশা চালকদের দখলে। অন্যদিকে ঢাকা কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ সোমবার থেকে। কারণ ’সুপার মানডে’ কে মারামারি করার দিন ঘোষণা করেছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর আগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০ এর অধিক কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘সুপার সানডে’ ঘোষণা করে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের ১৭টি ডিপার্টমেন্টে ভাঙচুর করেছে।
অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, মানুষের চোখ এখন সবসময় টেলিভিশন বা মোবাইল স্ক্রলে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় কী জানি কিছু মিস করে গেলাম কিনা? ঘুমের পাশাপাশি বই পড়ার, ইবাদত করার, গল্প করার বা গান শোনার জন্য ভালো সময় হচ্ছে রাত। অথচ এখন নগরবাসীর কাছে রাত মানে পরের দিনের হট্টগোল, মারামারি ও সড়ক অবরোধের শিডিউল খোঁজা।
সোমবার দক্ষিণ ঢাকা যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। সেদিন মারামারি, লুটপাট, ভাংচুর দেখে মনে হয়েছে এ যেন শিক্ষাঙ্গন নয়, কুরুক্ষেত্র। শুধু ক্ষয়ক্ষতিই নয়, নিহত ও আহত হয়েছে অনেক ছাত্র। ছাত্রদের হাতে যখন বইখাতার বদলে রামদা, কিরিচ, লাঠি স্থান করে নেয়, তখন অভিভাবক হিসেবে আমি লজ্জিত হই।
এর আগে রবিবার সারাদিনে অন্তত ৫ থেকে ৬ টি বিক্ষোভ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সড়ক অবরোধ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা, ভাংচুর ও লুটতরাজ করে ছাত্ররা প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেছে। ভুল চিকিৎসায় রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনার বিচারের দাবিতে মোল্লা কলেজসহ ঢাকার ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছেন। এতে সাংবাদিকসহ ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পড়াশোনা, ঘুম, বিনোদন বাদ দিয়ে রাত-বিরাতে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াতেই আনন্দ পাচ্ছেন বেশি।
এর আগে দুইদিন ধরে চলমান ছিল প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে বিক্ষোভ, নামাজ আদায়, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ এবং জিয়াফত। স্পষ্ট হচ্ছে না এই লোকগুলো কারা, কোথা থেকে এসেছেন, কেন তারা প্রতিষ্ঠিত এই দুই পত্রিকাকে বন্ধ করার ধান্ধা করছেন, কেন এদের হিন্দু ও ভারতের দালাল বলে চিহ্নিত করছেন? সরকার কেন এই প্রসঙ্গে দুইদিন চুপ করে ছিল? আর গরু জবেহ দিয়ে এরা কোন শুদ্ধিকরণের কথা বলছেন? সবচাইতে ভয়াবহ কথা হচ্ছে যে গরুটা জবাই দেয়ার জন্য আনা হয়েছিল, তার গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছিল ‘প্রথম আলোর সম্পাদকে’র নাম। তাহলে কি এরা সম্পাদককে একধরনের হুমকি দিতে চেয়েছেন? দুটি প্রভাবশালী ও পেশাদার পত্রিকার উপর এই ষড়যন্ত্র ও রোষের কারণ কী?
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাসে শিক্ষার অচলাবস্থা কাটেনি। কলেজগুলো পরস্পর বিবাদমান গ্রুপে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা করার কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থবিরতা রয়ে গেছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে যোগ্য উপাচার্য নিয়োগ করতে হিমশিম অবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষার্থীদের জোর-জবরদস্তি, শিক্ষককে মারধোর, দাবি ও চাপের মুখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানসহ শিক্ষকদের পদত্যাগের অসংখ্য ঘটনা শিক্ষার পরিবেশ দারুণভাবে বিঘ্নিত করেছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরে এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং তা সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
দেশে বিভিন্নক্ষেত্রে যে অরাজকতা চলছে তা বন্ধ করতে গিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রশাসনে এখনো অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটেনি কারণ দলভিত্তিক রাজনীতি প্রশাসনকে করে তুলেছে দ্বিধান্বিত। শেখ হাসিনা সরকার সরে যাওয়ার পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ও আদালতে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাতে নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা হিসেবে ঢালাওভাবে কয়েকশ জনকে আসামি করার বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভাবতে হবে এধরনের মামলা বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার? আইনিভাবে এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?
সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশে বিদেশি অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কর্মকর্তা ও শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত। চলমান প্রকল্পগুলোর গতিও কমেছে ব্যাপক, অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে এসব প্রকল্পের কাজ। অনেক প্রকল্পের কাজ তো একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। নিরাপত্তার অভাবে প্রকল্পগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারাও অনেকেই অনুপস্থিত রয়েছেন। এসব প্রকল্পের মধ্যে চীন, ভারত, জাপান ও কোরিয়ার প্রকল্পই বেশি বলে জানা গেছে।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে অচলাবস্থায় ঢাকার বিলাসবহুল হোটেল ব্যবসা যে অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়েছিল, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। দেশী-বিদেশী পর্যটক, বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী, এনজিও প্রতিনিধিদের আগমন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, দিবসপালন ইত্যাদি অনুষ্ঠানও পুরোপুরি চালু হয়নি।
ঢাকা শহরের মতো জনবহুল ও ব্যস্ততম শহর প্রায় প্রতিদিনই আচমকা দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে গোটা দিন অচল হয়ে থাকছে। ঢাকাকে এখন ’দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের’ শহর বললে ভুল হবে না। প্রতিদিন একেক দল বা গোষ্ঠী বা পক্ষ রাস্তায় নেমে আসছেন আর নিজেদের বিবিধ দাবি জানাচ্ছেন। আর মারামারি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া তো রয়েছেই। ছাত্রদের হাতেও রাম দা, কিশোর গ্যাং এর হাতেও তাই, প্রকৃত অপরাধীরাতো আছেই। প্রায় প্রতিটি মিডিয়ার এখন জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ এই সব রণক্ষেত্র লাইভ করা। এইভাবেই চলছি, যে স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, সেটা কতটা অর্জিত হয়েছে বা হবে, সেই বিচারের ভার পাঠক-দর্শক ও শ্রোতার।
যাক জানি না এই লেখা প্রকাশ হতে হতে আরো কী কী ঘটনা ঘটতে পারে। তবে যাই ঘটুক আমরা বুঝতে পারছি শহর জুড়ে, দেশ জুড়ে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এখনই যদি শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরা না হয়, তাহলে কতগুলো অবিবেচক ও দুর্বিনীত মানুষের হাতে দেশ জিম্মি হয়ে যাবে।
এই শহরবাসী এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে সবার মধ্যে তৈরি হচ্ছে সংশয়, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, অশান্তি ও টান টান উত্তেজনা। সবার এক প্রশ্ন আজকে কোথায়, কখন, কী আন্দোলন-কর্মসূচি? অনেকেই দাবি জানাচ্ছেন সড়ক অবরোধ ও মারামারির একটি শিডিউল দেয়া হোক। যারা ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে আসবেন, তারাও অনলাইনে হট্টগোলের শিডিউল দেখে নিবেন।
অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, মানুষের চোখ এখন সবসময় টেলিভিশন বা মোবাইল স্ক্রলে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় কী জানি কিছু মিস করে গেলাম কিনা? ঘুমের পাশাপাশি বই পড়ার, ইবাদত করার, গল্প করার বা গান শোনার জন্য ভালো সময় হচ্ছে রাত। অথচ এখন নগরবাসীর কাছে রাত মানে পরের দিনের হট্টগোল, মারামারি ও সড়ক অবরোধের শিডিউল খোঁজা।
২৬ নভেম্বর, ২০২৪
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম