ইসরায়েলের গণহত্যা ও শব্দের আধিপত্য/৩
সন্ত্রাস কী? সন্ত্রাসী কে?
সন্ত্রাসী বা টেররিস্টদের সংজ্ঞা সব সময় বদলেছে। বিদ্যমান কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তাদের সব সময় সন্ত্রাসী বলা হয়। আর এই ‘সন্ত্রাসী’রা মনে করে তারা মুক্তির জন্য লড়াই করছে। আমাদের অগ্নিযুগের কথা ধরা যাক, ১৯০০ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত। ইংরেজরা সব সময় একে সন্ত্রাসী তৎপরতা বলেছেন। আর ঐতিহাসিরাও একে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন,
১৯০০-১৯১৮ সালে বাংলায় বেশ কিছু সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে, যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করা। এই সশস্ত্র আন্দোলনকে ব্রিটিশরা উল্লেখ করেছিল টেররিস্ট মুভমেন্ট হিসেবে। বাঙালি ঐতিহাসিকরা যাকে উল্লেখ করতেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসেবে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠলে পুরনো ডিসকোর্স বাতিল হয়ে যায়, রূপ নেয় নতুন ডিসকোর্স এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হয়ে ওঠে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন। অবশ্য, এখনও প্রায় পাঠ্যপুস্তকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন রয়ে গেছে। ১৯০০ থেকে ১৯১৮ এর প্রথম পর্ব বলা চলে। ১৯৩০ সালে সূর্যসেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
এটি বোধ হয় অস্বীকার করা যাবে না অস্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ইংরেজ ও তাদের দোসরদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ‘সন্ত্রাস’ এমন একটি শব্দ যে শব্দের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো অর্থ নেই। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় শব্দটি পরিচিত হয়ে উঠেছিল ব্যাপকভাবে এবং সে থেকে এর সংজ্ঞা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক যার অবসান হয়নি এখনও, বরং সৃষ্টি হয়েছে জটিলতার।
ইসরায়েলতো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম, প্রত্যেক রাজনীতিবিদ হামাসকে টেররিস্ট আখ্যা দিচ্ছে। এদের প্রচার এতো ব্যাপক ও তীব্র যে, কেউ হামাস সামাজ্যবাদী ও নিষ্ঠুর কলোনির শাসক থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে, ফাননের ভাষায়, তা বলার সাহস কেউ রাখছে না। হয়তো, প্যালেস্টাইন কখনও রাষ্ট্র হলে বা রাষ্ট্র না হলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের ইতিহাসে ফাতাহ, হামাস বা এধরনের গ্রুপকে মুক্তির নায়ক হিসেবেই উল্লেখ করবে। যেমন, ১৯৭১ সালের তথাকথিত ‘দুর্বৃত্ত’ বা ‘টেররিস্টদের’ আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলি।
সাধারণভাবে, নিছক সন্ত্রাস বলতে বোঝায় কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর শারীরিক হামলা যা অন্তিমে ঘটায় তার মৃত্যু। আসলে সন্ত্রাসকে কীভাবে ব্যবহার করছে তার ওপর নির্ভর করে সন্ত্রাসের চরিত্র। এ পরিপ্রেক্ষিতে পল উইলকিনসন তাঁর পলিটিক্যাল টেররিজম সন্ত্রাসকে কয়েকভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, ‘ক্রিমিন্যাল টেররিজম’। এ সন্ত্রাস ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিগত স্বার্থে যা কোনভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, আছে ‘রিলিজও- ম্যাজিকাল টেররিজম’, যার মাধ্যমে ওঝা, গুণীন, মনস্তাত্ত্বিক ভয়ের সৃষ্টি করে।
আমরা আলোচনায় এ ধরনের ‘সন্ত্রাস’কে বাইরে রাখব। আমরা সে ধরনের সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা করব যা উইলকিনসনের ভাষায় ‘পলিটিক্যাল টেরিজম’ বা রাজনৈতিক সন্ত্রাস। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সন্ত্রাস ব্যবহার নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। যেমন, র্যাডিকালরা মনে করেন, এমন কার্যকলাপ যার সঙ্গে সন্ত্রাসের ‘কনভেনশনাল ইমেজ’ এর কোন মিল নেই, কিন্তু যার কারণে সৃষ্টি হতে পারে যাতনার, হতে পারে মৃত্যু, তাও সন্ত্রাস, যেমন দারিদ্র্যও সন্ত্রাস। কিন্তু এ ধরনের সংজ্ঞা সন্ত্রাসকে নির্বস্তুক পর্যায়ে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, পুঁজিবাদী সমাজে সন্ত্রাস সম্পর্কে ধারণা খানিকটা রক্ষণশীল যা আবার জনপ্রিয় কর্তৃপক্ষের কাছে। তারা সন্ত্রাসকে পূর্ণ সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন এ ভাবে- ÔSo that it both excludes legalized violence yet includes many forms of non-legal or non-authorized action which are quite potently non-violent...Õ [অ্যাস্থনি আর্বলাস্টার, ‘হোয়াট ইজ ভায়েলেন্স?]
অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগ আছে বিপ্লবের। কারণ বিপ্লবের কোনো না কোনো পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় সন্ত্রাস, কিন্তু বিপ্লব তখনই সম্পন্ন হয়েছে যখন সন্ত্রাস সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করতে পারে সরকারের রূপ, সৃষ্টি করতে পারে নতুন ‘বডি পলিটিক’, পরিবর্তন যেখানে সূচনা করে নতুন যুগ এবং নির্যাতন থেকে মুক্তির লক্ষ্য হয় স্বাধীনতা।
উইলকিনসন রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বের বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির কার্যাবলী পর্যালোচনা করে তিনি এ বৈশিষ্ট্যগুলি খুঁজে পেয়েছেন, বৈশিষ্ট্যগুলি হলো-
১. এ ধরনের সন্ত্রাস ব্যবহার করে একটি গ্রুপ; হতে পারে সে গ্রুপ খুব ক্ষুদ্র। ব্যক্তিগত কারণে ব্যবহৃত হয় না সন্ত্রাস।
২. থাকে এ গ্রুপের একটি বিপ্লবী আদর্শ বা কর্মসূচি যা সন্ত্রাসের যৌক্তিক ভিত নির্মাণ করে।
৩. নেতৃত্ব যা জনগণকে সন্ত্রাসের প্রতি ‘মবিলাইজ’ করতে সক্ষম।
৪. বিপ্লবী সন্ত্রাস বিকল্প প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করে।
৫. এ আন্দোলনের প্রধান গুণ হচ্ছে অস্ত্র সংগ্রহ, সে অস্ত্র যত সনাতন পদ্ধতিরই হোক না কেন। এবং
৬. পরিকল্পনা এদের সব সময়ই গোপন থাকে ।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে বাংলার সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন বা গুপ্ত সমিতিগুলির অমিল নেই। কম-বেশি এ বৈশিষ্ট্যগুলি বাংলাদেশের সব গুপ্ত সমিতিগুলির বা যাঁরা এ দর্শনে বিশ্বাসী তাঁদের ছিল।
সন্ত্রাসের পথ কেন বেছে নেওয়া হয়? এ বিষয়ে অনেক তত্ত্ব আছে। তবে, আমরা এ পরিপ্রেক্ষিতে ফাননের তত্ত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করব। ফ্রানৎজ ফ্যানন তাঁর রেচেড অব দা আর্থ গ্রন্থে যে তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন তাতে গ্রামাঞ্চল ও সন্ত্রাসে কৃষকদের ভূমিকার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর কৃষকের সংখ্যাধিক্য তৃতীয় বিশ্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সন্ত্রাসের অন্যসব তত্ত্ব (যেমন সার্ত্র, আরন, আরেনডাথ) নির্মাণ করা হয়েছে ইউরোপীয় ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে, একটি উপনিবেশে (যেখানে কৃষকের সংখ্যাই বেশি) বসবাসের অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না যা ছিল ফাননের। ফাননের জন্ম যদিও মার্টিনিকে কিন্তু তিনি বসবাস করেছেন আলজিরিয়ায় যা তখন ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। স্বাধীনতার জন্য আলজিরিয়া যখন বিদ্রোহ করেছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তখন ফানন নির্মাণ করেছিলেন এ তত্ত্ব । এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ফাননের তত্ত্বই সন্ত্রাসকে দিয়েছে ব্যাপক ও গভীরতর অর্থ যার ফলে সন্ত্রাস হয়ে উঠেছে মুক্তি অর্জনের মাধ্যম।
বাংলাদেশের (বা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের) সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বোঝার জন্য এ তত্ত্ব আমাদের সাহায্য করবে। ফাননের তত্ত্বের পটভূমি ঔপনিবেশিক শাসন। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি শক্তি ও বিজয় যার মূল হচ্ছে সন্ত্রাস (প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়)। ঔপনিবেশিকবাদ হলো সন্ত্রাস- রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। প্রতি-সন্ত্রাসই শুধুমাত্র রোধ করতে পারে ঔপনিবেশিক সন্ত্রাসকে। ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যক্তি মাত্রকেই হীনম্মন্য ও অধস্তন করে তোলে। সন্ত্রাসই ব্যক্তিকে শুদ্ধ করে হীনম্মন্যতা ও অধস্তনতা থেকে। সে জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মাধ্যম সন্ত্রাস; ব্যক্তি শুদ্ধ, সমাজ মর্যাদাদীপ্ত হলে স্বাধীনতা যথার্থ হয়। ফাননের মতে, তৃতীয় বিশ্বে সাচ্চা বিপ্লবী শ্রেণি হচ্ছে কৃষকরা যারা বসবাস করে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কিন্তু জাতীয় স্বার্থ, নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ততা যাদের সবসময় অটুট। রক্ষী বাহিনী যে শহুরে সন্ত্রাসবাদীদের পিছে হানা দিয়ে ফিরছে সে সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেয় এই কৃষকরা এবং তৈরি থাকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিজেদের জমি ও সম্মান পুনরুদ্ধারে। তাঁর মতে, ‘প্রয়োজন’(need) ও ‘অভাব’ (scarcity) হচ্ছে ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সন্ত্রাসের মূল কারণ।
জাতীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস ‘সম্প্রদায়’কে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ‘ট্রাইবালিজম’ ও ‘আঞ্চলিকতা’কে প্রতিহত করে। অস্ত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক বসতিকারীকে উৎখাত করে দেশীয়রা ঔপনিবেশিক নিউরোসিস থেকে মুক্তি পায়। একজন ইউরোপীয়কে হত্যা (বসতি স্থাপনকারী) মানে এক ঢিলে দুটি পাখি মারা- Ôto destroy an oppressor and the man he oppresses at the same time.’
ব্যক্তিগত পর্যায়ে সন্ত্রাস এক শুদ্ধিকরণ শক্তি, সন্ত্রাস একজন দেশীয়কে তার কর্মহীনতা, হীনম্মন্যতা ও হতাশা থেকে মুক্তি দেয়। সন্ত্রাসের এই যৌক্তিক ভিত্তি প্রদানের পর ফানন তার সাংগঠনিক রূপের কথা তুলেছেন। কারণ ঐ সাংগঠনিক রূপে সন্ত্রাসকে নিতে না পারলে সেই সন্ত্রাসের পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে নিছক সন্ত্রাসে এবং তা জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পর্যবসিত হতে পারে অসাফল্যে। এ ক্ষেত্রে তাঁর কিছুটা মিল আছে আরো দু’জন বিপ্লবী চে গুয়েভারা ও দেব্রের সঙ্গে।
ফানন বলেছেন, ‘স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ’কে সঙ্গে সঙ্গে ÔreplaceÕ করতে হবে ÔsystematicÕ সংগঠন ও কৌশল দ্বারা। সন্ত্রাস যাদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে সেই বিচ্ছিন্ন গেরিলা ইউনিটগুলিকে অন্তিমে পরিণত করতে হবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে। এই বাহিনী নিয়ন্ত্রিত হবে কেন্দ্রীয় কৌশল দ্বারা। চে গুয়েভারা মনে করেন, শুধু সন্ত্রাস বিপ্লবী কার্যক্রমকে ক্ষতি করতে পারে; সে জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি ‘অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ’, বা ‘স্যাবোটাজ’-এর ওপর যা পরিচালনা করবে গেরিলারা। দেব্রে, ফাননের মতোই মনে করেন, শহরে সন্ত্রাস থেকে গ্রামাঞ্চলে গেরিলাদের কার্যকলাপ বেশি কার্যকর কারণ তা শত্রুর বিশাল সেনাবাহিনীকে স্থবির করে দেয়।
এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, ফাননের তত্ত্বই সন্ত্রাসকে ব্যাপক ও গভীরতর অর্থ দিয়েছে যার ফলে সন্ত্রাস পরিণত হয়েছে মুক্তি অর্জনের মাধ্যমে। এ সন্ত্রাসের ভিত্তি সে জন্য একটি মতাদর্শ ও সংগঠন।
মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। পত্রিকা খুললেই দেখা যেত ‘মিসক্রিয়েন্ট’ বা দুবৃত্তরা বিভিন্ন স্থান আক্রমণ করছে। পাকিস্তানিরা সব সময় এদের ‘মিসক্রিয়েন্ট’ বা ‘দুবৃর্ত্ত’ বলেছে। আমরা বলেছি মুক্তিযোদ্ধা। ইসরায়েল সব সময় ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামীদের সংগঠন ‘ফাতাহ’ বা ‘হামাস’-কে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেছে। স্বাভাবিকভাবে ইসরায়েল যেহেতু ঘোষণা করে তার ডিকটাটই মেনে নেয় পাশ্চাত্য ও মার্কিনীরা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলে হানা দিলে সারা বিশ্বের গণমাধ্যম এদের সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা করে। হামাসরা তাদের অঞ্চলেই পদার্পণ করেছিল অস্ত্রের সাহায্য ইসরায়েল যা দখল করেছিল। প্রতিদিন হামাসকে সন্ত্রাসী বলার অর্থ এদের ফিলিস্তানী মুক্তিকামী যাতে কেউ না বলে। এদের যেন সাধারণ বা ‘ক্রিমিনাল’ টেররিস্ট হিসেবেই দেখা হয়।
ফিলিস্তিন যখন ব্রিটিশ দখলে তখন আরব মুসলমান ও ইহুদীদের মধ্যে ছোট খাটো সংঘর্ষ লেগেই ছিল। ইহুদদীরা তখন গুপ্ত সংস্থা গঠন করতে থাকে। আরবদের প্রতিহত ও ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করার জন্য। কয়েকটি উদাহরণ দিই-
১. ইহুদী আব্রাহাম স্টার্ণের সম্পর্ক ছিল ইতালির ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে।
২. প্যালেস্টাইন থেকে অবৈধ ইহুদী বসতকারীদের যখন ব্রিটিশরা প্যাটরিয়া জাহাজে করে মরিশাস পাঠাতে চাচ্ছিল তখন হাইফা বন্দরে অবস্থানরত এই জাহাজ উড়িয়ে ইহুদী গুপ্ত ঘাতকরা দেয়, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জর্জ ই কার্কের ভাষায় ÔJewish terrorist’ রা।
৩. ইরগুন গুপ্ত সংস্থা একই ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল।
৪. এর পাশাপাশি গড়ে ওঠে হাগানা ব্রিটিশরা যাদের সহয়াতা করত অস্ত্র দিয়ে। কারণ হাগানার সদস্যরা বলত তারা আরবদের থেকে তাদের বসতি রক্ষার জন্য অস্ত্র দরকার। পরে তা গুপ্ত ঘাতকদের দলে পরিণত হয় এবং হালমাক নামে তারা ২০০০ সদস্যের এক এলিট ফোর্স গড়ে তোলে। ইসরায়েলের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগিন ছিলেন এর সদস্য। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তাদের সন্ত্রাসীকলাপ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়।
ইসরায়েলিরা এখন এদের বীর বলে বন্দনা করে। আর হামাস একই লক্ষ্যে কাজ করে। কিন্তু ইসরায়েলতো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম, প্রত্যেক রাজনীতিবিদ তাদের টেররিস্ট আখ্যা দিচ্ছে। এদের প্রচার এতো ব্যাপক ও তীব্র যে, কেউ হামাস সামাজ্যবাদী ও নিষ্ঠুর কলোনির শাসক থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে, ফাননের ভাষায়, তা বলার সাহস কেউ রাখছে না। হয়তো, প্যালেস্টাইন কখনও রাষ্ট্র হলে বা রাষ্ট্র না হলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের ইতিহাসে ফাতাহ, হামাস বা এধরনের গ্রুপকে মুক্তির নায়ক হিসেবেই উল্লেখ করবে। যেমন, ১৯৭১ সালের তথাকথিত ‘দুর্বৃত্ত’ বা ‘টেররিস্টদের’ আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলি।
লেখক : ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এএসএম