সংখ্যায় লঘুতে আট মন্ত্রে শত প্রশ্ন
ধর্ম বা সংখ্যা দিয়ে লঘু-গুরু নির্ণয় নৈতিকতার সাথে না গেলেও চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিতও করে ফেলা হয়েছে। যাদের জন্য এটা অবমাননাকর তাদের মধ্যেও ধর্ম দিয়ে সংখ্যালঘু নামে পরিচিত হওয়ার বেশ প্রবণতা। তাদের একটি অংশ আট মন্ত্রে মাঠে নেমেছে ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ‘ নামে। মন্ত্র তথা দাবিগুলোর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার, সংখ্যালঘু কমিশন সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন এবং দুর্গাপূজায় পাঁচদিন ছুটি এর মধ্যে অন্যতম। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টও ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাসনালয় নির্মাণ ও হোস্টেলে প্রার্থনা রুম, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড আধুনিকায়নের দাবিও ছিল সেখানে।
কেন যুক্ত করে দাবিগুলো ছোড়া হয়েছে প্রশ্নের মতো করে। জানতে চাওয়া হয়েছে ১. হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে, সরকার নিশ্চুপ কেন?
২. রাষ্ট্রীয়ভাবে ৫৬০টি মডেল মসজিদ করা হয়েছে, একটি মন্দির বা গির্জা কেন করা হয়নি?
৩. ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অনেক হিন্দু যুবক জেল খাটছে। কিন্তু শত শত ফেসবুক প্রোফা্ইল এবং ওয়াজে সুস্পষ্টভাবে হিন্দুধর্মকে সমালোচনা ও কটূক্তি করা হয়েছে ও হচ্ছে। এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন?
৪. নিয়মিতভাবে প্রতিমা ভাঙা, মন্দিরে হামলা, দুর্গাপূজায় পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ হচ্ছে। এদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন?
৫. নতুন সরকারের কোনো দায়িত্বশীল উঁচু পদে যেমন সচিব, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিভিন্ন অধিদপ্তরের পরিচালক প্রভৃতি পদে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও কোনো হিন্দুকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না কেন?
প্রশ্ন-মন্ত্র-দাবি যেটাই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে এসব দফারফার ফের নিয়ে। আর পাল্টা প্রশ্ন তো আছেই। এ সময়টা বেছে নিলেন কেন? গত ১৫ বছর আওয়াজ না দিয়ে এখন কার কল্যাণে, কাকে ঘায়েল করতে মাঠে নামা? সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে? এসব দাবির বিষয়ে বিগত ১৫ বছর কী তৎপরতা ছিল? দাবিগুলো নিয়ে বর্তমান সরকারের সাথে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেছেন? বসেছেন কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে? শুরুতেই আলোচনায় না গিয়ে ঘটা করে সমাবেশ শোডাউন কোন উদ্দেশ্যে? অনুষ্ঠানে ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধি থাকলেও সরকারি প্রতিনিধি রাখার দরকার মনে করলেন না কেন?
তা দরকার মনে না করার কারণ থাকতেই পারে। ১৫ বছর এভাবে দাবি-বায়না নিয়ে নামেননি বলে এখন নামতে পারবেন না- এমন কথা নেই। এছাড়া তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মানা বা বিহীত করা অবশ্যই দরকার। প্রশ্নটা অন্যখানে। তারা কি আসলে দাবি আদায়ের জন্য নেমেছেন, নাকি বাজে রকমের পরিস্থিতি তৈরির মতলবে নেমেছেন? ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা এখন যত না ষড়যন্ত্র, তার চেয়ে বেশি রাজনীতি। পরাজিত বা বিতাড়িতদের এমন কিছু করা ছাড়া রাজনীতির আর কোনো ফাঁকফোঁকর থাকে না। গত শুক্রবার চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আট দফা দাবিনামা জানানোর সমাবেশটির নেপথ্যে সে ধরনের উদ্দেশ্য ধরা পড়েছে গোয়েন্দাদের চোখে। এরপরও সমাবেশটির আয়োজক, যোগদানকারী বা জ্বালাময়ী বক্তাদের কাউকে সরকারের দিক থেকে শাসন-বারণ করার তথ্য নেই। সমাবেশে বাধা দেওয়া হয়নি। সমাবেশের পরও কাউকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য নেই। এটি অবশ্যই সরকারের এক ধরনের উদারতা।
আট দফা দাবি তোলা সমাবেশটি সাধু সন্তদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণাও দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে। সমাবেশের প্রধান বক্তা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী গণমাধ্যমকে বলেন, তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এ অধিকার তাদের অবশ্যই রয়েছে। আগেও ছিল। কিন্তু, তখন অধিকার চর্চা করেননি কেন? সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে? গত দেড় দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বেশ কিছু ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দৃষ্টি কেড়েছিল। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী নয় বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাড়ে তিন হাজারের বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার মধ্যে হিন্দুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ অন্যতম।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী স্বীকার করেছেন একটি ঘটনায়ও কোনো ব্যক্তিকে বিচার শেষ করে শাস্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু, তা বলেছেন আলাদা করে। সমাবেশে বলেননি। এরপরও তো বলেছেন। বলতে শুরু করেছেন। সরকারের খুঁত ধরছেন। সরকার ঘোষিত ছয়টি কমিশনে সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেই কেন সেই প্রশ্নও তুলেছেন। বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী কথা বলতে পারার স্বাধীনতার এ সুযোগে শিবির সন্দেহে বিশ্বজিৎ হত্যাসহ আওয়ামী লীগ আমলে কত হাজার হিন্দু সনাতনীদের ওপর নির্যাতনের কথা মুখে আনতে পারেন। বিচারপতি এস কে সিনহাকে মেরেধরে দেশছাড়া করার বিচার চাইতে পারেন। আইজিপি থাকাকালে বেনজীর আহমেদের গোপালগঞ্জে হিন্দুদের শত শত বিঘা জমি দখল করায় কষ্ট পেয়েছেন কি না তাও জানাতে পারেন। তা না করে এখন পরিবেশের সুযোগে সভা-সমাবেশ বা কথার যত তোড়ই ছড়ান, মানুষ তা অন্যভাবে নেবে। কারও এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে হাঁটলে দেশের ১৮ কোটি মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
এইচআর/এএসএম/ফারুক