নৃশংসতা ধ্বংসযজ্ঞ নয় চাই স্বস্তি
সরকারি চাকরিতে ৭ শতাংশ কোটা রেখে সর্বোচ্চ আদালতে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ের ফয়সালা হলো। এর মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানী ঘটে গেছে সারাদেশে। এই মৃত্যু কি এড়ানো যেতো না? অনেক আলোচনাই হতে পারে।
কোটা বিরোধী কিংবা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি ও সরকারের অবস্থান ছিল একই। তারপরও এই মৃত্যু কেন? এই প্রশ্নটি সবার আগে আসতে পারে। এত ধ্বংসযজ্ঞই বা কেন হলো। শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হওয়ার দায় নেবে কে? এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে যে আঘাত করেছে, তারজন্যও বা কে দায়ী? এই যে বিশাল ক্ষতি তাও বা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না? কিংবা কারা এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ কিংবা নেপথ্য কারিগর? এই মুহূর্তে প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া জরুরি।
আন্দোলনকারীরা বলছে, তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না, তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকে সমর্থন করেনি কিংবা করেও না। এদিকে সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের রক্ষক। তাইলে কারা এই সম্পদ ধ্বংস করলো। ধ্বংসযজ্ঞের দিকে খেয়াল করা যেতে পারে। প্রথমই ধরা যাক মেট্রোরেল স্টেশন গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা। কাজীপাড়া ও মিরপুর দশ নম্বর মেট্রোস্টেশন এতটাই ধ্বংস করে দিয়েছে যা চালু হতে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টগণ জানিয়েছেন।
হানিফ ফ্লাইওভারের টুলপ্লাজা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। পদ্মাসেতুর জন্মকেন্দ্র সেতুভবন শুধু পুড়িয়েই দেয়া হয়নি, সেখানে থাকা ৫৫টি গাড়ি আগুন ধরিয়ে শেষ করে দিয়ে সেতু বিভাগকে স্থবির করে দেওয়া হয়েছে, বিআরটিএ এবং বিটিআরসিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে আগুন লাগিয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে দীর্ঘ সময়ের জন্য, ন্যাশনাল ডাটা সেন্টারে আঘাত করার অর্থ কি?
একইভাবে প্রশ্ন আসে, অপটিকেল ফাইবার বিচ্ছিন্ন করা, ডিএনসিসি হাসপাতাল, জনস্বাস্থ্য ইন্সিটিটিউট, ইপিআই, বিসিপিএস, স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের সদর দফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, জরুরি সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে মারাত্মক ক্ষতি করার উদ্দেশ্য কি?
নরসিংদী কারাগার থেকে অস্ত্রসহ পালিয়েছে জঙ্গি এবং কয়েদীরা। পুলিশবক্স যে কতগুলো পোড়ানো হয়েছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাস্তার ডিভাইডার-গ্রিল এমনকি রাস্তার আইল্যান্ডের নির্বাক গাছগুলোও। আরও অসংখ্য ধ্বংস করা হয়েছে আন্দোলনের সূত্র ধরে।
আন্দোলনকারীরা জরুরি পরিষেবাগুলোকে সচল রাখার ব্যবস্থার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল। দুনিয়াজোরা সব আন্দোলন এমনকি কারফিউতেও জরুরি পরিষেবা চালু রাখার বিধান আছে। চলতি কারফিউ থেকেও এসবকে মুক্ত রাখা হয়েছিল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে-স্বাস্থ্যসেবায় আঘাত করা। অ্যাম্বুলেন্স ভেঙ্গেচুড়ে গুঁড়িয়ে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়াকে মানবতা বিরোধী অপরাধ বললেও কম বলা হবে।
মেট্রোরেল জনপ্রিয়তা এবং জনসুবিধা দুটোই পেয়েছে। সরকারের অর্জনগুলোর মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে প্রথম দুটির একটি হিসেবে স্বীকৃত। এতে নিশ্চয়ই কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। ইতোমধ্যে ঢাকার ১২% মানুষের যাতায়াত সুবিধা সহজতর করতে সক্ষম হয়েছে এই মেট্রোরেল।
সরকারের যত সমালোচনাই মানুষ করুক না কেন এই প্রশ্নে কারো দ্বিমত নেই। মেট্রোরেলের সুবিধাভোগীদের ছাড়াও সবাই এর প্রশংসা করে থাকেন। তাই সহজেই অনুমান করা যায়, যারা মেট্রোরেল কিংবা সরকারি অন্য স্থাপনা ও সম্পদ ধ্বংস করেছে তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো জনদুর্ভোগ তৈরি এবং সরকারের কৃতিত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া।
কোটা বিরোধী কিংবা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি ও সরকারের অবস্থান ছিল একই। তারপরও এই মৃত্যু কেন? এই প্রশ্নটি সবার আগে আসতে পারে। এত ধ্বংসযজ্ঞই বা কেন হলো। শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হওয়ার দায় নেবে কে?
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেছে, তারা ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন করে না। তাইলে নিশ্চিত এখানে তৃতীয় একটি পক্ষ যুক্ত হয়েছে,যারা এই অপকর্ম করে জনগণের দুর্ভোগকে টেনে এনেছে। তাইলে এরা কারা। সরকার এখন বলছে, এই কাজগুলো বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা করেনি। কিন্তু আন্দোলন হলে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকার কথা। যখন ধ্বংসযজ্ঞ চলছিলো তখন তাদের আন্দোলনও চলছিল, তারা আন্দোলন স্থগিত কিংবা প্রত্যাহার করেনি। সেই অবস্থায়, তারা ধ্বংসযজ্ঞের দায় থেকে কি মুক্ত থাকতে পারে?
সরকারি দল থেকে বলা হচ্ছে এ কাজের মূল হোতা জামায়াত বিএনপি। বিএনপি বলছে, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে সরকার। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক ওই সময় বিএনপি ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে-তারা বলেছে, আন্দোলনকারীদের সমর্থন করে তারা। শুধু তাই নয় তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র দলের সদস্যরা আন্দোলনকারীদের সমর্থনে মিছিলও করেছে।
বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে সমাবেশও ডেকেছিল ঢাকায়। সেই সুবাদেই হয়তো সরকার ধ্বংসযজ্ঞের দায় চাপাতে পারছে বিএনপির ওপর। এক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে আসতে পারে বিএনপির দীর্ঘকালীন জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও। আরও লক্ষ্যণীয় যে যখনই বিএনপি আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে তখন থেকেই এই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়।
তারপরও ঢালাওভাবে বলা যাবে না, বিএনপিই এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সরকার যেহেতু দাবি করছে, বিএনপি-জামায়াত ছাত্রদের দাবির ওপর ভর করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, এখন সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে এর সত্যতা। উন্নত প্রযুক্তিসুবিধা ব্যবহার করে ইতিপূর্বে অনেক মোটা দাগের অপরাধীকে চিহ্নিত করায় আমাদের পুলিশ বাহিনী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
থ্রিল কাহিনীর চলচ্চিত্রের মতো অপরাধীকে ধরে আনার মতো অসংখ্য উদাহরণও তৈরি করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। তাছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেও সিসিটিভি সংযোজিত আছে। তাই প্রযুক্তিসুবিধা ব্যবহার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা সম্ভব বলে সাধারণ মানুষ মনে করতেই পারে।
দ্বিতীয় দিকটি আলোচনায় আসতে পারে,কোটা বিষয়ে। সরকার ও আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলো কোটা সংস্কার হোক। দুই পক্ষেরই একই চাওয়া হওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা কেন আন্দোলনে গেল? মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের আদালতে যাওয়ার পর হাইকোর্ট কোটা প্রথা আবার চালু করে রায় দেন। সেই রায়ে সংক্ষুব্ধ হয় সরকার। তার প্রমাণ-রায় প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার আপিল করার কথা ঘোষণা করে। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার আগের কোটা পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়।
৫৬% কোটা নির্দিষ্ট করে দেওয়াকে সরকার সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে করে। একইভাবে আন্দোলনকারীরাও একই দাবি করছিলো। তাদের দাবি ছিলো সব মিলিয়ে ৫% পর্যন্ত কোটা সংরক্ষণ হতে পারে। দুই পক্ষের প্রায় একই মত থাকার পরও কেন শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি, এটা পর্যালোচনা হতেই পারে। বলতে দ্বিধা নেই, তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আর যে কারণে শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত অবস্থায় চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এখন আদালত যে রায় দিয়েছেন, অর্থাৎ ৭% কোটা সংরক্ষণ থাকবে। আবার বলা হয়েছে, সরকার ইচ্ছা করলে এই কোটা পরিবর্তনও করতে পারবে। ৭% সংরক্ষণের কথা বলা হলেও বাস্তবে এই কোটা মাত্র ২%। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে ৫% কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে এটা কার্যকর হবে না। বলা হয়েছে, এই কোটা শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে এই মুহূর্তে ১-২% মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও চাকরির বয়সের আছে কি না সন্দেহ। ফলে মুক্তিযোদ্ধার কোটার ১-২%ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। রায়ে বলা আছে কোটায় কোনো শূন্য পদ পূরণ না হলে সাধারণ মেধাবীদের থেকে সেই পদ পূরণ করা যাবে। বাস্তবেও তাই ঘটবে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা শুধু কাগজে কলমেই থাকবে, বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ফলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্দ্বীদের কোটাই থাকছে। এই হিসাবে কোটা থাকছে মাত্র ২%। যা আন্দোলনকারীদের দাবির চেয়েও বেশি। আর আন্দোলনকারীরাও এই রায়কে সাধুবাদ জানিয়েছে রায় ঘোষণার পরপরই।
আন্দোলনকারীরা কমপ্লিট শাটডাউন প্রত্যাহার করেছে আদালতের রায়ের পর। তবে তাদের ৮ দফা দাবি তারা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাদের এই দাবিগুলোর প্রধান কিছু দিক ইতোমধ্যে সরকার বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তাদের দাবি জানানোর আগেই সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং সেই কমিটিও কাজ শুরু করে দিয়েছে।নিহতদের পরিবারকে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ধ্বংস হওয়া স্থাপনাগুলোকে কার্যক্ষম করা। এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। আর দশটা তদন্ত প্রতিবেদনের মতো যেন এটাও হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইতোমধ্যে ব্রডব্যান্ড সুবিধা সীমিত আকারে চালু হয়েছে। হয়তো শিগগিরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও চালু হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কনটেন্টগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। সেখান থেকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের শনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। নির্দোষ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন সেটাও সরকারকে দেখতে হবে। মানুষের দাবি-দাওয়া থাকবে, সমস্যা থাকবে সেসবের সমাধানেরও পথ আছে। কিন্তু এমন নৃশংসতা যেন আর কখনো না ঘটে, শান্তিপ্রিয় মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/জেআইএম