‘আমার পরে কে?’
শিরোনামের প্রশ্নটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। থাইল্যান্ড সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলের আন্দোলন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন। তার প্রশ্নটি ছিল বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এর আগে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। প্রথম দফায় ক্ষমতায় শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে বের করে এনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দেশকে স্থিতিশীল করা।
প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেন। শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের সাথে গঙ্গার পানি চুক্তি করেন। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করেন। তবে দ্বিতীয় দফায় তার মূল লক্ষ্য ছিল গ্লানিমুক্ত করার পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নেওয়া।
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশ। সবাই যে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছিল, সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেই ধারাও থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তার কন্যা শেখ হাসিনা।
যত বড় সমালোচকই হোন, এটা মানতেই হবে শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। ১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ এক নয়। যারা শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করেন; তারা বলেন, উন্নয়ন করাই তো সরকারের দায়িত্ব। আর উন্নয়ন তো এক ধরনের ধারাবাহিকতা। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেওয়ার আগের ৩৭ বছরে যত উন্নয়ন হয়েছে, গত ১৫ বছরে হয়েছে তার কয়েকগুণ বেশি। আর এই উন্নয়ন নিছক ধারাবাহিকতা নয়, শেখ হাসিনার উন্নয়ন অভিনব, অকল্পনীয়।
আগের কোনো সরকার যা কল্পনাও করেনি, শেখ হাসিনা তা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। শেখ হাসিনা এমন অনেক কিছু করেছেন, যা সাধারণ মানুষ দাবিও করেনি, দাবি করার সাহসও হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একের পর এক নতুন যুগে পা রেখেছে। পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, মেট্রোরেল, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ- সবই নতুন এবং অভিনব।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল। কোভিড এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি সেই গতি কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে বটে, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির সব সূচক এখন ২০০৮ সালের আগের চেয়ে ভালো। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ নিজেই এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে লজ্জা পান। কোনো কোনো সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে ভারতকেও। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মর্যাদা পেয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের দেশ নয়। বাংলাদেশ এখন আত্মমর্যাতায় বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক দেশ।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের যে মহাসড়কে তুলে এনেছেন, তা এগিয়ে নিতে চাই স্মার্ট নেতৃত্ব। দৃষ্টিসীমায় সেই নেতৃত্ব দৃশ্যমান নয়। ‘আমার পরে কে?’ যে প্রশ্ন শেখ হাসিনা তুলেছেন; শেখ হাসিনার স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে এ প্রশ্নের উত্তরটাও জানা জরুরি। অন্তত তেমন নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়াটা শুরু হওয়া দরকার।
সাফল্য যতই আসুক, গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার সবার আছে। বিএনপি শুরু থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। গত বছর থেকে তারা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির সাথে যুক্ত হয়েছে অতি বাম, অতি ডান সবাই। বাম-ডানের ঐক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিই বিরল।
গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশের অতি বাম, অতি ডান—সবই এখন এক হয়ে গেছে, এটা কীভাবে হলো, আমি জানি না। এই দুই মেরু এক হয়েও সারাক্ষণ শুনি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে হবে। অপরাধটা কী আমাদের?’ এই প্রশ্নটিই এসেছিল সংবাদ সম্মেলনেও। জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা আমাকে উৎখাত করবে। তাহলে পরবর্তী সময়ে কে আসবে? সেটা কি ঠিক করতে পেরেছে? কে দেশের জন্য কাজ করবে? কাদের তারা ক্ষমতায় আনতে চায়? সেটা স্পষ্ট নয়। তাই জনগণের কোনো সাড়া পাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘কেউ পলাতক (ফিউজিটিভ) হয়ে বিদেশে বসে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে অনলাইনে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে, আন্দোলন করে যাচ্ছে। আমরা আন্দোলনে বাধা দিচ্ছি না।’
আগেই বলেছি, গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার, সরকারকে উৎখাত করতে চাওয়ার অধিকার সবার আছে। অনেক উন্নয়ন হলেও গণতন্ত্রের প্রশ্নে, মানবাধিকারের প্রশ্নে, ভোটাধিকারের প্রশ্নে অনেক সমালোচনাও আছে। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশ আর আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরোধিতায় বিভক্ত নয়।
গত দেড় দশকে শেখ হাসিনা নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তা বাংলাদেশের জন্যই গর্বের। শেখ হাসিনা এখন আর নিছক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন বা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নন; বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও শেখ হাসিনার মর্যাদার আসন অনেক উঁচুতে। তাই আওয়ামী লীগহ সরকার হটাতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প লাগবে। অনেকদিন ধরেই বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কেউ শেখ হাসিনার বিকল্প কাউকে দাঁড় করাতে পারেননি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী হবেন তারেক রহমান। কিন্তু দেশে-বিদেশে কেউ কি শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে তারেক রহমানকে ভাবতে পারেন? এমনকি শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচকও মানবেন, শেখ হাসিনার বিকল্প তারেক রহমান নন। শেখ হাসিনা ঠিকই বলেছেন, নেতা ঠিক করতে পারেনি বলেই বিরোধীদের আন্দোলন সাড়া জাগাতে পারেনি। নানা সমালোচনা সত্ত্বেও বিদেশিরাও শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাতেই আস্থা রেখেছেন।
আওয়ামী লীগাররা ভালোবেসে বলেন, ‘যতদিন শেখ হাসিনার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ।‘ নিশ্চয়ই এটা বড় স্বস্তির। কিন্তু একই সঙ্গে শঙ্কারও। সরকারে তো নয়ই, দলেও শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি। শেখ হাসিনা বারবার তার অবসরের আকাঙ্ক্ষার কথা বলেন। যেখানে জন্মেছিলেন, অবসরে সেই টুঙ্গীপাড়ায় ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতার কারণে, দলের চাপে সেটা তিনি করতে পারেন না।
আমরা চাই শেখ হাসিনা শতায়ু হোন। উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তিনি আমাদের দেখান, সেটা তার নেতৃত্বেই আসুক। কিন্তু শেখ হাসিনারও বয়স হয়েছে, তারও ক্লান্তি আসবে, তারও অবসরে যেতে মন চাইবে। তখন কে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেবেন, কে দেশকে এগিয়ে নেবেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের যে মহাসড়কে তুলে এনেছেন, তা এগিয়ে নিতে চাই স্মার্ট নেতৃত্ব। দৃষ্টিসীমায় সেই নেতৃত্ব দৃশ্যমান নয়। ‘আমার পরে কে?’ যে প্রশ্ন শেখ হাসিনা তুলেছেন; শেখ হাসিনার স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে এই প্রশ্নের উত্তরটাও জানা জরুরি। অন্তত তেমন নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়াটা শুরু হওয়া দরকার।
লেখক : বার্তপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জেআইএম/ফারুক