ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের প্রসার ও আমাদের ‘থ্রি-জিরো’ ভাবনা

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা খুবই সরব হয়ে উঠেছে। অক্টোবরের ২ তারিখে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ১৮০টি সুপারসনিক মিসাইল হামলার পর হিজবুল্লাহ ২ ঘন্টার ব্যবধানে ২০০টিরও বেশি রকেট হামলা চালিয়েছে অক্টোবর ৩ তারিখে। ইসরাইলের একগুঁয়েমী মনোভাবের কারণ তার পেছনের মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তির সমর্থন। কিন্তু লেবাননে একটানা হামলা চালানোর পর গোটা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন চেতনা জেগে উঠেছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর বোমা বর্ষণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নড়বড়ে অবস্থান নতুনভাবে জেগে উঠে ঐক্য গড়ে উঠেছে।

ইরানের রেভ্যুলুশনারী গার্ডস্-এর পরামর্শে বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট জোটগুলো একই নির্দেশনায় কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। ফিলিস্তিনের হামাস, ইরাক ও ইরানের শিয়া মিলিশিয়া, ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সবার লক্ষ্য এখন ইসরাইলের আগ্রাসনকে প্রতিরোধের জন্য একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাধ্যমে শত্রু দমানো। সৌদি যুবরাজ সালমান এই প্রথম লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর ইসরাইলী বাহিনীর শতাধিকবার বোমা বর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন। সম্মিলিত আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ইসরাইলী বাহিনী।

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরাইলের অভ্যন্তরে সাসা শহরে ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ সংগঠন ইসরাইলী বাহিনীর স্থল আক্রমণ প্রতিহত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা সন্মুখ যুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধে তৈরি করে তিনটি ট্যাংক ধ্বংস করেছে এবং ৮ জন ইসরাইলী সৈন্যকে হত্যা করেছে।

ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথি দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের তেল আবিবেও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। শত্রুপক্ষ এসব ড্রোন প্রতিহত করতে পারেনি ভূপাতিত করতে পারেনি। হুথিরা ইসরায়েলে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন। গত নভেম্বর থেকে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে বিভিন্ন জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরায়েল। এরমধ্যে হামাসের যোদ্ধা, কর্মকর্তা ছাড়াও হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ রয়েছেন। যুদ্ধের শুরুতে ইসরায়েল জানিয়েছিল, গাজা থেকে হামাসকে তারা পুরোপুরি নির্মূল করে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত দখলদার ইসরায়েল তাদের এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

২০২৪ সালের অক্টোবরের শুরুতে লেবাননে আক্রমণের পর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এ উপত্যকার শাসক গোষ্ঠী হামাস সরকারের প্রধান রাহী মুস্তাহাসহ আরও দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে দখলদার ইসরায়েল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরাইলের আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সকল বৈরী দেশগুলোর উপর একইসংগে চালানো হচ্ছে।

সাথে মার্কিনীরা নির্লজ্জের মতো ইসরাইলী বাহিনীকে গোলাবারুদ, রসদ যোগাচ্ছে। ইরানকে তারা প্রত্যক্ষভাকে হুমকি দিরেও ইরান সেটারে পাল্টা জবাব হুমকির মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে দেরী করছে না। হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের এক কমান্ডারকে হত্যার জবাব দিতে মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলে একসঙ্গে ১৮০টি মিসাইল ছোড়ে ইরান।

এই মিসাইল হামলার পর ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ‘ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ছক কষছে দখলদার ইসরায়েল। মূলত হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর ইসরায়েলি সরকারের একটি ধারণা তৈরি হয়েছে তারা এখন ভালো অবস্থানে আছে এবং চাইলে ইরানের ধর্মীয় নেতাকেও হত্যা করতে পারবে।’ আর এমন খবর প্রকাশের পরই নেতানিয়াহুকে ইরানের ‘হিট লিস্টে’রাখার তথ্য প্রকাশিত হলো।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি তালিকায় ইরান ‘হত্যা করতে’ চায় এমন ব্যক্তিদের নাম বের রয়েছে। এই ‘হিট লিস্টে’ নাম আছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ তিন বাহিনীর প্রধানের। এছাড়া ইরানের হিট লিস্টে আছে দখলদার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও। ইরানের গোয়েন্দারা বলেন, নেতানিয়াহু না হলেও দখলদার ইসরায়েলের বড় নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলীদের দোসররা চুপ করে থাকলেও কাতার, জর্ডান, তুরস্ক, মিশর ইত্যাদি দেশের সাথে রাশিয়া ও চীনের সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে এখনও সাড়া পাওয়া যায়নি। লেবাননে শত শত প্রাণ হারানোর পরও আমেরিকা বিরোধী ব্লক চুপ করে থাকার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশে যুদ্ধ দ্রুত ছাড়িয়ে পড়ছে।

ইসরায়েলের পারমাণবিক হুমকির জবাবে ইরান অনমনীয়। তবে কি মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ অত্যাসন্ন? নাকি তার প্রভাবে আমাদের দেশে ‘থ্রি-জিরো’দূরীকরণের আশায় গুড়েবালি পড়বে তা নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে। সেজন্য আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে দেশজ উপায়ে ‘থ্রি-জিরো’যুদ্ধের মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে আজকেই ভাবা উচিত।

ক্রমাগত হুমকি ও পাল্টা হুমকির মুখে সামনের দিনগুলিতে কি ঘটতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে? মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরান-ইসরায়েল পরিস্থিতির দিকে। ইরানের হামলার জবাবে ইসরায়েলের পদক্ষেপ কী হবে সেটি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। অপরদিকে ‘দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কাও করছেন অনেকে। কারণ সক্ষমতার দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায় দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে।’

তবে দুটি দেশই বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪ আর ইসরায়েলের অবস্থান ১৭। কিন্তু শক্তির ভারসাম্য যতই কাছাকাছি হোক না কেন, একবার ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে শক্তির ক্ষয়সাধন কয়েক মিনিট বা ঘন্টার ব্যাপার মাত্র।

অনেকের কাছে পারমানবিক বোমা থাকায় নিশপিশ করছে অনেক ভয়ংকর অবিবেচকের কালো হাত। মানবতার নৃশংস বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য আরো অনেক নেতানিয়াহুরা এক অপরের সংগে প্রতিনিয়ত যোগসাজশ করে যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়িয়ে তাদের ঘৃণ্য অস্ত্র ব্যবসাকে শান দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মার্কিনীরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাশিয়াও বা বাদ যাবে কীভাবে?

জো বাইডেন বলেছেন, তার দেশ ইসরাইলের পারমাণবিক মক্তি ব্যবহারকে সমর্থন করবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে যে ভয়ানক শক্তি ব্যবহার করার জন্য ইসরাইলে উস্কে দিয়েছে তা কি কোনভাবে ক্ষমার যোগ্য বলে মনে হয়?

এসব যুদ্ধ অপরাধকে কেউই আমলে নিচ্ছেন না। অস্ত্র ব্যবসার প্রয়োজনে এত ভয়ংকর বিষয়কে ওরা সদর্পে অগ্রাহ্য করেই যাচ্ছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘ মহাসচিবকে ‘পারসনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করা হয়েছে এবং তিনি ইসরায়েলে প্রবেশ করতে পারবেন না। গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে কারণ তিনি ইরানের মিসাইল হামলার নিন্দা জানাননি। অথচ, ক্ষমতাধর দেশগুলো এব্যাপারে হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। এটা চরম অপমানজনক ঘটনা।

একজন বৃটিশ অভিনেত্রী ইতোমধ্যে বলে ফেলেছেন, এটা বড় যুদ্ধাপরাধ। ‘বৃটিশ অভিনেত্রী জুলিয়েট স্টিভেনসন ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যে বোমাগুলো ৯০ জনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল, সেগুলো এফ-৩৫ বিমান থেকে ছোড়া হয়েছিল। বিমানটির যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের তৈরি।’ কিন্তু এসব শুনে মানবতার শত্রুদের কার কি আসে যায়?

বিশ্ববাসীর ঘৃণা উপেক্ষা করে ইসরাইলী বর্বরদেরকে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমদের উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্বিচারে হত্যা করার রসদ যুগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমারা। যুদ্ধ আরেকটু ব্যাপৃত হলে এর ঢেউ উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশেও রেগে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে।

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে সবখানে। তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের পাঠানো অর্থনির্ভর আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে। ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী আমাদের দেশে রেমিটেন্স আসার প্রধান উৎস সংযুক্ত আরব আমীরাত, সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ থেকে আসা রেমিটেন্স কমে গেলে বা বন্ধ হলে আমাদের বাজেট ফেল করতে থাকবে।

ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়ের মতো মধ্যপ্রাচ্য থেকে চাকুরীহারা শ্রমিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরতে শুরু করলে আমাদের দেশের আর্থ-সামজিক অবস্থা করুণ হয়ে ‘থ্রি-জিরো’ যুদ্ধে জয়লাভের আশা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে তা এখনই অনুমান করা বেশ কঠিন। সম্প্রতি অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রণীত 'থ্রি জিরো'-তথা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ আরো বিপজ্জক হয়ে উঠলে সেখানকার শ্রমিকদের দেশে ফেরত আসা শুরু হলে আমাদের জিরো দারিদ্র্য ও জিরো বেকারত্ব ধারণা বাস্তবায়ন খুব কঠিন হতে পারে।

বর্তমান এআই যুগে পৃথিবী যখন এগিয়ে গেছে বহুদূর তখনও আমরা লোভী নেতাদের হীন কর্মকান্ডের খেসারত দিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। প্রায় তিনশ’কোটি নিম্নআয়ের মানুষ ও তাদের রিলেটিভ ও আলট্রা দারিদ্র্য নিয়ে আমরা এখন নতুন যুদ্ধ শুরু করতে বদ্ধপরিকর। আমরা ‘থ্রি-জিরো’ মোকাবেলা নিয়ে নতুন ভাবনা বাস্তবায়ন করতে চাই।

ইসরায়েলের পারমাণবিক হুমকির জবাবে ইরান অনমনীয়। তবে কি মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ অত্যাসন্ন? নাকি তার প্রভাবে আমাদের দেশে ‘থ্রি-জিরো’দূরীকরণের আশায় গুড়েবালি পড়বে তা নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে। সেজন্য আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে দেশজ উপায়ে ‘থ্রি-জিরো’যুদ্ধের মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে আজকেই ভাবা উচিত।

এর সাথে আরো ভাবি ক্রমাগত পারমাণবিক হুমকি রুখে দিয়ে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য আসুক ও আরেকটি অনাগত বিশ্বযুদ্ধ ভাবনা ও মানবতার প্রাণহরণ বৈষম্যের অবসান হোক।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। [email protected]

এইচআর/জেআইএম