ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাসযোগ্যতা সূচকের তলানিতে ঢাকা : কারণ ও সমাধানসূত্র

মো: আবু নাইম সোহাগ | প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ১০ জুলাই ২০২৪

 

ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী, একটি বৈচিত্র্যময় শহর। এই শহরের ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের অধিক পুরোনো। ভৌগোলিকভাবে এটি বাংলাদেশের মধ্যভাগে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীর সংলগ্ন সমতল অঞ্চলে অবস্থিত। ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ায় মুম্বাইয়ের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শহর। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে এই শহর বাংলাদেশের অন্যান্য শহরগুলো থেকে অধিক গুরুত্ব বহন করলেও বিশ্বব্যাপী বসবাসযোগ্যতার সূচকে এটি প্রায় সবসময়েই নিচের দিকে থাকে।

ব্রিটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর সহযোগী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের বসবাসের যোগ্য শহরের একটি তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে যার মধ্যে ৪৩.০ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকার অবস্থান ১৭৩ টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। মোটা দাগে বলা যায় আমাদের ঢাকা শহরে বাস করা প্রায় দুই কোটির অধিক মানুষ আছে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকিতে । যদিও শহরটি তার বিস্তৃত জীবিকা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য পরিচিত, সেখানে সামাজিক স্থিতিশীলতার অভাব ঢাকার বসবাস যোগ্যতাকে ক্রমাগত হ্রাস করছে। কেনো ঢাকা এই সূচকে এত পিছিয়ে রয়েছে তা বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এর বাসযোগ্যতা সূচক পরিমাপ করার মানদন্ড গুলো হলোঃ স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও ন্সকৃত এবং শিক্ষা ও অবকাঠামো। এই মানদন্ডের যেকোনো একটিতে কিঞ্চিৎ ঘাটতি কোনো শহরকে বসবাসযোগ্যতার সূচকে পিছিয়ে দেয়। ঢাকা কেনো এই সূচকে পিছিয়ে তার উত্তর খোজার জন্য আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না বরং ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এর ৫ টি মানদন্ডের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করুন প্রাণের শহর ঢাকা’তে এই মানদন্ড গুলোর কয়টি আমরা যথাযথভাবে পাচ্ছি কিংবা আমাদের নগর সংস্থা আমাদেরকে কতটুকু দিচ্ছে?

ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এর জনসংখ্যার ঘনত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনসংখ্যা ও গৃহায়ন শুমারি ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৬ জন। সরকারি হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যা এমন দেখানো হলেও বাস্তবে তা প্রায় দুই কোটির বেশি। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর। জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর যার ২৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩৮ হাজার লোক বাস করে।

বাংলাদেশের মানুষের শহরের তথা রাজধানী ঢাকার প্রতি এক প্রবল আকর্ষণ রয়েছে যার ফলে উচ্চ শিক্ষা, অধিক আয়, উন্নত জীবন ব্যবস্থার খোজে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমায়। অতিরিক্ত জনসংখ্যা এই মেগাসিটির অবকাঠামোর উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করে, যা বাসস্থান, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলে।

এই মাত্রাতিরিক্ত জনগণের নাগরিক সুযোগ সুবিধাসহ অন্যান্য বিষয়ে হিমশিম খাচ্ছে নগর উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাসমূহ। নাগরিক সুবিধা ও জনসংখ্যা ঘনত্ব এখানে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা শহরের উন্নয়নে নানাবিধ মেগা প্রজেক্টের পরিকল্পনা করা হচ্ছে তবে বস্তুত কোনো পরিকল্পনাই ফলপ্রসু হবেনা যদিনা ঢাকামুখী এই জনস্রোত থামানো যায়।

ঢাকার আরেকটি প্রধান সমস্যা হল যানজট। অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থার কারনে ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই ভয়াবহ যানজট দেখা যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর তথ্যমতে ঢাকায় প্রতিদিন নতুন করে পাঁচ শতাধিক গাড়ি রাস্তায় নামে অথচ অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থার কারনে এই গাড়ি গুলোই যানযটকে বাড়িয়ে তুলছে। যানজটের ফলে কর্মস্থলে পৌঁছাতে সময় বেশি লাগে, যা কর্মজীবী মানুষের প্রোডাক্টিভিটিতে প্রভাব ফেলে এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে।

ঢাকা শহরে বায়ু এবং শব্দ দূষণ অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা। বায়ু দূষণের মূল কারণ হল যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্প-কারখানার নির্গমন এবং ধুলাবালি। এই দূষণ জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, যা শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। এছাড়া, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনার অভাবে পানি দূষণও একটি বড় সমস্যা।

ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং জমি ব্যবহার একটি বিশাল সমস্যা। পর্যাপ্ত জনপরিসর, পার্ক এবং খেলার মাঠের অভাবের কারণে বাসিন্দারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে জরুরি সেবা যেমন ফায়ার ব্রিগেড, এম্বুলেন্স ইত্যাদি সেবা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়ে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর চলমান ও প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ঢাকা মহানগরে গত ১০ বছরে ছয়তলা তা ততোধিক ভবনের নির্মানের হার বেড়েছে ৫১৪ শতাংশ। রাজধানী ঢাকা শহরে যে বিল্ডিংগুলো প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে তা যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হচ্ছেনা। অপর্যাপ্ত নগর পরিকল্পনা , সরু গলিপথ , অপর্যাপ্ত সবুজ, এলোমেলো জোনিং রেগুলেশনসহ নানাবিধ জটিলতায় ঢাকা যেনো একটি মৃত্যুপুরী।

স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মান ঢাকায় অপর্যাপ্ত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ঢাকার স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই সংকটের সম্মুখীন। অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ, সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভাব এবং স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকায় বর্তমান স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার অবস্থা উদ্বেগজনক। সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা খুবই সীমিত এবং যেগুলো রয়েছে সেগুলোরও পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং মানব সম্পদের অভাব রয়েছে।

এছাড়া প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, যা স্বাস্থ্যসেবা আরও কঠিন করে তুলেছে। একইভাবে, ঢাকায় শিক্ষার মানও আশানুরূপ নয়। জনসংখ্যার চাপ এবং পর্যাপ্ত স্কুল ও কলেজের অভাবে শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অধিক হওয়ায় এবং শিক্ষকের সংখ্যা কম হওয়ায় শিক্ষার মান নিম্নমুখী। প্রাইভেট স্কুল ও কলেজে শিক্ষার মান কিছুটা ভাল হলেও সেগুলোর খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং কার্যকর শিক্ষাকৌশলের অভাবে শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

ঢাকার একটি বড় সমস্যা হল সামাজিক নিরাপত্তা। উচ্চ অপরাধের হার এবং দুর্বল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে অনেক বাসিন্দা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং ইত্যাদি প্রতিদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকায় ধনী এবং গরিবের মধ্যে বিশাল অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে। উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়, গরিব শ্রেণীর মানুষের জন্য জীবন যাপন কঠিন করে তোলে। এছাড়া, রাস্তায় ভিক্ষুক এবং গৃহহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শহরের সামগ্রিক বাসযোগ্যতাকে ব্যাপক হারে প্রভাবিত করে।

ঢাকাকে বাসযোগ্যতার মানদন্ডে উন্নত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারেঃ
প্রথমত, শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের সংস্কার এবং প্রশস্তকরণ অত্যন্ত জরুরি। সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত, যেমন ইলেকট্রনিক ট্রাফিক সিগন্যাল এবং ট্রাফিক মনিটরিং সিস্টেম।

দ্বিতীয়ত, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যেতে পারে। শহরের যানজট কমাতে মেট্রোরেল, বিআরটি এবং অন্যান্য গণপরিবহন ব্যবস্থা আরও উন্নত ও বিস্তৃত করা উচিত। ঢাকার হাতিরঝিলে চক্রাকার বাস সার্ভিস কিংবা বোট সার্ভিসের মত কিছু অভিনব ট্রান্সপোর্ট মাধ্যম চালু করা যেতে পারে যার ফলে শহরের যানজট কমবে এবং যাতায়াত সহজ হবে।

তৃতীয়ত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির ব্যবহার করে বর্জ্য রিসাইক্লিং এবং কম্পোস্টিং প্রক্রিয়া উন্নত করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।

চতুর্থত, সবুজায়ন এবং উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। শহরের বিভিন্ন স্থানে নতুন পার্ক, উদ্যান এবং খেলার মাঠ নির্মাণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি, বৃক্ষরোপণ অভিযানের মাধ্যমে শহরের সবুজায়ন বৃদ্ধি করা উচিত, যা পরিবেশের মান উন্নত করতে সহায়ক হবে।

পঞ্চমত, জলাবদ্ধতা সমস্যা মোকাবেলার জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন ড্রেন নির্মাণ এবং পুরানো ড্রেন সংস্কার করে বন্যার/বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকার খাল-জলাশয়গুলোকে উদ্ধার করে শহরের সৌন্দর্য বর্ধনেও সিটি কর্পোরেশনের মনোনিবেশ করা উচিত।

ষষ্ঠত, স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষার মান উন্নয়ন করা উচিত। শহরের বিভিন্ন স্থানে নতুন হাসপাতাল, কমিউনিটি হাসপাতাল ও স্কুল নির্মাণ এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নত করতে হবে। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

সপ্তমত, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চালু করে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

অষ্টমত, পরিচ্ছন্ন পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা উচিত। শহরের প্রতিটি এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

সর্বোপরি, দেশ ও বিদেশের অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনার সাথে জড়িত সংস্থাসমূহের সাথে আলোচনা করতঃ কিছু বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ/বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা শহরকে একটি উন্নত, নিরাপদ এবং বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। একই সাথে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কৌশল প্রণয়নে বিভিন্ন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।

লেখক: পরিকল্পনাবিদ, (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং পরিকল্পনা পরামর্শক কার্যক্রমসহ নির্মাণ ব্যবসার সাথে যুক্ত, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক)।

এইচআর/এমএস