ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৪

ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ প্রতিরোধ এবং খরা সহনশীলতা

ড. মতিউর রহমান | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০৫ জুন ২০২৪

প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়, যা আমাদের গ্রহের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জোরালো আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) নির্ধারিত এ বছরের থিম বা প্রতিপাদ্য “Land restoration, desertification and drought resilience” । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় উক্ত ইংরেজি থিমটির ভাবানুবাদ করেছে “করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা/অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা”।

এই বছর, থিমটি একটি তীব্র প্রয়োজনীয়তার সাথে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কারণ ভূমিক্ষয়, মরুকরন এবং খরা আগামীর পৃথিবীর জন্য জ্বলজ্যান্ত সমস্যা হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। ২০২৪ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজক দেশ হয়েছে সৌদি আরব। আয়োজক দেশ হিসেবে এই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে আমাদেরকে প্রখরভাবে সচেতন হওয়া ও কার্যকর পন্থা গ্রহণের জন্য সকলকে #GenerationRestoration সামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছে। এ বছরটি United Nations Convention to Combat Desertification (UNCCD) এর ৩০তম বার্ষিকীকে চিহ্নিত করে।

UNCCD এর তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেককে সরাসরি প্রভাবিত করছে এবং বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় অর্ধেক (৪৪ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার) হুমকির মুখে পড়েছে। ২০০০ সাল থেকে খরার সংখ্যা এবং সময়কাল ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে – কোনো জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, খরা ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশকে প্রভাবিত করতে পারে।

ভূমি অবক্ষয়, মরুকরণ এবং খরা আমাদের এই প্রিয় গ্রহের জন্য জরুরি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে, আমরা যদি একসাথে কাজ করি, তাহলে আমরা এই সমস্যাগুলি সমাধান করতে এবং আরও টেকসই ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারি।

UNCCD এর তথ্যানুযায়ী, দুই বিলিয়নেরও বেশি হেক্টর জমি ইতিমধ্যে অবক্ষয়িত হয়েছে, যা পৃথিবীর ভূমির এক তৃতীয়াংশ। বিশ্বব্যাংক এর হিসাব অনুযায়ী ভূমি অবক্ষয় প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি করে। আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) অনুমান করে যে জলবায়ু পরিবর্তন ভূমি অবক্ষয়কে আরও তীব্র করবে, কারণ এটি আরও চরম আবহাওয়ার ঘটনা এবং উষ্ণতা এবং বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন ঘটাবে।

মরুকরণ এবং খরা প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রধান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি। বিশ্বের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ ইতিমধ্যেই কমবেশি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে বছরে গড়ে দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা নতুন করে মরুকরণের জন্য পরিবেশগত বিপর্যয় দায়ী।

এটি শুধুমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয় বরং একটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ যা আমাদের সকলকে প্রভাবিত করে। অধিকন্তু, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার কারণে উর্বর জমির বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষয় হচ্ছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে ভূমি ক্ষয় ও মরুকরণের বিস্তার রোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মরুকরণ এবং খরা বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে মরুকরণ এবং খরার কারণে আগামী দশকে সারা বিশ্বে ৭৫০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) একটি সমীক্ষা বলছে, ৩০ বছরে মানবজাতির চাহিদা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। ফলে, এখনকার তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ খাবার বেশি প্রয়োজন হবে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন যে তখন খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের ঘাটতি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এ থেকে সংঘাত শুরু হওয়াও অসম্ভব নয়। আর এই সংঘাতের অন্যতম কারণ হবে মরুকরণ ও খরা।

আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বা ঘূর্ণিঝড়-প্ররোচিত সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, মাটির লবণাক্ততা বাড়ছে এবং ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি না হওয়া বা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এতে সামগ্রিকভাবে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের বর্তমান হার, প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা কমপক্ষে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়াবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৭ থেকে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ তাপমাত্রা ১.৮ থেকে ৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। সংস্থাটির মতে, শিল্প বিপ্লব শুরুর সময়ের তুলনায় ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০.৪৪ থেকে ০.৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে, এটি ১.৩ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।

বাংলাদেশের নিচু উপকূলীয় এলাকাগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অদূর ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার একটি বড় অংশ সমুদ্রের নিচে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এটি অনুমান করা হয় যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ এবং ২০৮০ সালের মধ্যে ৪.৩ মিলিয়ন মানুষ তাদের জমি হারাতে পারে।

এটি শুধুমাত্র সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সরাসরি প্রভাব বিবেচনা করে বলা হয়েছে। লবণাক্ততা, জমির উর্বরতা হ্রাস, প্লাবন, নদীভাঙন এবং অন্যান্য প্রভাব বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে ২০৮০ সাল নাগাদ বৃহত্তর উপকূলীয় এলাকা থেকে ৫ থেকে ৯ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। জীবিকার তাগিদে বহু মানুষ চলে যাবে শহরে। শহরে নতুন নতুন বস্তি গড়ে উঠবে, যা পরোক্ষভাবে পরিবেশ বিপর্যস্ত করবে।

বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, আমাদের দেশও মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মরুকরণের প্রধান কারণগুলি হল-বিস্তৃত এলাকায় জমির অনুর্বরতা, নদী ও খাল শুকিয়ে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের অভাব।

বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে এই লক্ষণগুলো খুবই সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মধ্য ও উপকূলীয় এলাকায় খরাপ্রবণ এলাকা বিস্তৃত হবে। এর প্রভাব পড়বে কৃষি ও সামগ্রিক পরিবেশের ওপর।

আরেকটি ঝুঁকি হল, যে জলাধারগুলি বৃষ্টির জল ধরে রাখে সেগুলিও বিপন্ন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাভূমির নির্বিচার ভরাটের কারণে এগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে কয়েক দশক ধরে অধিকাংশ স্থানে নদীগুলো সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় ১১৭টি নদী। প্রতি বছরই নদীর কিছু শাখা পলি পড়ায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, স্বাদু পানি এবং উপকূলীয় এলাকায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাত বাড়বে এবং বন্যা, খাদ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যাবে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মাত্রা বাড়বে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং হিমালয়ের হিমবাহ আরও গলে যাওয়ার ফলে, পাদদেশগুলি বিপর্যয়কর বন্যার মুখোমুখি হবে। এই সম্ভাব্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অবনমিত (ক্ষতিগ্রস্ত) জমি পুনরুদ্ধার জরুরিভাবে প্রয়োজন। এটিই সবচেয়ে ভালো সমাধান হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।

তবে আশার কথা, ভূমি অবক্ষয় রোধ, মরুকরণ প্রতিরোধ এবং খরা সহনশীলতার জন্য অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেসবের কার্যকর বাস্তবায়ন ভবিষ্যৎ দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।

ভূমি অবক্ষয়, মরুকরণ এবং খরা আমাদের এই প্রিয় গ্রহের জন্য জরুরি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে, আমরা যদি একসাথে কাজ করি, তাহলে আমরা এই সমস্যাগুলি সমাধান করতে এবং আরও টেকসই ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারি।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৪ আশা এবং ক্ষমতায়নের বার্তা বহন করে। আমাদের জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সম্পদ আছে পৃথিবীকে নিরাময় করতে। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের সামগ্রিক ইচ্ছাশক্তি নিয়োজিত করা এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া। তবে, একসাথে কাজ করে, #GenerationRestoration এই স্লোগানটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে, আমরা ভূমি অবক্ষয়, মরুকরণ প্রতিরোধ ও খরা সহনশীলতার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারি এবং মানবতা এবং প্রকৃতির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারি।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন