আবুল-বাবুলে স্বাস্থ্যের দুর্নীতি বিনাশ সম্ভব?
চুরি-দুর্নীতির ভাণ্ডার হিসেবে পুকুর নয়, সাগরও নয়, মহাসাগরের মতো সেক্টরটিতে বেশ রদবদল এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিভিন্ন অধিদপ্তর, বিভাগ, হাসপাতাল, কলেজের শীর্ষ পদে রদবদল আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে জেকে বসা কর্তৃপক্ষ ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট ভাঙ্গা।
নিয়োগ, বদলী, পদায়ন, কেনাকাটা ইত্যাদিতে এই চক্রের অনিয়ম-দুর্নীতিতে ছিল এক ধরনের ইনডেমনিটি দেয়া। যার জেরে মাঝেমধ্যে কিছু বড় কর্তা এমন কি মন্ত্রী বদলের পরও মালেক-মালিক-মিঠু ইত্যাদিতে গড়ে ওঠা চক্রের একটি পশমও ছোয়া যায়নি। এখন আবুলের বদলে বাবুল বা কামালের বদলে জামাল দিয়ে তা কতোটা রোখা যাবে?
চুন খেয়ে মুখ পোড়ার পর এখন দুধ দেখেও ভয়মুক্ত হতে পারছেন না স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে জানাশোনা ব্যক্তিরা। তারা দেখেছেন, জেনেছেন স্বাস্থ্যের ড্রাইভার মালেকের মহাজন হয়ে ওঠা। মালেকের মালিক তখনকার ডিজি মহোদয়েরই বা কি অবস্থা? চাহিদা না থাকলেও অ্যাম্বুলেন্স-এক্সরে মেশিনসহ নামিদামি যন্ত্রপাতি নয়, কেবল গজ-ব্যান্ডেজ কেনায়ও কিভাবে সাগর চুরি করে কতো হাজার-কোটি টাকা লোপাট হয়েছে এক একটি হাসপাতালে। নির্দিষ্ট সাপ্লাইয়ের কাছ থেকে ওষুধপথ্য কেনার নামে হাজার-কোটি টাকার নয়-ছয় মাঝেমধ্যে অডিট রিপোর্টেও ধরা পড়েছে। কোনো বিহিত হয়নি।
স্বাস্থ্য খাতে বহু বিভক্তি এবং যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক। ডাক্তাররা কেউ বিএনপি সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাব। কেউ আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ। নার্স-কর্মচারীসহ বাদবাকিদেরও দলীয় চর্চা।
এখন দুর্নীতির সেই গ্যাস চেম্বার সারানোর দায়িত্বে নুরজাহান বেগম। অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা ভিনদেশ থেকে হঠাৎ বাংলাদেশে আসেননি। চাঁদের দেশ থেকেও নামেননি। নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ছাড়াও তার অভিজ্ঞতার ভলিউম বেশ বড়। ভলিউমের সাথে তার কাজের সিলেবাসটাও বেশ বড়। এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে তিনি ওয়াকেবহাল। তারওপর এই ক’দিনে যথেষ্ট হোমওয়ার্কও নিশ্চয়ই করেছেন। বেশ কিছু রোগও সনাক্ত করেছেন। এখন রোগ সারানোর পর্ব। আগের প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা দিয়ে কি সারাতে পারবেন এ রোগ? মোহাম্মদ নাসিম, ডা. রুহুল হক, জাহিদ মালেক, সামন্ত লাল সেনের মতো ব্যক্তিরা যা পারেননি অথবা নিজেরাও দুস্কর্মে লেপ্টে গেছেন। সেখানে নুরজাহান বেগম কী করেন বা করতে পারবেন- সেদিকে অনেকের নজর একটু বেশি থাকাই স্বাভাবিক।
স্বাস্থ্য খাতে দীঘদিন ধরে চলে আসা চুরি- দুর্নীতি- অনিয়ম স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক-ডিজি বা পাঁচটি সরকারি মেডিকেল কলেজের নতুন অধ্যক্ষরা সারিয়ে ফেলবেন- তা ভাবার সুযোগ নেই। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় সব অনিয়ম-দুর্নীতি এ পর্যায় থেকে হয়নি। অপকর্মের বহু অংশীজন। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটাসহ নানা কাজকর্মে টেন্ডার বাগিয়ে নিয়ে অর্থ লোপাট করেছে শক্তিধর সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট সারা দেশে নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে টেন্ডারের বেশিরভাগ টাকাই হাতিয়ে নিয়েছে।
এদের বিস্তার তৃণমূল পর্যন্ত। এতে জড়িত রাঘব বোয়ালদের ধরতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা কোনোদিনও দূর হবে না। চিকিৎসা সেবা নেবার জন্য সরকারি কিম্বা বেসরকারি হাসপাতাল যেখানেই যাওয়া হোক হয়রানি হতেই হবে। বহুদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতে যে অনিয়ম চলে আসছে সেটি দূর করে স্বাস্থ্য খাতের উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ জিততে হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান লাগবেই। এ অভিযানের মূল কাণ্ডারি দেশের একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়া নুরজাহান বেগম।
স্বভাব বৈশিষ্ট্যে তিনি নিরিবিলি। কম কথার মানুষ। অন্য উপদেষ্টাদের মতো সরব নন, আলোচিতও নন। এক ঝলকের মতো তার কর্মতৎপরতা দেখা গেছে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকদের আন্দোলন মিটমাটে। ঘটনার পর একটুও দেরি না করে ছুটে যান ডাক্তারদের কাছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তারদের কর্মবিরতি স্থগিত করান। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করেন।
এ কাজটি ছিল আকস্মিক। হিসাবের বাইরে। যখন আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দেখভালে নিবৃতে-নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। তারওপর বানভাসী মানুষের জন্য ব্যতিব্যস্ততা। আর বিভাগীয় যন্ত্রণা তো আছেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একদিকে মিছিল-মিটিং, দাবি দাওয়ার হাট। স্বাস্থ্যের ডিজি অফিস করতে পারছেন না। এর নেপথ্যেও বৈষম্য। আর বৈষম্যের কারণেই এতো আন্দোলন, শেষমেষ সরকার পতন।
সহ্য সীমার বাইরে দুর্নীতি-চুরিতে নিমজ্জিত সেক্টরটির ইমাম বা পুরোধার আসনে নুরজাহান বেগম তার জ্ঞান-দক্ষতা কতোটা কাজে লাগাতে পারছেন –পারবেন; এ আলোচনা বেশ জোরদার। ঠাণ্ডা মাথায় এগোচ্ছেন তিনি। সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলছেন। কিন্তু, দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকারদের তর সইছে না। আর ধৈর্য্য না ধরে এখনই নগদে সব বৈষম্যের অবসান চান তারা।
এর বিপরীতে একজনকে সরিয়ে অন্য একজনে বসালেই পরিবর্তন বা সংস্কার হবে না- এই উপলব্ধি জানান দিয়েছেন এই উপদেষ্টা। এতে বেজার অনেকে। তারা এমনটি আশা করেননি। স্বাস্থ্য খাতে বহু বিভক্তি এবং যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক। ডাক্তাররা কেউ বিএনপি সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাব। কেউ আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ। নার্স-কর্মচারীসহ বাদবাকিদেরও দলীয় চর্চা।
এর বাইরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা চোর-লুটেরা শ্রেণি। গায়ে দলের ছাপওয়ালা অনেকে চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন, অনেকে বাধ্য হয়েছেন। এটি আরেক ধরনের সমস্যা। সবমিলিয়ে গোটা স্বাস্থ্য খাত অত্যন্ত জটিল। সংস্কার করতে গিয়ে কোথা দিয়ে শুরু করবেন-নির্নয় করা যারপরনাই কঠিন। সেই কঠিনেরে ভালো বাসতে না পারলেও সইতে হচ্ছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে। আরো সইতে হবে। সয়ে সয়েই আনতে হবে সংস্কার। কেবল কয়েকজন ব্যক্তি বদল করলেই সংস্কার আসবে না-এই বুঝ তার বোঝা আছে আগেভাগেই। সংস্কারের পথে একটি শুভ লক্ষণ। এই শুভ লক্ষণের মাঝেই ঢাকা মেডিকেলে ধাক্কা। যেখানে এই মেডিকেলটিকে নেয়া হয়েছিল মডেল হিসেবে।
এক’শ দিনের মধ্যে সেখানে কিছু নতুনত্ব আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই পরিবর্তনের মধ্যেই সেখানে ঘটলো ডাক্তারদের ওপর হামলার অনাকাঙ্খিত ঘটনা। যার জের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য মেডিকেলে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দ্রুত পদক্ষেপে তা সামলিয়েছেন। কিন্তু, এই সামলানো মানেই বিপদ বা ঝুঁকি কেটে যাওয়া নয়। সেনা-পুলিশের নিরাপত্তা বেস্টনিতে রেখে নার্স-ডাক্তারদের চিকিৎসাসেবায় রত রাখাও স্থায়ী ব্যবস্থা নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/এএসএম