ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইতিহাসের এক কালো দিন

এম. নজরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, ০৯ জুলাই ২০২৪

এমন অনেক দিন আছে, যে দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। এই দিনগুলো আমাদের জন্য একেবারেই সুখকর নয়। এই দিনগুলো একেকটি কালো দিন। তেমনই একটি দিন ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই কৃষ্ণতম দিনটির কথা আমরা সবাই জানি। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গানের মতো ১৯৭৫ সালের সেই সকাল ছিল রাতের চেয়েও অন্ধকার। পাখির কুজন ছিল হাহাকারের মতো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে খুনিরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের এক মাস ১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর সভ্যতা ও মানবতার ইতিহাসের এক ভয়ংকর কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বর্বর জাতির তকমা সেঁটে দেয় বাঙালি জাতির গায়ে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক এই আইন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের বিচারকাজ আদালতবহির্ভূত রাখার জন্য এই অধ্যাদেশ বা আইন জারি করা হয়। অধ্যাদেশের মূল কথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের পর খুনিদের যাতে বিচার করা না যায়, সে জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন খুনি মোশতাক। কোনো বিচারকাজ আদালতবহির্ভূত রাখার জন্য আইনসভা যে আইন পাস করে, তাকেই ইনডেমনিটি আইন বলে। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের দৃষ্টিতে সবই সমান এবং কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই আইনগত নিরাপত্তা লাভের সমান অধিকারী। বিচার-প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক মানুষ সমান এবং প্রত্যেকেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই এ ঘোষণা ভঙ্গ এবং সে রকম বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবারই সমান অধিকার রয়েছে। ৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যেসব কাজের ফলে শাসনতন্ত্র বা আইন কর্তৃক মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করা হয়, তার জন্য উপযুক্ত জাতীয় বিচার লাভ বা আদালতের মারফত কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।’ ৩১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক যেকোনো স্থানে অবস্থানরত অবস্থায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রাখে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সংবিধানেই সমতা ও বিচারপ্রার্থীর অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’ অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশি স্বতঃসিদ্ধভাবে কতিপয় মৌলিক অধিকারের মালিক। তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’-এর শুরুতেই ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।

১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নম্বর ৫০ নামে অভিহিত ছিল। অধ্যাদেশের মূল কথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের পর খুনিদের যাতে বিচার করা না যায়, সে জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আইন প্রণয়নের কোনো নজির নেই। মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানবাধিকারের এমন চরম লঙ্ঘন কখনো কোথাও ঘটেনি।

ন্যায়বিচার প্রাপ্তি মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। ন্যায়বিচার পাওয়ার এই অধিকার পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের আইনে ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অথচ বাংলাদেশে খুনিদের শুধু বিচার থেকে দায়মুক্তিই দেয়া হয়নি, তাদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে, পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

আর পেছনে মূল খলনায়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান। মোশতাক খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেও সংবিধান অনুযায়ী এটি ছিল অবৈধ। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে উপরাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী ছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার ছিলেন না। কাজেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণ এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। তদুপরি রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইচ্ছামতো যেকোনো বিধান জারি করতে পারেন না। সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত, কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে: তবে শর্ত থাকে যে এই দফার অধীন কোনো অধ্যাদেশে এমন কোনো বিধান করা হইবে না, (ক) যাহা এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন দ্বারা আইনসংগতভাবে করা যায় না...।’

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক আইন জারি হলেও সংবিধান বাতিল করা হয়নি বিধায় সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, যার দ্বারা আইনের আশ্রয়লাভ এবং জীবনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সে বিধানগুলো বলবৎ ছিল। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হওয়ায় তা শুরু থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হিসেবে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার লাভের নিশ্চয়তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুরু থেকেই অসাংবিধানিক ও বাতিল ছিল। খুনি মোশতাকের অসাংবিধানিকভাবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখল করায় তিনি ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। একজন অবৈধ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা সংবিধানবিরোধী অধ্যাদেশ ছিল আইনের ভাষায় অস্তিত্বহীন ও অবৈধ।

সামরিক আইনের আওতায় এই অবৈধ অধ্যাদেশকে জোর করে বহাল রাখলেও ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারায়। সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইচ্ছা করলে ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু জিয়া খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, অন্য কেউ যাতে ব্যবস্থা নিতে না পারে, সে জন্য দায়মুক্তিকে আরও পাকাপোক্ত করতে দিতে অস্তিত্বহীন, অবৈধ আইনকে সংসদে আইনের মর্যাদা দেন। জিয়াউর রহমান খুনিদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেই থেমে থাকেননি, দূতাবাসে চাকরির যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ব্যবস্থায় খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করেন। জিয়াউর রহমানের পর বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলেও কেউই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি। বরং জিয়া খুনিদের দূতাবাসে যে চাকরি দিয়েছিলেন, এরশাদ ও খালেদা জিয়া তাদের পদোন্নতি দিয়ে বাঙালি জাতির কলঙ্কের দায়কে দীর্ঘায়িত করেছেন। দায়মুক্তি পেয়ে ও দূতাবাসে চাকরি-পদোন্নতি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১২ নভেম্বর প্রথম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাস হয়। সেদিন বিএনপি ও জামায়াতের সংসদ সদস্যরা সংসদে অনুপস্থিত থাকেন এবং খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি বাতিলের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করেন। ইনডেমনিটি আইন বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৭ সালে খুনি শাহরিয়ার রশিদ উচ্চ আদালতে যে রিট দায়ের করেছিলেন, সে মামলায় শাহরিয়ার রশিদের আইনজীবী ছিলেন খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কোরবান আলী। ইনডেমনিটি আইন বাতিল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই হয়ে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত দিনগুলো দেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে। জানতে হবে নতুন প্রজন্মকে। কারণ, ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই আইনটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাস হয়েছিল বলেই জাতি একের পর এক কলঙ্কের দায় থেকে মুক্ত হতে পেরেছে ও পারছে।

দায়মুক্তির দায় থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। কিন্তু ইতিহাসের দায় থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। বিবেকের দায় থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। কিছু মানুষ তো এখনো এই দেশে রাজনীতি করেন, যারা মনেপ্রাণে ইনডেমনিটি আইনকে সমর্থন করেন। এমন কিছু রাজনৈতিক দল আছে, যেসব দল ও তাদের অনুসারীরা বাংলাদেশের সংবিধান মানে না। সামনে একটি নির্বাচন আসছে। এসব দল ও ব্যক্তি হয়তো নির্বাচনেও অংশ নেবে বা নিতে চাইবে। নির্বাচনের ফল বিপক্ষে গেলে হয়তো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে বা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বক্তব্য রাখবে এসব দল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মানে না, জাতির পিতা মানে না, সর্বোপরি সংবিধানে মানে না, এমন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের কি বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার আছে? মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে ব্যবস্থা নেয়া আজকের বাস্তবতায় অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি।

এইচআর/জেআইএম