ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সীমান্তে হত্যা ও আতঙ্ক বন্ধ হোক

ড. মো.শফিকুল ইসলাম | প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

২০২২ সালের আগস্ট বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি উপজেলার তুমব্রুবাজার এলাকায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশের প্রায় আধা কিলোমিটার ভেতরে ঘুনধুম সীমান্তে পড়ে। উভয় মর্টার শেল অবিস্ফোরিত পাওয়া গেছে,তাই এই ঘটনায় কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি,তবে স্থানীয় লোকজন আতঙ্কিত ছিল। ঐ ঘটনার পর সীমান্তে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিল।

বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে ছিল কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃক সীমান্তে বাড়াবাড়ি থামায় নি। কারণ এরপর ঐ বছর ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর নয়টি মর্টারের গোলা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তের পড়েছিল। যা নিয়ে পুরো বাংলাদেশ আতঙ্কে ছিল। ওই এলাকার মানুষ খুবই আতঙ্কে ছিল। যদিও এখন মিয়ানমার সরকার বলেছিল এগুলো তাদেও ইচ্ছাকৃত নয়। ঘুমধুম সীমান্তসহ আশপাশের এলাকায় এই পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমার এবার আরাকান আর্মিও পাশাপাশি রাখাইনের সশস্ত্র সংগঠন আরসার ওপর দায় চাপিয়ে ছিল। কিন্তু এই ধরনের সীমান্তে উস্কানি কোনোভাবেই সহ্য করা যাবে না। এর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান রাখতে হবে। যদিও পড়ে এটি নিয়ে তেমন কোনো উত্তেজনা দেখা যায়নি।

তবে আমাদের সীমান্তে মানুষ হত্যা চলছে। যা খুবই দুঃখজনক। ভারত আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশ। কিন্তু তাঁদের বাহিনী কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়। দুই বন্ধু প্রতিম দেশের উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা যথাযথ কার্যকর হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সিপাহীর মৃত্যুর ঘটনায় যশোরের বেনাপোল সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। আতঙ্কের মধ্যে ছিল সীমান্তবাসী। ঘটনা ঘটলে পতাকা বৈঠক হয়,কিন্তু হত্যা কাণ্ডের তদন্ত করে সঠিক বিচার কখনও হয়নি। এমনি কি আমরা বিচারও দাবি করছি কিনা তা নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে সমাজে।

সম্প্রতি ১ সেপ্টেম্বর মায়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় থাকা ভাইকে দেখতে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহত হয়। যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। যা মনে করিয়ে দেয় সেই ফেলানী হত্যাকে। ফেলানী হত্যার কাহিনী শুনলে আজও গা শিউড়ে উঠে।

অতীতে আমাদের ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ সীমান্তের কাটাতারে ঝুলে থাকার ছবি বিশ্ববাসীকে নাড়া দিলেও সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে সীমান্তে ভারতের বিএসএফ কর্তৃক ২৪৫ জন মানুষ হত্যা করা হয়। কিন্তু একটি হত্যাকাণ্ডেরও সুস্থ তদন্ত এবং বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ভারতের আন্তরিকতার ঘাটতি সীমান্ত হত্যার জন্য দায়ী মনে করছেন কেউ কেউ। এমনকি এ ধরনের সীমান্ত হত্যাকান্ড বন্ধে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতি দেন। তারপরও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। তাহলে সদিচ্ছার কোনো অভাব আছে কি? কিন্তু দুই দেশেই আইন আছে,তবুও সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে; যা মানবাধিকার লঙ্ঘন। আসলে ভারত কি আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র? না তারা আমাদেরকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে? এটা সাধারণ মানুষের প্রশ্ন।

যদি কেউ সীমান্তে অবৈধ কাজ করে থাকে, তাহলে দুই দেশের সীমান্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করা এবং হাঁটুর নিচে গুলি করা যেতে পারে। ফলে মানুষ মারা যাবে না। অর্থাৎ অবৈধ কাজের সাথে যারা জড়িত তাঁদের কঠোর বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের আওতায় না এনে তো একটা মানুষকে এভাবে মারা ঠিক হবে না। এসব বিচার বহির্ভূত হত্যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।

সম্প্রতি বেনাপোল যে ঘটনা ঘটল-ভারত থেকে আসা একদল গরু চোরাকারবারির সীমান্ত অতিক্রম করে আসতে দেখলে দায়িত্বরত বিজিবি টহল দল তাদের চ্যালেঞ্জ করে। তারা দৌড়ে ভারতের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিজিবি টহল দলের সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ রইশুদ্দীন চোরাকারবারিদের ধাওয়া করতে করতে ঘন কুয়াশার কারণে দল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

তারপর তিনি মারা যান ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে। কিন্তু চোরাকারবারিদের কেউ আহত হল না,বরং আমাদের একজন সৈনিক মারা গেল। তাঁর শরীরে সরকারি পোশাকও ত ছিল, সেটা দেখেও তাঁকে গুলি মারা ঠিক হয়নি। তবে বেনাপোলের স্থানীয় লোকজন বলছেন-সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই চোরাকারবারীরা দায়িত্বরত লোকজনকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে সীমান্তে আসা-যাওয়া করে। যখন সীমান্তে একটু নজরদারী দেখাতে হয় তখন কাউকে দেখা মাত্রই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী গুলি ছোড়ে।যার কারণে সীমান্তে মানুষ হত্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। অনেক সময় গণমাধ্যমে দেখতে পাই গুলি করে মানুষ হত্যা করে লাশও নিয়ে যায় বিএসএফ।

তবে সীমান্তের জেলাগুলোতে অনেক দালালচক্র রয়েছে। যাদের কারণে সীমান্তে অপকর্ম সংগঠিত হয় এবং পরে এসব দালালচক্রের লোক বা অন্যরা সীমান্তে মৃত্যুর শিকার হয়। অনেক সময় অপহরণের ঘটনাও ঘটে সীমান্তে।তবে একটি বিষয় শুধু ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশি মানুষ হত্যার ঘটনা খবরে শুনতে পাই, কিন্তু আমাদের বাহিনী কর্তৃক ভারতের কোনো লোকের হত্যার ঘটনা শুনতে পাই না। অর্থাৎ বাংলাদেশি সীমান্ত বাহিনী অনেক সুশৃঙ্খল। তবে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক কেন আমাদের নাগরিকরা মারা যাবে?

তাহলে কি আমরা দুর্বল বা ছোট দেশ বা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার কারণে এই হত্যা বা নির্যাতন সীমান্তে বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের কোথায় কি সমস্যা রয়েছে, সে বিষয়ে বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিত আমাদের কাজ করতে হবে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। যেন কেউ সীমান্তে চোরাকারবারি বা মাদক পাচার করতে না পারে।তাহলে এসব অনেকাংশে বন্ধ হতে পারে। বিএসএফ কর্তৃক বিজিবির সদস্য নিহতের ঘটনায় সরকারের কঠোর ভূমিকা দেখানো উচিত যাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়।

সাধারণত সীমান্তে হত্যার মূলে রয়েছে চোরাকারবারি ও মাদক পাচার। এবিষয়ে বিজিবিকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ সীমান্ত হত্যাকাণ্ডে যেসব মানুষ মারা যায়,এর অধিকাংশ লোক গরু চোরাকারবারির সঙ্গে সংযুক্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশি বাজারে গরু দেখলে, যে ব্যক্তি গরু নিয়ে আসছে বাজারে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। ভারত থেকে প্রতিশ্রুতি আনতে হবে যাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়। শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে হবে না,তা কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সারাজীবন স্থায়ী হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

যদি কেউ সীমান্তে অবৈধ কাজ করে থাকে, তাহলে দুই দেশের সীমান্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করা এবং হাঁটুর নিচে গুলি করা যেতে পারে। ফলে মানুষ মারা যাবে না। অর্থাৎ অবৈধ কাজের সাথে যারা জড়িত তাঁদের কঠোর বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের আওতায় না এনে তো একটা মানুষকে এভাবে মারা ঠিক হবে না। এসব বিচার বহির্ভূত হত্যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সীমান্তে হত্যার বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও বৃদ্ধি করতে হবে। তবে সীমান্তে হত্যা বন্ধে সরকারকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতিবিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

এইচআর/জেআইএম