ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ধর্ষণ

শিশুটি হয়তো হাসপাতালে পৃথক শয্যা পেয়েছে কিন্তু তারপর?

শাহানা হুদা রঞ্জনা | প্রকাশিত: ০৮:৪৪ এএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

ধর্ষণের শিকার ৯ বছরের শিশুটি হাসপাতালে পৃথক শয্যা পেয়েছে, আমাদের কাছে এখন এটিই একটি স্বস্তির সংবাদ। কিন্তু মেয়েটির সামনের দিনগুলো কতটা দুঃসহভাবে কাটবে, সেটা কি আমাদের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব? মেয়েশিশুটি আজকে হাসপাতালে পৃথক শয্যা পেলেও এই সমাজে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠা কতটা সম্ভব হবে ওর পক্ষে?

যে শারীরিক ও মানসিক ট্রমা নিয়ে সে বেড়ে উঠবে, তা হবে ভয়ংকর। সমাজে বুলির শিকার না হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে সাপোর্ট দরকার, সেটা নিশ্চিত করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে মেয়েটির পরিবারের পক্ষে। দরিদ্র পরিবারের এই মেয়েটিকে বড় হতে হতে অন্তত হাজারবার শুনতে হবে, তাকে কিভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে, সে কতটা পরিত্যক্ত ও কিভাবে একজন ঘৃণিত মানুষ। শিশুকালের এই ভয়াবহ ঘটনার জন্য সমাজ তাকেই দায়ী করবে, বড় হতে দেবে না, নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং একসময় মেয়েটি পালাতে বাধ্য হবে।

পত্রিকায় লেখালেখির পর ধর্ষণের শিকার শিশুটির জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আলাদা শয্যার (পেয়িং বেড) ব্যবস্থা করেছে। মেয়েটি একটা বিছানায় আরেক শিশু রোগীর সঙ্গে থাকতো। সেখানে পা সোজা করার উপায় ছিল না তার। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, ধর্ষণে শিশুটির মাসিক ও মল ত্যাগের রাস্তা এক হয়ে গেছে। পেশাব-পায়খানা সবকিছু করতে হচ্ছে নলের সাহায্যে। শিশুটির প্রজনন অঙ্গে অস্ত্রোপচার করে তা পুনর্গঠন করা হবে। ভবিষ্যতে মেয়েটি কী কী শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এরমানে দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হবে। মেয়েটি কার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তা বলতে পারছে না। ধর্ষণকারীকে সে চেনেও না। ফলে এই অপরাধীকে খুঁজে বের করা বেশ কঠিন হবে। আদৌ হয়তো খুঁজে বের করা যাবেও না। (সূত্র: প্রথম আলো)

প্রায় একই সাথে খবরে দেখলাম নোয়াখালীর দুর্গম চরে মা ও মেয়েকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। এইসময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছে সাত বছরের এক মেয়েশিশু। সেও ধর্ষণের শিকার। এগুলো শুধু এমনকিছু ঘটনা, যা সংবাদ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। দেশের অসংখ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিতই হয় না।

ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা সমাজে বাড়ছে। কেন বাড়ছে এর কোনো সদুত্তর নেই। কারণ রাষ্ট্র, সমাজ, আইন-শৃংখলা বাহিনী, মানবাধিকার সংগঠন ধর্ষণ ইস্যুকে তেমনভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মনে করে না। বছরের পর বছর ধরে নানা পর্যায়ে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন আছে কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি নিয়ন্ত্রণ বা কমানো যাচ্ছে না। ধর্ষণের শিকার হয়ে ৯ বছরের মেয়েটির মতো কেউ যখন আবার হাসপাতালে ভর্তি হবে, তখন তাকে নিয়ে নিউজ হবে, আমরা ভয়ে কেঁপে উঠবো, দুইদিন আলোচনা হবে কিন্তু কোনো সুরাহা হবে না, সুরাহা হয়ও না।

বিগত সরকারের আমলে যিনি শিশু ও নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, সেই বেগম ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা ম্যাডামকে কেউ কখনো কোন স্পটে দেখতে পায়নি। এখনো অবস্থা সেরকমই, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। শিশু ও মহিলা মন্ত্রণালয়ের এই অবহেলিত অবস্থানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, নারী ও শিশু নির্যাতনের কোনো মূল্য নেই আমাদের কাছে। এমনকি নারী অধিকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সেইভাবে অ্যাকটিভ নয়, বরং চুপচাপই বলা যায়। সাক্ষীর অভাব, ভিকটিমের পরিবারের দারিদ্র্য, সামাজিক লজ্জা, ভয়-ভীতি, ধর্ষকের পলিটিক্যাল পরিচয় এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একসময় ধর্ষণ মামলা মুখ থুবড়ে পড়ে। বিচার ও শাস্তি ছাড়াই আসামী পার পেয়ে যায়।

শিশু নির্যাতনের সংবাদে আমরা এমনই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি যে বছরের পর বছর প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন একটি গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মহানগরে যত শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, এর প্রায় ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। এরপরেও আমরা সবকিছু মেনে নেই। এভাবে মেনে নিতে নিতে কোন একদিন এই আগুন আমাদের ঘরও জ্বালিয়ে দেবে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫২১ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৬৩ জন, আর ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১২২ জন। ৩২৯ টি শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ৮৮ জন গণধর্ষণের শিকার। মারা গেছে ২২ জন। ৮৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৭ জন। স্বামী হত্যা করেছে ১২৯ জনকে। পারিবারিক সহিংসতার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২৬ জন (সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র)। আমার মনে হয় ধর্ষণ ও নারীকে হত্যার সার্বিক চিত্র বোঝার জন্য আরও অনেক তথ্য প্রমাণাদির দরকার নাই। বছরের পর বছর এইসব তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে কিন্তু এই অপরাধ থামছে না। গৃহে, স্কুলে, পাড়ায়-মহল্লায়, আত্মীয়-বন্ধুর বাসায়, পথে, গণপরিবহনে কোথাও নারী নিরাপদ নয়।

গ্রামেগঞ্জে ধর্ষণকারীর সবচেয়ে কঠিনতম শাস্তি কি জানেন? যে মেয়েটিকে সে ধর্ষণ করেছে, সালিশের মাধ্যমে তাকেই বিয়ে করা। এতে ধর্ষণকারী জেলখাটার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হলে, সবাই মনে করে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিরও একটা হিল্লা হলো। অথচ বাস্তব অবস্থা অনেক কঠিন। বছরখানেক আগে পরিচালিত একটি মামলায় দেখা গেল ধর্ষণের শিকার হয়ে ১৪ বছরের একটি শিশু সন্তান জন্মদান করেছে। এই কিশোরী মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় অসম্মান। শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হয়েছে, এরপর মা হয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে এবং এখন তাকে দাঁড় করানো হয়েছে তারই ধর্ষককে বিয়ে করার জন্য। কী অদ্ভুত এ সমাজ। এই মামলার আসামি পাড়ার বয়স্ক এক দোকানদার, যার পরিবারে স্ত্রী ও সন্তান আছে। দুই বছর ধরে সে কারাগারে। এ অবস্থায় দুই পক্ষই চাইছে বিয়ের মাধ্যমে একটি আপস রফায় আসতে। মেয়ের পরিবার চাইছে, মেয়েটিকে একজনের হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে, আর অপরাধী চাইছে বিয়ে করে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে।

যারা শিশু ও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা সবসময় প্রান্তিক মানুষকে এই বলে সচেতন করার চেষ্টা করেন যে ধর্ষণের ঘটনায় কোনো সালিস হয় না। অথচ দেখতে পারছি, সালিসতো হয়ই, বরং ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনাও বিচারিক আদালতে উঠে আসছে। আইনজীবী শারমিন আক্তার গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের আইনে কিছু অপরাধ আছে, যেগুলোর কোনো আপস-মীমাংসার সুযোগ নেই। ধর্ষণের ঘটনা তেমনি একটা, যেখানে কোনো আপসের সুযোগ নেই। কিন্তু ২০২০ সালে ফেনীতে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক এক ব্যক্তি, ওই কিশোরীকে বিয়ে করতে চাইলে আদালত তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত দেন এবং পরে ওই লোকের জামিনও হয়ে যায়।

যেখানে বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনায় কোনো আপস-মীমাংসার প্রশ্নই আসে না, সেখানে এ রকম মামলা ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ওঠে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে শুধু শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যই অপরাধী বিয়েকে ‘অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’ করে থাকে। আমাদের সমাজে ধর্ষণ মামলার আপস-মীমাংসার নামে যেটা হয়, সেটা হলো বিভিন্ন মহল থেকে নানা চাপ দেওয়া ও টাকার লোভ দেখিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার একটি উপায় বের করা। সে ক্ষেত্রে বিয়ের প্রস্তাবটাও একধরনের প্রলোভন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী শিশু-নারী ধর্ষণের বিচার পান না, উপরন্তু অপরাধীর সঙ্গে আপোষ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার ভাবেন, বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির একটি হিল্লে হবে বা সমাজে মুখ দেখানোর একটা ব্যবস্থা হবে। তা না হলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। মেয়েটিকে ভবিষ্যতে কে বিয়ে করবে? অথচ এর মাধ্যমে সমাজে একটা ভুল বার্তা যায়, যারা ধর্ষক, তারা মনে করে, আমি যাকে ধর্ষণ করলাম, তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে গেলাম। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের জন্য যে বিচার ও শাস্তি যা, তা তাকে আর পেতে হয় না, মামলার কোনো ফলোআপ থাকে না।

শিশু নির্যাতনের সংবাদে আমরা এমনই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি যে বছরের পর বছর প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন একটি গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মহানগরে যত শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, এর প্রায় ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। এরপরেও আমরা সবকিছু মেনে নেই। এভাবে মেনে নিতে নিতে কোন একদিন এই আগুন আমাদের ঘরও জ্বালিয়ে দেবে।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম