ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু ও দুই শিবিরের প্রতিক্রিয়া
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর দেশটির সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এবং দেশটির কেবিনেট তাদের বিবৃতিতে দুঃখপ্রকাশের পাশাপাশি বলেছে, এ মৃত্যুর কারণে ইরানের কার্যক্রমে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ইরানের নীতিতেও কোনো পরিবর্তন আসবে না। মজার বিষয় হল, ঠিক একই কথা বলেছে ইসরায়েলের একাধিক গুরৃত্বপূর্ণ নেতা। সাবেক অর্থমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী আভিগদোর লিবারম্যান বলেছেন, রাইসির মৃত্যুতে ইরানের কোনো পরিবর্তন আসবে না। রাইসি তথা ইরানের প্রেসিডেন্ট সুপ্রির লিডারের পলিসি বাস্তবায়ন করেন, নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। ইসরায়েলের মিডিয়া এবং অন্যান্য নেতাদেরও একই বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তবে রাইসির মৃত্যু তথা জীবনাবসান প্রশ্নে দুই পক্ষের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। সারা বিশ্ব যে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে আছে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই প্রতিক্রিয়া থেকে। ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ সৈয়দ আলী খোমেইনি গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ইরান তার আন্তরিক ও মূল্যবান সেবক হারিয়েছে। তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ এবং তারমধ্যে কোনো ক্লান্তি ছিল না। জাতির কল্যানের প্রশ্নে ছিলেন ডেডিকেটেড। তিনি তো বলবেনই, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাইসির মৃত্যুতে জাতিসংঘের মহাসচিব শোক জানিয়েছেন, পোপ শোক জানিয়েছেন; শোক জানিয়েছে জাপান, মিশর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, সুদান, সিরিয়া, তুরস্ক, ভেনিজুয়েলাসহ আরো কয়েকটি দেশ। এদের কোনো কোনো দেশ শুধু অফিসিয়াল বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, ব্যক্তি রাইসির প্রশংসাও করেছে। কিন্তু ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইসরায়েলসহ বেশ কিছু দেশ। ইহুদি ঐতিহ্য অনুসারে নিয়ম হল, যে কোনো মানুষের মৃত্যুতে শোক জানাতে হবে। সে হোউক ইহুদি অথবা অন্য ধর্মের লোক। কিন্তু ইসরায়েল এবং দেশটির জনগণ তা করেনি। তারা কারণ হিসাবে ব্যখ্যা করেছে, রাইসি শুধু কট্টরপন্থীই নয়, সন্ত্রাসের অন্যতম মদদদাতা। তাকে ইসরায়েল এবং পশ্চিমা ইরান-বিরোধী দেশগুলোতে বলা হয় বুচার অব তেহরান, অর্থাৎ তেহরানের কসাই। ২০২১ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর রাইসি হিজাব এবং নারীর কুমারিত্বের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান অবলম্বন করেন। ইরানের ভিন্ন দৃষ্টির নারী মাশা আমিনির মৃত্যুর পর যে বিক্ষোভ হয় তাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় এবং কয়েক শ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় রাইসি বলেন, ‘বিশৃ্খংলা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়’। তিনিই কঠোর হস্তে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনের আদেশ দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হল, ইরানে ১০ হাজারের মত ইহুদি নাগরিক রয়েছে। তেহরান জিউস অ্যাসোসিয়েশন রাইসির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বলেছে, ‘তিনি ছিলেন কমপ্যাশনেট এন্ড ডেডিকেটেড। তার মৃত্যু হৃদয় ভাঙা এবং চোখে জল আনার মত।’ অবশ্য ইসরায়েল ও পশ্চিমারা মনে করছে, এই বিবৃতি ইরানের ইহুদিরা দিতে বাধ্য তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে।
ইরান-ইসরায়েল একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ইরানের আল-কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেলর কাশেম সোলায়মানিকে বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। গত এপ্রিল মাসে সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়ে ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ডের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এই দুটি ঘটনার পরই ইরান প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং জাহেদির হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইরান সরাসরি ক্ষেপনাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েলের উপর। ৩০০ ড্রোন, মিসাইল ও রকেট হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জর্দান মিলে সেই হামলার ৯৯ শতাংশ প্রতিহত করে। তারপরপরই ইসরায়েল ইরানের ইস্ফাহানে হামলা চালায়। সেখানে রয়েছে ইরানের পরমাণু প্ল্যান্ট। যদিও ইরান হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হয়নি বলে জানিয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি কতটা হয়েছে তা স্পষ্ট জানা যায়নি।
গত রোববার রাইসসহ হেলকপ্টারে থাকা ৯ জনই নিহত হয়েছেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমিরাব্দুল্লাহিয়ান, তাব্রিজের শুক্রবারের প্রার্থনার নেতা আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী আল-ই-হাশেম, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্ণর মালেক রাহমাতি। এই দুর্ঘটনা এমন এক সময় ঘটল, যখন ইরান একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার হামাস ও লেবাননের হেজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিদের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিপক্ষে প্রকাশ্যেই সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইরান। ফলে অনেকের মনেই একটি সন্দেহ খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে: এই দুর্ঘটনা কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি অন্যকিছু?
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ।
এইচআর/জেআইএম