ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে

শুধু ‘অফিসার’ হওয়ার লক্ষ্য থেকে সরে আসতে হবে

শাহানা হুদা রঞ্জনা | প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ১২ জুন ২০২৪

আমার বন্ধু একটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। কথা প্রসঙ্গে সেদিন বললেন তাদের প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি যে কয়জন এমএলএসএস নিয়োগ পেয়েছেন, তারা সবাই মাস্টার্স পাস। ফলে তাদের চা বানানো বা দোকান থেকে কিছু আনতে বলতে শিক্ষকরা নিজেরাই খুব সংকোচ বোধ করছেন। এছাড়া সারাদিন ফাই-ফরমায়েশ খাটার কাজ থাকেই। ফলে শিক্ষকরা পারতপক্ষে পিয়ন বা এমএলএসএসদের খুব একটা কাজ দিচ্ছেন না। আর এমএলএসএসরা কাজ না পেয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন। ও খুব দুঃখ করে বললো দেখ আমরাও এমএ পাস, ওনারাও এমএ পাস কিন্তু কাজের কত ব্যবধান।

এদিকে খবরে দেখলাম গত ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণির ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এছাড়া রেললাইনের নাট-বল্টু টাইট দেওয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করেন। কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে এসএসসি বা সমমান। যদিও সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস।

শুধু রেলে নয়, যে কোনো চাকরিতেই এখন দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়, তার চাইতে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতাধারী প্রার্থীরা আবেদন করেন। দেশে চাকরির ভয়াবহ অভাব। গড় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ হলে কী হবে? যুব বেকারত্বের হার তো ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে চাকরির যে অভাব রয়েছে, ছোট ছোট পদে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি তারই প্রতিফলন।

আমাদের দেশে যুবক বেকারত্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সরকার দক্ষতা উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দের বড় একটা অংশ খরচ করছে। কিন্তু এরকম বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বরাদ্দ না দিয়ে শিল্পকেন্দ্রিক বরাদ্দ দেওয়া হলে ভালো হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বেসরকারি খাতগুলোও এর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বেকারত্ব কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এসএসসি পাস শ্রমিকের চাকরি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন মাস্টার্স পাস ছেলেমেয়েরা। সত্যিই তো বাবা-মায়ের অনেক কষ্টের টাকা খরচ করে, নিজেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ৫/৬ বছর সময় পার করে এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন চোখে নিয়ে এই ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন, সেকি পিয়ন ও ওয়েম্যান হওয়ার জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সেদিকেই পরিচালিত করছে আমাদের তরুণ সমাজকে।

এই পরিস্থিতিরই প্রকাশ দেখতে পেলাম গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। "বাংলাদেশের যুব বেকারত্ব" নিয়ে এক ওয়েবিনারে তিনি বলেন, দেশে বেকার যুবকদের মধ্যে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশি সময় ব্যয় করেছে, তারাই বেকারত্বের শীর্ষে। এসব শিক্ষিত যুবকরা প্রতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সঙ্গে সমন্বয় করে চাকরি খুঁজতে গিয়ে দীর্ঘসময় বেকারত্বে থাকেন।

"শিক্ষার সাথে বেকারত্বের অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে, আর সেই মিল ইতিবাচক দিক থেকে নয়। শিক্ষা বাড়লেই যে তারা চাকরি পাচ্ছে আমরা তা দেখছি না।" তিনি বলেন, যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ১১ বছর কিংবা তারচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন, সেসব শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। নারীদের মধ্যে যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ৯ বছরের বেশি কাটিয়েছেন, তাদের মধ্যেও বেকারত্বের হার উচ্চ।”

বেকার জীবন একজন তরুণের জন্য ভয়াবহ। বিশেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এবং পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার কথা মাথায় রেখে যেসব তরুণ-তরুণী পড়াশোনা শিখেছেন, দীর্ঘসময় বেকার থাকা তাদের কাছে অভিশাপের মত। তাই তারা বাধ্য হয়ে একটি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যেকোনো কাজে যোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর তথ্য বলছে দেশে বেকারত্বের হার হচ্ছে ৩.৬ শতাংশ। এরমধ্যে যুব বেকারত্ব প্রায় ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া, নিট হার (কোনো প্রকার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানে নিয়োজিত নেই) হচ্ছে ৩০ শতাংশ। ফাহমিদা খাতুন এই হারকে ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেছেন, "অন্যদিকে যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ৭ বছরের কম সময় কাটিয়েছেন তাদের মধ্যে বেকারত্ব খুবই কম। তারা যেকোনো ধরনের কর্মসংস্থানে ঢুকে পড়েছেন।" তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে যে আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ, শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য, মান সবকিছুর মধ্যে একটা বড়ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের পরিবারগুলোতে শেখানো হয় – “লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।”

এই লেখাপড়া বলতে এমএ বিএ পাসকেই বোঝানো হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা সন্তানের কানে সবসময় বলেন এমএ পাস করো তাহলে অফিসার হতে পারবে। কিন্তু এটা এখন একটি প্রহলিকার মতো। পড়াশোনা শিখলেই অফিসার হওয়া যাচ্ছে না। হতে হচ্ছে এমএলএসএস বা রেলওয়ের ওয়েম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ গন্ডি পার হওয়ার পর এই চাকরি খুবই দুঃখজনক একটি প্রাপ্তি।

শুধু তাই নয় ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেতনেও কাজ করছেন অনেক ছেলেমেয়ে বেসরকারি অফিস ও এনজিওগুলোতে। যেহেতু শিক্ষিতদের জন্য চাকরির বাজার খুব খারাপ অর্থাৎ কাজের চেয়ে উচ্চশিক্ষিত মানুষ বেশি, তাই চাকরিদাতা কর্তৃপক্ষ এই সুযোগ গ্রহণ করেন। তারাও যথাসম্ভব কম বেতনে নিয়োগ দেন। এরপর আছে এপ্রিনটিস হিসেবে আরো বছরখানেক কাজ করিয়ে নেয়ার প্রবণতা। যেহেতু কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়ে থাকে, তাই এই অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তরুণ-তরুণীরা মুখ বুঁজে স্বল্প টাকার বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন।

আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাকে অবমূল্যায়ন করা ছোটবেলা থেকে আমাদের কানে মন্ত্র পড়ানো হয় যে পড়াশোনা করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার, শিক্ষক, এডভোকেট হতে হয়, আর কোন পেশা নয়। এমনকি ব্যবসা করার কথাও মাথায় দেয়া হয় না। ইলেকট্রিশিয়ান, প্লামবার, ক্লিনার, নার্স, ড্রাইভার, কাঠের কাজ, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি মেরামতও যে অর্থ আয়ের সম্মানজনক কাজ হতে পারে একথা আমরা, শুনিনি এবং কাউকে এসব হতেও বলি না।

অথচ আমাদের এক বন্ধু কোনভাবে এইচএসসি পাস করেছিল কিন্তু মোটর মেকানিক্স এর কাজটা জানতো অসম্ভব ভালো। তাই আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এরশাদ ভ্যাকেশনের দোলাচলে আছি, তখন ও রীতিমতো কাজ করে টাকা আয় করতো। আমরা এমএ পাস করতে করতে ও জার্মানিতে গিয়ে মেকানিকের কাজ পেয়ে গেল এবং এখন ও জার্মানিতেই মটর মেকানিক্সের বড় ব্যবসায়ী। অফিসার হওয়া ছাড়াও অন্যান্য কাজে সফল হওয়ার এমন আরো নজির আছে।

নতুনভাবে পেশা হিসেবে এসেছে গ্রাফিক্স ডিজাইন, আউটসোর্সিং এর কাজ, অনলাইনে নানাধরনের ব্যবসা এবং আরো অনেককিছু। কম্পিউটার রিলেটেড কাজের ক্ষেত্রে সুযোগ অনেক। দুনিয়াব্যাপী চলছে এই কাজ বা ব্যবসা। এখন এসব কাজ জানলে যে কেউ ঘরে বসেই আয় করতে পারেন।

কেয়ার গিভারের কাজটা দেশে-বিদেশে সমান চাহিদা। এমনকি প্রফেশনাল ডোমেস্টিক হেল্প হিসেবে দেশেতো চাহিদা আছেই, হংকং এও কাজের সুযোগ আছে। ছোট ছোট বিজনেস উদ্যোগ নিয়েও আমরা ভাবি না। সবসময় ক্রোড়পতি হওয়ার স্বপ্ন তাড়িত করে। আর যখন তা হাতের কাছে পাইনা, তখন তৈরি হয় হতাশা। হতাশা থেকেই ছেলেমেয়েরা পথভ্রষ্ট হয়, মাদক গ্রহণ করে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অথবা আত্মহত্যা করে।

আমাদের সময়ে অর্থাৎ সেই ৮০/৯০ এর দশকে ক্যারিয়ার পাথ বা পেশা কী হবে, এনিয়ে পরিবারে কোনো আলোচনাই ছিল না। স্কুলে ’এইম ইন লাইফ’ রচনায় আমরা সবাই লিখতাম ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা। অন্য কোনো পেশার কথা বা ইচ্ছার কথা ভাবতামই না। তখন প্রতিযোগিতা ছিল কম, ফলে এলোমেলো লক্ষ্য নিয়ে ঘোরাফেরা করতে করতে আমরা কোথাও না কোথাও ঢোকার সুযোগ পেয়েছি। তারপর টেনেহিচঁড়ে এত দূর আসতে পেরেছি। যতটুকু আয় করতে পেরেছি, তাতে কোনোভাবে টিকে গেছি।

আমাদের সময়েও কেউ কেউ ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বুঝতে পেরেছিল কোন পথে যাওয়াটা উত্তম হবে। যেমন সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন এবং পরে এমবিএ করে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে ঢুকে যেতে পেরেছে। আরো দুজনকে পেয়েছি যারা বিএ পাস করে ব্যবসা শুরু করে এবং আমরা চাকরি পেতে পেতে তারা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এরকম ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। প্রতিযোগিতা যেমন অনেক বেশি, কাজের ধরন ও ক্ষেত্রও বেশি। শুধু সরকারি চাকরির উপর নির্ভরতা নয়, প্রচুর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাজার দখল করে আছে, আছে ব্যাংক-বীমা, এনজিও। অবশ্য এরপরেও উচ্চশিক্ষিত জনশক্তির তুলনায় কর্মক্ষেত্র কম।

অনেক ছেলেমেয়ে বিদেশ থেকে অথবা ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করছে। এদের ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা, কমিউনিকেশন স্কিল, প্রেজেন্টেশন পদ্ধতি অনেক আধুনিক। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এদেরই খোঁজে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরও যারা মাঝারি মাপের বা মাঝারির চাইতেও কম, তাদের জন্য কাজের বাজার হয়ে পড়ে খুব সীমিত। না পারছেন যেকোনো কাজে যোগ দিতে, না পারছেন পছন্দ মতো চাকরিতে যোগ দিতে।

যেমনটা হয়েছে রেলওয়েতে নিয়োগের ক্ষেত্রে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি কাজে যোগদান করার পর অনেক ওয়েম্যানই তাদের চাকরি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন। আর যারা এখনো কাজ করছেন, তারাও রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো পরিশ্রমের কাজগুলো যথাযথভাবে করতে পারছেন না। ফলে ওয়েম্যান পদে বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ দিয়েও কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছে না সংস্থাটি।

ওয়েম্যানরা লাইন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, লাইনের অ্যালাইনমেন্ট খারাপ থাকলে সেটাকে ঠিক করা, কোথাও কাদা-মাটি জমে গেলে সেটাকে পরিষ্কার করার কাজগুলো করে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হয়। কাজগুলো করতে হয় পায়ে হেঁটে। সঙ্গে রাখতে হয় গাঁইতি, শাবল, কোদালের মতো উপকরণ (সূত্র: বণিক বার্তা)। একজন মাস্টার্স পাস ছেলের পক্ষে কাজের এই ধরন ও স্ট্রেস মেনে নেয়াটা অসম্ভব। তাই তারা কাজ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন এবং সেটাই স্বাভাবিক।

যে চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি, সেখানে মাস্টার্স পাস ছেলেমেয়েদের ডাকা হলো কেন? এতে করে স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু এই কাজে যোগ্য মানুষটির চাকরি হলো না। অন্যদিকে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে যাদের নিয়োগ দেয়া হলো, তারাও টিকে থাকতে পারছে না, রেলওয়ের জন্য লস হলো।

আমার ধারণা হচ্ছে বন্ধুর কলেজটিতেও মাস্টার্স পাস এমএলএসএসরাও কাজ করতে পারবেন না। উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এ পদে মানিয়ে নিতে পারবেন না। মূলত লেবার (শ্রমিক) শ্রেণীর পদের জন্য যে কাজ, মাস্টার্স পাস মানুষ সেখানে দরকার নেই, দরকার সেই কাজ করার মতো লোক। সুইপার পদের জন্য এমন অনেকেই আবেদন করে থাকেন, যারা গ্র্যাজুয়েট। এতে করে যারা পেশাদার সুইপার ও ক্লিনার সেইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আমরা জানি উচ্চশিক্ষিত মানুষ কাজ হারালে, আবার কাজ পাওয়াটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কভিডকালে যারা কাজ হারিয়েছেন, তারা আর সেই মাপের কাজ পাননি। কিন্তু পড়াশোনা কম জানা মানুষ, কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ কেউ বেকার থাকেননি। আমাদের এলাকায় যে ছেলেটি ইলেকট্রিশিয়ান ও প্লামবার, সে এইট পাস।

এইসব কাজ শিখে এখন সে ‘হরফুন মউলা’। কভিড কাল, এর আগে ও পরে কোনোদিনই ওর কাজের অভাব হয় না। সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ অব্দি ব্যস্ত। মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয়। ঢাকার পাশে জমিও কিনেছে। একই অবস্থা রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন ও এসির মিস্ত্রির। গাড়ির মেকানিকের চাহিদা আরো এক ধাপ উপরে। এদের কাজের কোনো অভাব নেই।

আমাদের মাইন্ডসেটটা এমন হয়েছে যে কম ক্লাস পর্যন্ত পড়া বা কারিগরি কাজ করাকে আমরা কম মর্যাদা দেই দেশের ভেতরে। অথচ বিদেশে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে গিয়ে সবধরনের কাজ করতে পারি। বাইরের দেশগুলোতে সবধরণের কাজকে মর্যাদার চোখে দেখা হয় বলে, সবাই সব কাজ করতে পারে। কোন লজ্জা বা হীনমন্যতাবোধ কাজ করে না। যারা হোয়াইট কলার জব করবেন, অধ্যাপনা বা রিসার্চ করবেন, তারাই শুধু টাকা খরচ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। কারণ আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপে উচ্চশিক্ষা খুব ব্যয়বহুল।

বাকিরা বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়ে যেকোনো কাজে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কারিগরি শিক্ষা তাদের সবার জন্য কাজের অনেক দরজা খুলে দিয়েছে। সেখানে কাজের ছোট-বড় কোনো মাপকাঠি নেই। যেকোনো কাজই সম্মানজনক। শুধু কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সততা বিচার করা হয়।

ব্যবসা ক্ষেত্রেও প্রডাক্ট খারাপ দিলে টিকে থাকা যাবে না। আমাদের দেশে পেশাকে সম্মান করতে শিখিনি আমরা, পদকে সম্মান করতে শিখেছি। অফিশিয়াল কাজ ছাড়া অন্য কাজকে অসম্মানের চোখে দেখি। তাই ছেলেমেয়েরা সরকারি চাকুরি, পুলিশের চাকরি বা অন্য কোনো ডেস্ক জবের দিকে ধেয়ে যাচ্ছেন। যার ফলস্বরুপ উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রকট, হতাশার হার আরো বেশি।

বেকারত্ব হার নির্ধারণের বিদ্যমান পদ্ধতির সমালোচনা করে অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নীতিমালা অনুযায়ী যারা সপ্তাহে কম হলেও একঘণ্টা কাজ করেন, তাঁদের কর্মে নিয়োজিত বলা হয়। সে অনুযায়ী, বিআইডিএস দেশে বেকারত্বের হার চার শতাংশের নিচে দেখাচ্ছে। আসলে এটা আমাদের দেশের প্রকৃত বেকারত্বের চিত্র নয়। কারণ আমাদের দেশে মানুষ এক ঘণ্টার জন্য (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) কাউকে কাজে নেন না।

গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যতোটা হয়েছে, সেই তুলনায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ক্রমান্বয়ে কৃষিখাতে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। কৃষিতে নারী শ্রমিক বাড়ছে, যাদের আয় পুরুষের তুলনায় অর্ধেক। আমাদের দেশে শিল্পখাতে মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশ এবং সেবাখাতে প্রায় ৬৮ শতাংশ অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মরত। এসব অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান দিয়ে উপযুক্ত কর্মসংস্থান সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডি’র নির্বাহী প্রধান।

আগেও উল্লেখ করেছি দেশে কর্পোরেট, বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক, বিজ্ঞাপণী সংস্থা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে চৌকস তরুণ-তরুণীদের চাহিদা বেড়েছে। সেখানে সাধারণ রেজাল্ট করে, গা-ছাড়া ভাব নিয়ে, পড়াশোনা কম করে, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় পারঙ্গম না হলে, কম্পিউটার প্রযুক্তিতে দক্ষ না হলে কাজ পাওয়া খুব কষ্টকর।

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনেকেই পড়াশুনা শেষ করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চাইছেন। অথচ তাদের সে ধরনের পড়াশোনা, ভাষাগত ও কমিউনিকেশন দক্ষতার অভাব রয়েছে।

সরকারি চাকুরির স্থায়ীত্ব ও সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সরকারি চাকুরির প্রতি একটা মোহ তৈরি হয়েছে। তারা বছরের পর বছর এই চাকুরির জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। আগে গ্রাম বা শহরের বাইরে থেকে আসা ছেলেমেয়েরা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকতো। এখন শহরের ছাত্ররাও বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সেকারণে প্রতিযোগিতা অনেকটাই বেড়েছে। অবশ্য প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেও চাকরির জন্য দক্ষতা, প্রশিক্ষণ কতটা অর্জন করতে পারছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আমাদের দেশে যুবক বেকারত্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সরকার দক্ষতা উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দের বড় একটা অংশ খরচ করছে। কিন্তু এরকম বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক বরাদ্দ না দিয়ে শিল্প-কেন্দ্রিক বরাদ্দ দেওয়া হলে ভালো হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বেসরকারি খাতগুলোকেও এর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তারা আরো মনে করেন যে দেশে অসংখ্য তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে নাম লেখাচ্ছেন।

কিন্তু একদিকে যেমন তাদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুযোগের অভাবে এদেরকে দক্ষ শ্রমশক্তিতেও পরিণত করা কঠিন হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্তরে যেন মানসম্মত মানুষ নিয়োগ দেয়া যায়, সে ব্যবস্থাই করতে হবে। মূল কথা হচ্ছে, শুধু অফিসার হওয়ার জন্য পড়াশোনার লক্ষ্য থেকে সরে আসতে হবে। তরুণ-তরুণীরা যেন উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তুলনামূলক কম শিক্ষাগত যোগ্যতার চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য না হন, সেটা দেখতে হবে।

১০ জুন, ২০২৪

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন