ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন ও জন আকাঙ্ক্ষা

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৮:৩৩ এএম, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের একশ’দিন পূর্তি হয়ে গেল। দেশের বাইরে বর্তমান সরকারের ইমেজ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নামকরা পত্রিকায় খবর বের হতে দেখা যায়। একটি প্রতিবেশী দেশ বাদে অন্যান্য দেশের গণমাধ্যম অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে সেটা অনেকাংশে প্রযোজ্য। অনেকে বলেন, সেটা নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দরিদ্র বাঁচানোর অর্থনৈতিক দর্শন ও একান্ত ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে বাংলাদেশের উপর বহির্বিশ্বের অনেকের কৌতূহলের কারণে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু আশাবাদী জনগণের বর্তমান চিন্তা ও চাহিদার অতি রকমফের যেসব নিত্যনতুন সংকট সৃষ্টি করছে এবং সেগুলো পরিপূরণে ব্যর্থ হয়ে সরকারের সংগে যে জনদূরত্ব সৃষ্টি তা দেশের বাইরে থেকে অনুভব করার সুযোগ হয়তো তাদের কারুরই হয়নি।

ইতোমধ্যে দেশে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। তারা মাঠে নেমে সংস্কার কাজের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু জনগণের অনুভূত প্রয়োজন (ফেল্ট নিড) মেটানোর জন্য সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তদের জন্য সরকারী সাহায্য, টেষ্ট রিলিফ, শহর কেন্দ্রিক টিসিবি-র কিছু ওপেন মার্কেট দিয়ে বিশাল সাহায্যপ্রার্থী জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদার অতি সামান্য অংশ সমাধান করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখাও ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে।

একটি স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনবিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস না পেরুতেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়েছিল। যেটা অদ্যাবধি এই সরকারে পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। কারণ এর লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের নিবিড় কাজ ও তাদের পোষ্যদের জীবন-জীবিকার সাথে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বহুলাংশে জড়িত রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ ও বের হবার প্রধান সড়কগুলোর ধারে হাজার হাজার পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোতে সামান্য কারণে যে কোন সময় অসন্তোষ লেগেই আছে। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রচেষ্টা আমাদের দেশের বহু পুরনো রোগ।

অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু থেকে পোশাক শ্রমিকদের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রচেষ্টা দেশকে ধীরে ধীরে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের গার্মেন্টস পাড়ায় চরম অস্থিরতা অবলোকন করে বিদেশী বায়ারগণ ভিন দেশে অর্ডার সরিয়ে নেয়া শুরু করেছেন। এটা আমাদের অর্থনীতিকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। বলা হচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসররা এই ঘৃণ্য পন্থায় দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। সেনাবাহিনীকে সেখানে দায়িত্ব দেবার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পুন:পুন: আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে কারখানা বন্ধ রাখায় শ্রমিকদের বেকারত্ম সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও স্বল্পমজুরিতে কর্মরত হলেও তাদের বেতন ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে।

আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো- বিগত স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনবিপ্লবের সময় আহত-নিহতদের জন্য জন্য শক্তিশালী নীতি গ্রহণে ঢিলেমি করা। আন্দোলনের অব্যবহিত পরে সরকার গঠনের সাথে সাথে নিহতদের সাথে আহতেদের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরীর ব্যবস্থা করার চিন্তা মাথায় আসেনি। বিগত আন্দোলনে কতজন কিভাবে আহত হয়েছিলেন তার কারণও জানা যায়নি। তাই ‘আনসার লীগের’ মতো তিনমাস পরে ‘আহত লীগের’ কথা উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে জনপ্রিয় কিছু সমন্বয়কের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে ‘আহত লীগের’ নামে চমকপ্রদ ভয়ংকর কিছু তথ্য।

একটি প্রথমসারির দৈনিক পত্রিকা লিখেছে, ‘আনসার লীগের পর এবার যে সরকার আহত লীগের খপ্পড়ে পড়েছে, এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের কথা আপনারা মানুষকে কেন জানাচ্ছেন না এখনো? আপনারা বারবার বলছেন, চিকিৎসা করেন, চিকিৎসা করেন, চিকিৎসা করেন। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করা যায়। বাট সুস্থ মানুষ যখন রাস্তায় শুয়ে উপদেষ্টা হওয়ার দাবি করে, সেটার চিকিৎসা কী হবে?’ একজন আহত মানুষ কেন উপদেষ্টা হতে চাইবে বা একজন আহত মানুষ কিভাবে সারা দিন অনুষ্ঠান করে এসে রাতে হাসপাতালে ঘুমাবে, এই প্রশ্নটা কেউই করছে না।’ তবে ফ্যসিস্ট চরিত্রের প্রতারণার কত রকমফের হতে পারে- এ থেকে সবার শিক্ষা নেয়া উচিত।

কথা হলো- যে কোন আহত ব্যক্তির জন্য আন্দোলন করে চিকিৎসা খরচ ও সেবার আঞ্জাম করতে হবে কেন? আহতরা হাসপাতালের বেড ছেড়ে রাস্তায় নেমে চিকিৎসার খরচের জন্য কান্নাকাটি ও চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর চেষ্টা দেশের মানুষকে অবাক করেছে। সবার আগে তাদের সুচিকিৎসার বিষয়টিকে মাথায় নেয়া উচিত ছিল। যখন আহতরা পঙ্গুত্ব বরণ করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত তখনও নতুন উপদেষ্টা পদ লাভের জন্য আরেক রাজপথে ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছিল!

এদের ভূমিকায় ঘন্টার পর ঘন্টা রাজপথে গাড়ির মধ্যে আটকা পড়ে যেসকল সাধারণ জনগণ কষ্ট পেয়েছেন তারা কি ভাবছেন? জনদুর্ভোগ পোহানো মানুষেরা অনেকটাই আশাহত হয়ে পড়ছেন। প্রতিদিন ভয়াবহ যানযটের কবলে পড়া মানুষগুলো এসকল আন্দোলনকারীদের কাজের বৈপরীত্যের মধ্যে কোনো হিসেব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মানুষ রাজপথে নেমে দাবি করা শিখেছে, কিন্তু সেসব দাবি আদায়ে আরো বেশি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা নতুন করে শেখাচ্ছে বলে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করছেন। এতে সরকারে বিরুদ্ধে জনদূরত্ব সৃষ্টির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।

ফ্যাসিবাদ বর্তানো শুধু একজনের কাজ হলেও- এর ডালপালা ও শেকড় আমাদের দেশ ও সমাজের অতি গভীরে প্রোথিত হয়ে সেটার অনুশীলন এখনও দেশ-বিদেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যাপ্তি ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। এর সমূল উৎপাটন করতে হলে সকল রাজনৈতিক দলকে এর স্বীকৃতি দিয়ে একসংগে শরীক হয়ে প্রচেষ্টা চালানোর কোনো বিকল্প নেই।

উপরের সবগুলো ইস্যুকে ছাড়িয়ে যেটি আমাদের সমাজের প্রতিটি কর্নারে গভীরভাবে জেঁকে বসেছে তা হলো- নিত্য দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস। নিত্যপণ্যের বাজার একবারেই অস্বাভাবিক ও অস্থির। নিত্যপণ্যে বাজারের উপর পতিত আওয়ামী সরকার তিনবছর আগেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। তারা সেটি গোপন করে গণমাধ্যমে ভিন্ন বিষয় উস্থাপন করে পার পেতে চেয়েছিল। ফলে দরিদ্র, নির্ভরশীল ও নিন্মআয়ের মানুষের সাথে বিগত সরকারের চরম দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।

ডিম ও গোলআলু এই দুটি গোলাকার পণ্য বাজারে সর্বপ্রথম গোলমাল সৃষ্টি করেছিল। চিনি, ভোজ্যতেল, চাল সবকিছুর বাড়তি মূল্য একসময় ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে হারিয়ে হতাশ করে তুলেছিল। সেই কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তিলাভের আশায় উপর পর্যায় থেকে দ্রব্যমূল্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে দৈনিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু-সুলভ মূল্যনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আশা করছিলেন। সাধারণ জনগণ বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের দিকে তাকিয়ে ১০০তম দিন পার করে দিলেও তাদের সে আশায় গুঁড়েবালি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের শুল্ক প্রত্যাহরেও বাজারে তার দাম কমছে না। কারণ বাজারের বিক্রেতা ও তাদের সরবরাহকারীদের চেতনার সাথে চরম সমন্বয়হীনতা বিদ্যমান রয়েছে।

কারণ, ইতোমধ্যে তাদের সাথে দেশের সমধরার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমচেতনা জাগ্রত করে দেবার পরিবর্তে উভয়ের পারস্পরিক চেতনার মধ্যে দূরত্ব তৈরীর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কোনো কোনো উপদেষ্টা দেশের সমধারার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে আপন মনে যা ভাল হয় তা ভেবে কাজ করে চলছেন। যা কার্যত: জনবিরোধী অবস্থান নেয়ার নামান্তর।

এমনকি ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও চরম বিভাজন লক্ষণীয়। তাবলীগ জামাত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও পাল্টাপাল্টি কর্মূসূচি পালন দেশে সমগ্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে আহত করছে। এসব সাধারণ মানুষের মনের ভাষা নয়, কারো নিকট ইতিবাচক বা কাম্য পরিস্থিতিও নয়।

তরুণরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। তারা সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করার আগেই কেউ কেউ ফ্যসিবাদের দোসরদের কব্জায় পড়ে বিভিন্ন পদ-পদবী বাগিয়ে বিলাসী জীবনের দিকে ধাবিত হবার চেষ্টায় মোহান্বিত হয়ে পড়েছেন বলে মনে হচ্ছে। এব পদবঞ্চিতদের সাথে তাদের দূরত্ব তৈরী হয়েছে। এবং তিনমাস না পেরুতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতের পার্থক্য শুরু হয়েছে। ফলে তারে সেই শুরুর সময়ের তারুণ্যের স্পিরিট নষ্ট হবার উপক্রম হয়ে পড়েছে।

তারুণ্যের স্পিরিট নষ্ট হবার এই সংকটকালে কেউ কেউ ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে অন্ত:ফ্যাসিবাদ নির্মূলের বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমান জনদূরত্ব বহাল রেখে নিজেদের মধ্যে মতের ভিন্নতাকে প্রচারিত হবার সুযোগ দিতে থাকলে নতুনভাবে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত হবে কোন পন্থায়? সমধারার রাজনৈতিক দলগুলো এভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে আরো দূরে সরে যেতে থাকলে সেখানে ব্যালট বিপ্লব হবেই বা কিভাবে?

একসংগে এতবেশী সংস্কারে হাত দিতে গিয়ে কোনটাই ঠিকমতো হচ্ছে না- এমন অবস্থা জাতিকে আরো বেশী আশাহত করে তুলতে পারে। তাই সবার আগে জনদূরত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে রুখে দিয়ে জনসম্পৃক্তাতা বাড়ানোর কাজে এগিয়ে এসে সেই শুরুর সময়ের তারুণ্যের স্পিরিটকে নষ্ট হবার হাত রেখে রক্ষা করতে হবে। শুধু বিদেশে নয়, প্রধান উপদেষ্টার ফেসভ্যালুকে গোটা দেশের অভ্যন্তরে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা দরকার। এর সাথে দেশের আশাবাদী মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে আরো কিছু নতুন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

ফ্যাসিবাদ বর্তানো শুধু একজনের কাজ হলেও- এর ডালপালা ও শেকড় আমাদের দেশ ও সমাজের অতি গভীরে প্রোথিত হয়ে সেটার অনুশীলন এখনও দেশ-বিদেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যাপ্তি ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। এর সমূল উৎপাটন করতে হলে সকল রাজনৈতিক দলকে এর স্বীকৃতি দিয়ে একসংগে শরীক হয়ে প্রচেষ্টা চালানোর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

এইচআর/জেআইএম