স্বপ্ন সুপার শপের কম্বো প্যাক এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা
ছোট পরিবারের বা স্বল্প আয়ের মানুষের কেনার সুবিধার্থে স্বপ্ন সুপার শপ গরুর মাংসের সঙ্গে আলুসহ কম্বো প্যাক করেছে। সেখানে থাকছে গরুর মাংস ২০০ গ্রাম এবং আলু ১০০ গ্রাম (১০ পিস গরুর মাংসের সাথে ১০ পিস আলু)- যার বিক্রয়মূল্য রাখা হয়েছে ১৬০ টাকা। এই অফার নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যথেষ্ট ট্রল হচ্ছে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিচিত দুজনকে পেলাম, যারা ছুটে গেছেন এই অফারটি গ্রহণ করতে এবং গিয়ে দেখেছেন বেশ লম্বা লাইন। শুধু বাচ্চাদের পাতে একটুকরা মাংস তুলে দেয়ার জন্য এই দুইজন বাবা কম্বো অফারের পেছনে ছুটে গেছেন। একজন নিন্ম মধ্যবিত্ত বাবার জন্য এর চাইতে বড় সুযোগ আর কী হতে পারে? কারণ কোরবানি ঈদের পর বাসায় গরুর মাংস রান্না করার মতো সুযোগ হয়নি।
এর আগেও দেখেছি চিপস, টমেটো সস, চানাচুর, বিস্কুট, শ্যাম্পু, ডানো মিল্ক পাউডারের মিনি প্যাক - সবকিছুর দাম এক থাকলেও সাইজ ছোট হয়ে গেছে। সাইজ ছোট মানে কমেছে পরিমাণও। রাস্তার ধারের হোটেলগুলোতে যে সিঙ্গারার দাম ছিল ৫ টাকা, দাম এক থাকলেও ছোট হয়েছে সাইজ। আগে যেখানে দুটো সিঙ্গারা খেয়ে এক গ্লাস পানি খেলে একজন সাধারণ শ্রমিকের পেট ভরতো, এখন দুটোর জায়গায় তিন/চারটা খেতে হচ্ছে। অথচ পকেটের অবস্থাও সিঙ্গারার সাইজের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোট হয়ে গেছে। তাই স্বপ্ন যদি ১৬০ টাকায় গরুর মাংসের কম্বো অফার দেয়, তাতে হাসাহাসির কী কারণ?
দেশের অনেক পরিবার গত কয়েক মাস যাবত ভয়াবহরকম খাদ্য অনিরাপত্তায় আছেন। খাদ্য অধিদপ্তর ও টিসিবির ন্যায্যমূল্যের দোকানে মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে একটি সমীক্ষায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ বা ২৬ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রার খাদ্যসংকটে ভুগছেন। আর ৩ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ চাপে আছেন। শুধু ৩ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন।
দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সুষম খাবার পাচ্ছে না। নিন্মমানের আজেবাজে খাবার গ্রহণ করে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করছে। অব্যাহত উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের খাদ্য পাওয়ার অধিকারকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। অসংখ্য মানুষের আয় ক্রমেই কমছে ও তাঁদের খাদ্যপণ্য কেনার খরচ বাড়ছে।
প্রতিবেদনে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের ভৌগোলিক অবস্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মানুষের বেশির ভাগ বাস করেন চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগে। দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন। জাতিসংঘসহ বাংলাদেশে কাজ করা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তার পর্যায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৭ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। ২০ বছর ধরে এই জরিপ করা হচ্ছে (সূত্র: প্রথম আলো)।
মনে করার কোনো কারণ নেই যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়ী করার জন্য এধরনের জরিপ চালানো হয়েছে। ২০২৩ সালেও দেশের ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছিল। সেইসময়ও সুলভ মূল্যে চালসহ টিসিবির পণ্য বিতরণ কার্যক্রমে পণ্য নিতে মানুষের ভিড় দেখা গিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে গত এপ্রিলে একই জরিপে দেশের ৩৩টি অঞ্চলের মধ্যে ২০টি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। মানুষের তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় বিশেষভাবে প্রভাব রেখেছে প্রতিকূল আবহাওয়া, বৈশ্বিক যুদ্ধ-সংঘাত ও উচ্চ মাত্রায় দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে ফুড সিকিউরিটি ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের (এফএসআইএন) প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২৪-এ এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু চাল নয়, বাড়ছে আলুর দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়, যা গত মাসের তুলনায় ২২.৩৩ শতাংশ ও গত বছরের তুলনায় ৪২.১১ শতাংশ বেশি। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে একসময় আলুই ছিল গরিবের ভরসার জায়গা। মধ্যবিত্তদের জন্যই এটা রীতিমতো বাড়তি চাপ, আর নিন্মবিত্তের কথা চিন্তা করারতো কোন অবকাশই নাই।
নতুন সরকারের সামনে যতো ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, এরমধ্যে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। কারণ সকাল থেকে রাত প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে। সরকারের উচিৎ দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম, বাজার সিন্ডিকেট ও কৃষি উপকরণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া। নতুন সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এতকিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে প্রায়োরিটির তালিকায় খাদ্য পরিস্থিতিকে খুব কম গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার পণ্য সরবরাহ ও খাদ্য বণ্টনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে না পারলে সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
চলতি বছর বেশ কয়েকটি দুর্যোগ হয়েছে দেশে। এসব দুর্যোগে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এদের বড় অংশই কৃষিজীবী। ফসল, গবাদি পশু, ঘেরের মাছ সব ভেসে গেছে। কৃষকের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মহীন সময় কেটেছে কৃষিজীবীদের। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে সহায়তা দেয়া হয়েছে খুব কম। কৃষিজীবীদের এই ঘাটতি পূরণে উদ্যোগ নিতেও দেখা যাচ্ছে না।
বাজার ব্যবস্থার সিন্ডিকেটকে আমরা ভাঙতে পারছি না এখনো। অন্যদিকে বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলনের সময় সবধরনের সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল। বিশেষ করে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম থেমে যাওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। খুব দ্রুত এইখাতগুলোকে চাঙ্গা করতে না পারলে অভাব-অনটন ও কর্মহীনতা আরো বাড়বে। পথের দু’পাশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এমনিতেই গত কয়েক মাস যাবত বিভিন্ন কারণে মানুষের আয় কমে গেছে এবং ব্যয় বেড়েছে।
টিসিবি’র গাড়ির চারপাশে নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, এটা অশনি সংকেত। সরকারের উচিৎ এই দৃশ্যপটকে গুরুত্ব দেয়া। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন সাধারণত বোরো মৌসুম শুরুর আগের দুই মাস দেশে চালের দাম বেশি থাকে। এ সময় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা বাড়াতে হয়। এবার নানা কারণে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। ফলে সরকারকে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সুষম খাবার পাচ্ছে না। নিন্মমানের আজেবাজে খাবার গ্রহণ করে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করছে। অব্যাহত উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের খাদ্য পাওয়ার অধিকারকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। অসংখ্য মানুষের আয় ক্রমেই কমছে ও তাঁদের খাদ্যপণ্য কেনার খরচ বাড়ছে। এফএসআইএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২২ সালে রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদন ও ২০২৩ সালে খাদ্যের সহজলভ্যতার উন্নতি হলেও বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ধাক্কায় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তিই থেকেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অব্যাহত খাদ্য মূল্যস্ফীতির উচ্চহার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর খাদ্যসুবিধা মারাত্মকভাবে ঝুঁকিগ্রস্ত করেছে।
অন্যদিকে দাম অপরিবর্তিত রাখার জন্য ব্যবসায়ীরা কিছু ভাল কৌশল বের করেছেন। মাস ছয়েক আগেও এক কেজি আলু আর এক কেজি আটা দিয়ে ২০-২৫টি সিঙ্গারা বানাতেন যে দোকানি, লাভের মুখ দেখার জন্য সমপরিমাণ কাঁচামাল দিয়ে ৩০-৩৫টি সিঙ্গারা বানাচ্ছেন তিনি। এটা শুধু সিঙ্গারার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য পুরি, সমুচা, আলুর চপ, কাটা ফল, চা, আখের রস, পিঠাসহ সকল ক্ষেত্রে। বছরখানেক ধরে দ্রব্যমূল্য এতটাই বেড়ে গেছে যে, সবাই এভাবেই ব্যালান্স করছেন। ক্রেতাও কিনতে পারছেন, ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না।
এই দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষক, শ্রমজীবী, ছোট চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ী। তারা যেখানে কেনাকাটা করেন, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেন এবং অবসরে বসে চা-সিঙ্গারা খেয়ে গল্পসল্প করেন সেরকম প্রতিটি স্থানেই সবকিছুর সাইজ ছোট হয়ে গেছে। মাছের বাজারেও ভাগ আছে, বড় মাছ বা ছোট মাছের ভাগ নয়। তাজা, কম তাজা ও মরা বা পঁচা মাছের ভাগ। ডিম, সবজি ও মুরগির বাজারেও একই কথা প্রযোজ্য।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মনে করে বাংলাদেশ কারো কাছে যাবে না, এমনকিছু করতে হবে যেন বিশ্ব বাংলাদেশের কাছে আসবে। সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এর আগে এমনকিছু করতে হবে যেন দেশের মানুষ পেট ভরে খেয়ে বাঁচে।
১২ নভেম্বর, ২০২৪
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম