ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজশাহীতে মামলা: শঙ্কা বাড়ছে সাইবার আইনে

গোলাম সারওয়ার | প্রকাশিত: ০৯:২৮ এএম, ২৬ মে ২০২৪

 

রাজশাহীতে কর্মরত একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাইবার আইনে মামলা হয়েছে। টিভিতে সংবাদ প্রচারের কারণে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রাজশাহীর সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাটি দায়ের করেন। ঐ সাংবাদিকের নাম কাজী শাহেদ। তিনি রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে দেশ টিভি ও বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি।

সাইবার নিরাপত্তা আইনে রাজশাহীতে এটিই প্রথম মামলা। সংবাদ প্রচারের জেরে ৯মে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমন। কাজী শাহেদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মামলাটি প্রত্যাহারের দাবিতে রাজশাহীর বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন এবং সম্মিলিত নাগরিকসমাজ ফুঁসে উঠেছে। মানববন্ধন, পথসভা, প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বিবৃতির মাধ্যমে তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রাজশাহীর পবা উপজেলার মুসরইল এলাকায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা শামসুল আরেফিনের শতকোটি টাকা মূল্যের ৯ বিঘা জমি নিয়ে কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমন এবং তার ব্যবসায়িক পার্টনার শামসুজ্জামান আওয়ালের সাথে অনেকদিন ধরেই গন্ডগোল চলছে। এই গন্ডগোলকে কেন্দ্র করে শামসুল আরেফিন ঐ দু'জনের বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বরে চন্দ্রিমা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।জমির মালিকের আরও অভিযোগ, তারা নানা কৌশলে ঐ জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি তিনি প্রাণনাশেরও আশঙ্কা করছেন।বিবদমান দুই গ্রুপের জমিকেন্দ্রিক এই সব ঘটনা নিয়ে ৬ মে সংবাদ প্রচার হওয়ায় কাউন্সিলর সুমনের মানহানি ঘটে, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন এবং এলাকাবাসীর প্রশ্নের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি দায়ের করেন বলে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়।

একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অবশ্যই মামলা করার অধিকার রাখেন। কিন্তু বেশ কিছুকাল ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিংবা সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করার প্রতি আগ্রহ বেশি। প্রশ্নটি এখানেই।সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্যতো প্রেস কাউন্সিলে নির্দিষ্ট আইন আছে। কিন্তু সেখানে কেন নেতা-কর্মীরা যাননা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম বলেছেন," সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে,সেটি প্রেস কাউন্সিল আইন।১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের সাংবাদিকদের জন্য প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেছিলেন। সাংবাদিকদের বিচার হবে প্রেস কাউন্সিল আইন দ্বারা- এটিই মূলতঃ সাংবাদিকবান্ধব আইন"। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সৈনিক বলে দাবি করেন, তারাই বঙ্গবন্ধুর তৈরি আইনকে পাশ কাটিয়ে পূর্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করার প্রবণতা বেশি বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রশ্ন রয়েছে,তাহলে এই সাইবার আইনের আলোচিত-সমালোচিত ধারাগুলো কাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে?

এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানান, সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার জন্যই মূলত: এই দুটি আইনের কয়েকটি আলোচিত ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। কারণ, ক্ষমতাসীনরা গণমাধ্যমকে সবসময় নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এই আইন সংশোধনের প্রবক্তারা আগে থেকেই বলে আসছেন, ভিন্নমত, সমালোচনা ও মুক্তচিন্তা দমনের ভয়ঙ্কর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এই আইনের আলোচিত- সমালোচিত কয়েকটি ধারা। পূর্বের ডিজিটাল এবং বর্তমানের সাইবার সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই আশঙ্কা ও উদ্বেগ জানিয়েছিল দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিক ইউনিয়নসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এই আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়ে বার বার উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।সাইবার আইনের আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তর থেকে সরকারকে এই আইন সংশোধন করার জন্য কিছু সুপারিশসহ চিঠিও পাঠায় তারা।

চলতি সালের ৩০ এপ্রিল ডেইলি স্টারের অনলাইন একটি প্রতিবেদনে 'রিপোর্ট সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস)'এক গবেষণার তথ্য উদ্ধৃতি করে জানানো হয়,২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৪৫১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।তাদের মধ্যে ২৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তাদের লেখা রিপোর্টের জন্য। অন্ততঃ ৯৭ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার লেখক মোশতাক আহমেদ কারাগারে মারা যান। এই মামলায় কার্টুনিস্ট কিশোরও দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারসহ অনেকেই এখনও কারাগারে আছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসকদের এক সন্মেলনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের কথা স্বীকার করে বলেন,এই আইনের কিছু মিসইউজ ও কিছু অ্যাবিউস হয়েছে। এই অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে বলে তিনি ঐ সন্মেলনে জানিয়েছিলেন।

অবশেষে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ পাস হয়।সংসদে বিরোধীদলের সদস্যরা বিলটির ৪২ ধারার অপপ্রয়োগের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে এ ধারাটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলেছিলেন,এই ধারায় সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল বা অন্য কোনো সংস্থার পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধান রাখা হয়।বিলটির সমালোচনা করে তারা বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত সাইবার নিরাপত্তা আইনটিও মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা,গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সাংবাদিকদের জন্যও হুমকি হবে। এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই আশঙ্কা ও উদ্বেগ জানিয়েছিল, সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিক ইউনিয়নসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। তারা বারবার এই আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়ে উদ্বেগ এবং আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধনে কথা জানিয়েছিল।

সম্পাদক পরিষদ সাইবার নিরাপত্তা বিল পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এই আইনকে নিবর্তনমূলক আইন দাবি করে এক যুক্ত বিবৃতি দেয়। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাথে তুলনা করে বলেন,খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং এ আইন সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত হবে।

আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেফতারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ।এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের 'বিচারিক ক্ষমতা' দেওয়া হয়েছে, যা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়'। আমাদের দেশে পুলিশের কর্মকান্ডের প্রতি জনগণের আস্থা একেবারে তলানীতে। সেই পুলিশকে এই ক্ষমতা দেওয়ায় ধারাটি প্রশ্নবিদ্ধ। এই আইন পাস হওয়ার প্রাক্কালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন,"তারা সাংবাদিকসহ বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে পাওয়া ৯১৭টি সুপারিশ বিশ্লেষণ করে আগের ডিজিটাল আইনটিতে সে মোতাবেক পরিবর্তন এনেছেন"।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল এই আইন পাস হওয়ার কিছুদিন পূর্বে ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে এই আইন সম্পর্কে মতামত/প্রস্তাব নেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।প্রথম আলোয় প্রকাশিত "সাইবার নিরাপত্তা আইন :রূপে নতুন,নাচটা আগের মতই" এই শিরোনামে তার লেখার এক পর্যায়ে এ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,বলাই বাহুল্য আমাদের কোনো কথাই শোনা হয়নি। অংশীজনের মতামত নেওয়া হলো। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কিছু ধারায় জামিনের সুযোগ বাড়ালো বটে,কিন্তু কিছু ধারায় অস্বাভাবিক জরিমানার বিধান করা হলো। সেই জরিমানা দিতে না পারলে জেলে যাওয়ার খড়গ মাথার উপর ঝুলেই থাকলো।

মজার ব্যাপার হলো, সংসদীয় কমিটির সভায় যে প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপনা করা হয়, সে সময় এই আইনের ৪২ ধারার পুলিশের 'সাব ইন্সপেক্টরের' বদলে 'ইন্সপেক্টরের' কথা বলা হলেও আইনে তা হয়ে গেল 'পুলিশ অফিসার'। এই আইনের পর্যালোচনা করে ঐ লেখায় তিনি বলেন,২৫,২৮,২৯ (অতিরিক্ত জরিমানা) ও ৩১ ধারায় অপরাধের অস্পষ্টতা রেখে ৪২ ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতই হুবহু বহাল রাখায় উদ্বেগ কাটলোনা। এতে আইনের মিসইউজ ও অ্যাবিউজ হওয়ার শঙ্কা থাকছেই। যে স্বস্তি উদ্বেগ এবং ভয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়,তাকে পুরো স্বস্তি বলা যায়না। সংবাদকর্মীরা ধারা ৪২ এর খপ্পরে আগেও যেমন পড়েছেন, এবারও রেহাই মিলবেনা"।

সংসদে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস বিষয়ে ২০২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে এক বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়,"যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সংসদে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) পাসের বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। আমরা মনে করি এটা দুঃখজনক যে, নতুন আইনটির আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার অংশীজনদের এটি পর্যালোচনা এবং তাদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করার পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়নি।

দুর্ভাগ্যবশত, সাইবার নিরাপত্তা আইন অনেক দিক দিয়েই এর আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো। এই আইনেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, জামিন অযোগ্য ধারা বহাল রাখা হয়েছে এবং সমালোচকদের গ্রেপ্তার, আটক ও কণ্ঠরোধ করতে খুব সহজেই এর অপব্যবহার হতে পারে"।

সাইবার নিরাপত্তা আইন- ২০২৩ এর আলোচিত-সমালোচিত ধারাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পূর্বের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে মৌলিক তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আইনটিতে শুধু কয়েকটি ধারা পরিবর্তন, সাজার পরিমাণ কমানো এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে আগের আইনের বিদ্যমান আশঙ্কার জায়গাগুলো রয়েই গেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। [email protected]

এইচআর/এমএস