সংস্কারের তরজমা বরবাদ নয় প্লিজ ...
মাত্র ৩৪ দিনে সফল বিপ্লব। এখন ৩৪টা দিনও তর সইছে না। আবার ১৫ বছর ৭ মাসের যন্ত্রণারও যাবতীয় অবসান-উপশমও এই ৩৪ দিনে সারানোর চাপ। দাবি আর দাবি। চাই আর চাই। দিতে হবে দিয়ে দাও। মানুষের চাহিদা-আকাঙ্খা অফুরান সত্য। দাবিও বিস্তর। হোক বন্যা-দুর্যোগসহ আরো নানান দুর্গতি। দাবিতে কোনো ছাড় নেই। নগদে সবার সব দাবি এখনই পূরণ করতে হবে। মানতে হবে। নইলে আদায় করে ছাড়া হবে। এ অবস্থা কারা করেছে, তা সবারই জানা। দাবিদাররা এতোদিন কোথায় ছিলেন, কেন তারা দাবি নিয়ে এভাবে সোচ্চার হননি বা হতে পারেননি-তাও জানার বাইরে নয়। ১৫ বছর ঘুমে নয়, সজাগই ছিলেন তারা। এখন মন ভরে আওয়াজ দিতে পারছেন। এটিও একটি সংস্কার।
ঘটনা অনেকটা এমন: খুন-খারাবি, চুরি-পাচার করে গেছেন একজন এখন নগদে সে সবের দায় শোধ করতে হবে আরেকজনকে। বিপ্লবের পর কিছুটা এমন হয়-তাও সত্য। কিন্তু, আমাদের এখানে একটু বেশির চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে গত ক’দিন ধরে। সংস্কার শব্দটির সর্বনাশও চূড়ান্তে নিয়ে যাচ্ছে মহল বিশেষ। প্রতিপক্ষকে বিচারের আগে বিচার করে ফেলার কয়েকটি ঘটনা বিবেকবানদের আহত করেছে। কিছু গুজবও মাঠের আবহ নষ্ট করেছে। কিন্তু, সংস্কারের নামে যৌনকর্মীর ওপর হামলা, মাজার ভাঙ্গার মতো নোংরা ঘটনার দায় কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সংস্কারের আয়োজকদের ওপরই বর্তাচ্ছে।
সেইসঙ্গে সংস্কার শব্দটির সাড়ে সর্বনাশ তো করছেই। আর মব তৈরি করে মানুষ পেটানো যাবতীয় পরিস্থিতিকেই গোলমেলে করে দিয়েছে। মানুষই না বাঁচলে সংস্কার ধুয়ে পানি খাবে কে? এ দেশের জনগণের মধ্যে আবহাওয়ার মতো হঠাৎ পাল্টে যাওয়ার একটি মানসিকতা কিন্তু আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যাচ্ছে তাই করার পরিণতি কী হয়েছে তা এখনও ইতিহাস হয়ে যায়নি। দগদগে ঘায়ের মতো তা বর্তমান হয়ে আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি বেশি হচ্ছে সত্য, ভুল-ত্রুটিও বলা যাচ্ছে। তারওপর গণমাধ্যমকে সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে বলেছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা। বিগত ১৫ বছরে ৭ মাসের সঙ্গে তুলনা করলে এটি অনেকের ভাবনারও বাইরে। এ ছাড়া এবার এখন পর্যন্ত সরকারি প্রযোজনায় কোনো কিংস পার্টির জন্ম বা আমদানি নেই- তাও একটি ঘটনা। সেখান থেকে অন্তত এ আশা করাই যায়, এই শাসকরা কৌশলে কাউকে চিন্তা-চেতনায় দাসে পরিণত করবে না।
মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে বাস্তবে উল্টা যতো কাজ করেছে। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ভোগ-দখলে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থেকেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দুঃশাসন টিকিয়ে রাখতে কী না করেছেন! একবার হাজি সেজেছেন। কওমি জননীও সেজেছেন। মদিনা সনদে দেশ চালানোর অঙ্গীকারও করেন, ঘোষণা দেন যে দাড়ি-টুপিধারীর সংখ্যা আওয়ামী লীগেই বেশি। হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেন হিন্দু লেখকদের রচনা। আর মানুষের মুক্তচিন্তার অধিকার কেড়ে নেবার জন্য তৈরি করেন একের পর এক কালো আইন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গী হবার কারণে কয়েকটি বাম দলের নেতা এখন দেশবাসীর ঘৃণার পাত্র। যদিও সিপিবি-বাসদসহ বামমোর্চা শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় সোচ্চার ছিল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় ছিল। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের ছয়জন নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। সেনা মোতায়েনের পর প্রথম কারফিউ ভেঙেছেন উদীচীর নেতৃত্বে সংস্কৃতিকর্মীরা। আবার বিএনপিও শান্তিতে নেই। তাদের চাহিদার ফর্দ বড় লম্বা।
বিএনপির একটি অংশের জোর আশঙ্কা- তাদের হয়তো ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না। প্রোইসলামিস্টদের ক্ষমতায় আনতে হলে বিএনপিকে হারাতে হবে। তাদের বিপক্ষে আছে অতীত ইতিহাস আর বর্তমানের অশিক্ষিত লোভী পাতিনেতাদের দখলদারি ও চাঁদাবাজির চাক্ষুস প্রমাণ। এর বিপরীতে জামায়াত অতিমাত্রায় আশাবাদী। তাদের বিরুদ্ধে দখলবাজি-গুণ্ডামির অভিযোগ নেই। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় সত্যিকারের প্রগতিশীলদের মাঝে প্রাপ্তির কিছু আশা জেগেছে। প্রগতিশীল মহল্লায় থেকেও এক পা আওয়ামী লীগে দিয়ে রাখা কমরেডদের মধ্যে আপাতত বসে পড়া ছাড়া পথ নেই। হুট করে জিন্দাবাদের সিন্দাবাদ দিতে গেলে বিপদ হবে। নমুনা বুঝে সত্যিকারের প্রগতিশীল হবার একটা চেষ্টা করছেন তাদের কেউ কেউ।
এবারের আন্দোলনটির সাথে বিগত আন্দোলন-অভ্যুত্থান-বিপ্লবের তুলনা হয় না। এবার ধরনটাই আলাদা। আফটার শকও ব্যতিক্রম। এ অঞ্চলে তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভ রচনা করেছিলেন ছাত্ররা । স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়।
এসব আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ছাত্ররা দিলেও ফলাফল হাইজ্যাক করে নিয়েছে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে জগদ্দল পাথরের মতো সাড়ে পনেরো বছর আসন গাড়েন শেখ হাসিনা। তাকে উৎখাত করতে এদেশের সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। তাই ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হয়েছে, বিপ্লব করতে হয়েছে। সফলও হয়েছে ধারণাতীতভাবে। তাই বলে দেশ স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদ মুক্ত হয়ে গেছে?
আসলে স্বৈরাচার যতো না ব্যক্তি; তার চেয়ে বেশি পদ্ধতি বা ব্যবস্থা। স্বৈরাচার তৈরির সব জানালা খোলা রেখে খানা-খাদ্য বহাল রেখে দরজা বন্ধ করলে কোন ফজিলত আসবে? শাসক আর শাসন ভিন্ন কথা। স্বৈর শাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসন খতম হয়ে যায় না- এ দেশের জন্য কথাটা বেশি প্রযোজ্য। সমাজের মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে এই মজাদার শাসনের কায়া ও ছায়া বসত বাঁধে।
স্বৈরশাসক বিদায় নিলেও রেখে যায় ধ্বংস করা রাষ্ট্রীয় কাঠামো, দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং বিকৃত প্রশাসন। দীর্ঘ সময় স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকা নাগরিকদের মানসিকতায়ও বিকৃতি দেখা দেয়। তারা জ্বি হুজুরে নগদ কিছু প্রাপ্তিতে সুখ-সম্ভোগ খোঁজে। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। মনোজগতে তাই বেশিরভাগ মানুষই স্বৈরাচার। এই শ্রেণির প্রতিটিা ব্যক্তি চায় তার কথা সবাই শুনুক। তাকে তোয়াজ করুক। আর তার সব কিছুতে ঠিক ঠিক বলুক। একটু ভিন্ন কথা বললেই তারা মনক্ষুণ্ণ হন।
স্বৈরশাসকরা গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে শত্রুতে রূপান্তর করে। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে আলোচনার সুযোগ থাকে, মতের ভিন্নতা থাকলেও একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমঝোতার পথ খোলা থাকে। কিন্তু শত্রুর ক্ষেত্রে, শাসকের উদ্দেশ্য থাকে তাকে দমন করা, নিঃশেষ করা। এই শত্রুতা তৈরির মাধ্যমে শাসক তার শক্তি ও ক্ষমতা আরও দৃঢ় করে তোলে। সহযোগীতেও সন্তুষ্ট হয় না স্বৈরাচার । তারা চায় একান্ত বাধ্যগত অনুগামী, যারা বিনা প্রশ্নে তাদের সব আদেশ মানবে। অন্ধের মতো মেনে চলবে।
এবার কিন্তু একটু হলেও আমরা ভিন্নতা দেখছি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি বেশি হচ্ছে সত্য, ভুল-ত্রুটিও বলা যাচ্ছে। তারওপর গণমাধ্যমকে সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে বলেছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা। বিগত ১৫ বছরে ৭ মাসের সঙ্গে তুলনা করলে এটি অনেকের ভাবনারও বাইরে। এ ছাড়া এবার এখন পর্যন্ত সরকারি প্রযোজনায় কোনো কিংস পার্টির জন্ম বা আমদানি নেই- তাও একটি ঘটনা। সেখান থেকে অন্তত এ আশা করাই যায়, এই শাসকরা কৌশলে কাউকে চিন্তা-চেতনায় দাসে পরিণত করবে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
এইচআর/এএসএম