একটি গাজরের দাম ৫০ টাকা
একটি মাত্র গাজর কিনতে বাধ্য হলাম। কারণ গাজরের কেজি তিনশ টাকা। এই সবজি পণ্যটি নিত্যপণ্য বটে, তবে চাল-ডাল-নুন-মরিচের মতো নয়। এক দুই দিন গাজর সবজির তরকারিতে না দিলেও চলবে, কিন্তু চাল না কিনলে কি চলে? না, চলে না। তবে চালের দামও কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়েছে প্রকারভেদে।
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের সময় যে দামে চাল-ডাল বিক্রি হয়েছে, এখন কোনো কোনো বাজারে তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচাবাজারে কোনো লক্ষণ নেই দাম কমার। আজ সকালে (২৯ আগস্ট) এক মুঠো পুঁইশাক কিনতে গিয়ে থতমত খেলাম। দাম মাত্র ৫০ টাকা। দোকানি একটু দয়া করে দশ টাকা কমিয়ে দিলেন আমার মুখ দেখে। ৪০ টাকার শাক একবেলার জন্য। একটি শাক ও সবজির জন্য যদি এই রকম টাকা ব্যয় করতে হয়, তাহলে আমাদের রোজগার কত হওয়া জরুরি। কিন্তু কোনো সিজনেই তো কাঁচা পণ্যের দাম এক রকম থাকে না। আবার আমাদের বেতনও তো মাসে মাসে বা দিনে দিনে বাড়ে না। আবার ইউরোপ আমেরিকার মতো বেতন তো ঘন্টায় নির্ধারণ করা নেই।
ঘণ্টায় ১০-১২ ডলার পেলে তো আমাদের টাকায় কনভার্ট করলে তার পরিমাণ কত হতে পারে? আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি। কিন্তু আমাদের শাসকরা স্বপ্ন দেখতে শেখেননি। তারা কেবল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকবেন আর মনে মনে গাল দেবেন। কিন্তু আমি বলছি অদূর ভবিষ্যতে বেতন কাঠামো ইনডিভিজুয়াল হবে এবং ঘণ্টায় তা রূপান্তরিত হতে বাধ্য। কারণ অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, বাড়ছে উন্নয়ন পরিধি এব্ং ব্যয়ের বিভিন্ন খাতও বেড়ে চলেছে।
মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু বাজারে সেই পরিমাণ (জব মার্কেটে) চাকরির পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, সুযোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়াও কচ্ছপগতি, যা শিক্ষিত মেধাবি প্রার্থীদের জায়গা দিতে পারে। চাকরির সুযোগ নেই বাজারে, তাই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে সমাজের বঞ্চিত অংশ। কিন্তু কেবল সরকারি চাকরির হাজার হাজার পদ খালি পড়ে থাকলেও, সেই সব পদে চাকরিপ্রার্থীদের সুযোগ করে দিচ্ছিল না বিগত সরকার। সেখানে সুযোগ পাচ্ছিল কোটাজীবীরা। মেধাবীরা চিরকালীন বঞ্চিত এদেশের কৃষক সমাজের মতোই বঞ্চিত থেকে গেছে। সেই বঞ্চনার ঘোর থেকে মাথা তুলে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তারাই পতন ঘটায় হাসিনা সরকারের একদেশদর্শি চেতনার।
সদ্য দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর সবাই ভেবেছিল যে বাজারে একটি স্বস্তিদায়ক পণ্য মূল্য কায়েম হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং বেড়েছে। কেন বাড়লো? এর ব্যাখ্যায় অনেকের মত হচ্ছে আড়তদারদের সিন্ডিকেট ভাঙেনি এই সরকার। কেউ বলছেন তাদের বয়স তো মাত্র ২০-২২ দিন। এই শিশু সরকার চেয়ারে বসেই দেখছে ১৬-১৭ বছরের লুটেরা, দুঃশাসনে লন্ডভন্ড অবস্থা সর্বত্র। যেখানে চোখ যাচ্ছে সেখানেই দুর্নীতির চরম ঘা। কোথায় মলম লাগাবেন তারা? হয় মাথা কেটে ফেলতে হবে, না হলে পর্যায়ক্রমে সেই ঘা শুকানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন সবুর করা। প্রয়োজন সময়।
একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে পারলেই কেবল ওই সর্বাঙ্গের ঘা শুকিয়ে যাবে। তখন মৌলিক যে সমস্যা তা সংস্কারে হাত দিতে পারবেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার সাংবিধানিক সরকার নয়, মানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন তারা। কিন্তু তারা জনগণের দ্বারাই, আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় বসেছে। তাদের ভুল হচ্ছে বিগত সরকারের সন্ত্রাসী লুটেরা ও অধিকারহরণের সংবিধান মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া ও শপথ নেওয়া। ওই রাষ্ট্রপতি তো পতিত স্বৈরাচারের হাত ধরে ওই আসনে বসেছেন। অতীতে যে লুটেরা সরকার শাসক হিসেবে ছিল তারা কি নির্বাচিত ছিল? সাদা চোখে দেখলে তা নির্বাচিতই বটে। কিন্তু চোখ বাঁকা করে দেখলে ভোট ডাকাতির আগে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন দখল করে একজন বশংবদ বসিয়ে নির্বাচনী ফলাফল দখল করে নেওয়ার ঘটনা তো ১৬ বছর ধরেই দেখে আসছি আমরা।
ওই নির্বাচনগুলো যেমন অবৈধ ছিল, তেমনি ১৬-১৭ বছরের ওই সরকারও ছিল অবৈধ। ফলে তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিতার ধার ধারতেন না। আওয়ামী বাণিজ্য ক্লাবে পরিণত হওয়া ওই সংসদগুলো দেশে নৈরাজ্য জাতির কাঁধে চড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে আমাদের অর্থনীতিকে চুষে নিয়েছে। সেই শোষক/চোষকদের কয়েকজনের নাম আমরা জানি। তারা ভূমিদস্যু হিসেবে চিহ্নিত শাহ আলম ওরফে আহমেদ আকবর সোবহান (বসুন্ধরা গ্রুপ) ঋণ ও ব্যাংক লুটেরা এস আলম (এস আলম গ্রুপ) এবং (নাবিল গ্রুপ) বেক্সিমকো গ্রুপ অর্থাৎ (দরবেশ সালমান এফ রহমান), কাজী গ্রুপ, ঋণ খেলাপি গ্রুপ, ঋণ গ্রহিতা গ্রুপ, এবং তৈরি পোশাক শিল্পের সমিতি ও ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের অচিহ্নিত গ্রুপ এবং শাক-সবজি, ডিম তরিকারির অচিহ্নিত ব্যবসায়ী গ্রুপ, রেস্তোরাঁ সমিতির দালাল নেতৃত্ব গ্রুপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চক্রের একটি দলবাজ গ্রুপ।
পুলিশের ঘুস, দুর্নীতি গ্রুপ, আমলাদের দলবাজ গ্রুপ, কৃষকলীগ গ্রুপ এবং সিএনজিচালিত বেবিট্যাক্সিওয়ালাদের গ্রুপ, পাড়া-মহল্লার চাঁদাবাজি আওয়ামী সন্ত্রাসী লীগ গ্রুপ- আজো অব্যাহত। এটা মনে হতে পারে যে ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতকা শেখ হাসিনার দোসররা নিশ্চুপে বসে আছেন। পাড়া-মহল্লার, বাজারে রাস্তায় নতুন করে চাঁদা উঠানোর কারবার শুরু হয়েছে নিশ্চুপে, ভিন্ন নামে ভিন্ন কৌশলে। তারা আওয়ামী নাম বদলিয়ে বিএনপির নাম ও বিএনপির চাঁদাবাজদের নাম ব্যবহার করছে। বিএনপি থেকে প্রকাশ্যে বলা হয়েছে, দলের নাম নিয়ে যারা চাঁদা তুলতে যাবে তাদের ধরে থানায় দিতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কাউকে ধরা হয়নি। ধরা হলেই বোঝা যেত তারা বিএনপির লোক না কি গাঢাকা দেওয়া সন্ত্রাসী লীগের চাঁদাবাজ। এদের সক্রিয় ভূমিকার কারণেই পাড়া-মহল্লার কাঁচাবাজারে কাঁচাপণ্যের দাম কমতে পারেনি।
এই চাঁদাবাজির সংস্কৃতির শেকড় উপড়ে ফেলতে হলে নিচু স্তরের স্বার্থান্বেষীদের উৎপাটন জরুরি। এখান থেকেই শুরু করা হোক। ঢাকা মহানগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে চাঁদাবাজ চক্রের সঙ্গে খুচরা বিক্রেতারাও জড়িত। তাদের মধ্যে ন্যায় কায়েম করতে হলে প্রতিটি ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল ও ন্যায়পরায়ন কর্তাদের নিয়োগ দিয়ে তাদের ওপরও নজরদারি করতে হবে গঠন করতে হবে সামাজিক মানুষের কমিটি। তাহলে কাঁচাবাজারের মূল্য কমে আসবে এবং স্থিতিশীল হবে।
এই ছোট, কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জনহিতৈষণামূলক কাজটি আগে করুন। এতে ঢাকার গণমানুষ, যারা কম আয়ের মানুষ, তারা লাভবান হবে। তাদের লাভ মানে দেশের গণমানুষের উন্নতি।
২৯/০৮/২৪
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কবি, কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস/ফারুক