ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অনেকতো করলাম উন্নয়ন জাতিগঠন কি করতে পারলাম?

এন আই আহমেদ সৈকত | প্রকাশিত: ১০:৩৯ এএম, ২৬ জুলাই ২০২৪

দারিদ্র্যতা হ্রাসকরণ, রাস্তাঘাট, পদ্মা ব্রিজ, মেট্রোরেল, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নের মহাযাত্রায় সবই পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে মাথাচারা দিয়ে উঠেছে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মিক উন্নয়ন’ প্রসঙ্গটি। জাতিগঠনে এর ভূমিকাই সব থেকে বেশি।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদন্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের রুপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।

উন্নয়নতো অনেক হলো, স্বাধীনতার অর্ধশতক পার করার পর যে প্রশ্নটি উঁকি দিচ্ছে সেটি হলো- জাতিগঠন হলো কতটুকু? দেশজুড়ে এ মুহূর্তে যে অবস্থা চলছে, তাতে এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। সমাজে সুশিক্ষা, ন্যায়নিষ্ঠা, হতদরিদ্র মানুষের জন্য সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন, আর্তমানবতার সেবা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষিত সমাজ গঠন ও সত্য কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি-এসব কথা নিয়ে আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ থেকে শুরু করে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, রাজস্বের মতিউর রহমান, একই বিভাগের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুন, সিলেটের কর কমিশনার এনামুল হক, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি কামরুল হাসান, পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলী, পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর কিংবা মিন্টন সমাদ্দারদের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজগঠন তথা জাতিগঠনে এখনও আমরা ঢের পিছিয়ে।

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, তাঁর সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। তিনি বলেছেন, ‘যারাই দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্সের’ বক্তব্য অবশ্য নতুন নয়; গত ১৪ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, ব্যবস্থা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।

এরমধ্যে আবার আলোচনায় এসেছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলনের গতিবিধি, সমন্বয়কদের বক্তব্য আন্দোলনের ভবিষ্যৎ, যৌক্তিকতা এবং সর্বোপরি আদর্শগত জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কোটা সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের যে ভাষায় মন্তব্য দেখছি তা খুবই উদ্বেগজনক! সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে যারা আন্দোলন করছে তারা জানেও না এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট ও চিহ্নিত গোষ্ঠীর রাজনৈতিক এজেন্ডা।

রোববার মধ্যরাতে প্রায় দুই ঘণ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়। দেশের মেধাবীরা যখন স্লোগান দেয় ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ তখন ভবিষ্যৎ নিয়েছে আশংকা করা ছাড়া আর কোনো পথ সামনে থাকে না। জাতি যাদের নিয়ে গঠন হবে তারাই নিজেদের ঘৃণিত ‘রাজাকার’ বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।

কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারের গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হলে কেউ সস্তা জনপ্রিয় আন্দোলনের সুযোগ নিতে পারবে না। প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষাশেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাতিগঠন প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। সুতরাং আমাদের রাজনীতির একটি সামগ্রিক মূল্যায়ন করা অতীব জরুরি! ‘৭১ এ মাত্র সাড়ে চার লক্ষ ব্যক্তি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭২-৭৫ এ অতি স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ পেয়েছেন।’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর ১৯৯৬ এ জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারে আসার পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন চরম অবহেলিত। শুধু তাই নয় জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকারের আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে।

কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় সম্মান ছিল না। আমার জানা মতে এখন খুব স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার বংশধরেরা বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। সংখ্যাটি অতি মাইক্রোসকপিক। নামে মাত্র থাকা ৩০% কোটার ৮-১০% পূরণ হয় কি না সন্দেহ আছে! আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য কোনো কোটার প্রয়োজন নেই। বরং নিয়োগ পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত যোগ্যতার মানদন্ড পূরণ হলে সরাসরি তাদের নিয়োগ দেয়া উচিত।

তথাকথিত মেধাবীরা মেধার সংজ্ঞা আদৌ জানেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সমাজের অগ্রসর ব্যক্তিবর্গের সন্তানরা ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে ভালো ফলাফল করে। তার মানেই কি তিনি মেধাবী? রাষ্ট্রের দায়িত্ব সকল নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীন সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। রাষ্ট্রের সেই সক্ষমতা যতদিন না হবে ততদিন সমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজের অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু রাখা বাঞ্ছনীয়।

আরও একটি বিষয় অনুধাবনযোগ্য। কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারের গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হলে কেউ সস্তা জনপ্রিয় আন্দোলনের সুযোগ নিতে পারবে না। প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষাশেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে হবে।

জানুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। শোষকদের আর বাংলাদেশে থাকতে দেয়া হবে না। কোন ভুঁড়িওয়ালা এদেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরীব হবে এই রাষ্ট্র এবং এই সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না’।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষে মানুষে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। অর্থাৎ স্বাধীনতা উত্তর তিনি চেয়েছিলেন শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। গণমানুষের মুক্তি ও শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন স্বার্থত্যাগী মানুষদের। মানুষের জন্যই সমাজ, রাষ্ট্র ও সৃষ্টির এত আয়োজন। কিন্তু সুস্থ মানসিকতার বিকাশ ছাড়া মানবসভ্যতা ও সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম