তীব্র তাপপ্রবাহ
দোষ কি সব প্রকৃতির?
ঈদ এবং নববর্ষের ছুটি পেরিয়েছে সপ্তাহ আগে। কিন্তু ঢাকা এখনও আগের চেহারায় ফেরেনি। রাস্তায় এখনও ছুটির আমেজ। প্রথম কারণ হলো, ঈদ এবং নববর্ষের ছুটির সাথে মিলিয়ে অনেকে বাড়তি ছুটি নিয়েছিলেন। ফলে ছুটিতে যারা ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন, তাদের সবাই এখনও ফেরেননি। দ্বিতীয় কারণ হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও খোলেনি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো দেশজুড়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপদাহ।
প্রচন্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। অতি জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। গরমের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দেশজুড়ে চলছে তিনদিনের হিট অ্যালার্ট। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২.৬ ডিগ্রিতে।
রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রাও ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। শুধু এবার নয়, গত কয়েকবছর ধরেই তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল শেষ হতে আরো অন্তত ৮ দিন বাকি আছে। এই সময়ে বৃষ্টি না হলে তাপমাত্রা সহনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবহাওয়া অফিস বলছে, এপ্রিল ছাড়িয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে এই তাপদাহ।
তীব্র গরম যে শুধু আমাদের জন্য সাময়িক কষ্টের কারণ, তাই নয়। তীব্র গরমে নানা রোগব্যাধিও হতে পারে। হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যুর খবরও আসছে। তীব্র গরমে ডায়রিয়া বেড়ে যায়, পানিশূন্যতা সৃষ্টি, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই গরম থেকে আমাদের সবার সাবধান থাকা উচিত। তবে শিশু ও বয়স্কদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা জরুরি। প্রথম সতর্কতা হলো, যতটা সম্ভব ঘরে থাকা। কিন্তু ঘরে বসে থাকলে অনেকের সংসার চলবে না। পেটের দায়ে অনেককে ঘরের বাইরে যেতেই হয়। আমাদের সমাজের সুবিধাভোগী একটা অংশ আছে, যাদের বাসা, গাড়ি, অফিস সব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তাদের গায়ে হয়তো গরমের তীব্রতা লাগার উপায় নেই। কিন্তু তাপমাত্রা যতই হোক, জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষকে ২৪ ঘণ্টাই নন এসিতে থাকতে হয়।
শুধু নন এসি নয়, তীব্র গরমে দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হয়। রিকশাচালক, দিনমজুর, বাসের চালক, হেলপারসহ নিত্যদিনের কাজ যাদের; গরমে তো তাদের বসে থাকলে চলে না। তবে বাইরে গেলেও কিছু মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি সবাইকেই মেনে চলতে হবে। কারণ গরম কিন্তু ধরী-গরীব, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বোঝে না। বাধ্য হয়ে যেটুকু সময় আমাদের বাইরে থাকতে হবে, সেটুকু সময় আমাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যতটা সম্ভব ছায়াতে থাকতে হবে। প্রচুর পানি, সরবত, পানীয় বা স্যালাইন খেতে হবে।
প্রচুর ঘামের কারণে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানি যেন পানিশূন্যতা তৈরি করতে না পারে। সম্ভব হলে একাধিকবার গোসল করতে হবে। বাইরে থাকার সময় গোসল করা সম্ভব না হলেও সুযোগ পেলেই হাতে, মুখে, মাথায় পানির ঝাপটা দিতে হবে। গামছা বা রুমাল ভিজিয়ে শরীর মুছতে হবে। বেশি করে পানি খেতে হবে, তবে সেই পানিটা যেন হয় নিরাপদ। রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বিক্রি হওয়া অস্বাস্থ্যকর শরবত পান বিপদের কারণ হতে পারে। তাতে তাৎক্ষণিক পানিশূন্যতা হয়তো কাটবে, তবে ডায়রিয়া বা জন্ডিসের মত রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। সম্ভব হলে মাথা, চোখ এ্বং শরীর ঢেকে রাখতে হবে।
এই তীব্র তাপদাহে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। মশলাজাতীয় খাবার, ডুবো তেলে ভাজা খাবার, বাড়তি চা-কফি, তেল-চর্বি জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও লবণ, প্যাকেট জাতীয় খাবার বা প্রসেসড ফুড, ফাস্টফুড পরিহার করতে হবে। তীব্র গরমে চিকিৎসকরা এমনকি আইসক্রিম ও কোমল পানীয় খেতেও বারণ করেন। আইসক্রিম, কোমল পানীয় উল্টো পানিশূন্যতা তৈরি করতে পারে। তার বদলে আপনি সহজপাচ্য কম মশলা জাতীয় খাবার, শাক-সবজি, টক, ডাল, পাতলা স্যুপ, ডাবের পানি, লেবু পানি, রসালো ফল, কাঁচা আমের শরবত, টক দই খেতে পারেন।
কিন্তু এসব তো সাময়িক সমাধান। আপনি কতদিন এভাবে তীব্র গরম থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন। গোটা শহরকে, গোটা দেশকে, গোটা বিশ্বকে হট চেম্বার বানিয়ে আপনি কোথায় পালাবেন, কোথায় গিয়ে নিজেকে রক্ষা করবেন? সমস্যা শুধু যে তীব্র গরমের তা কিন্তু নয়। তীব্র শীত, তীব্র গরম, প্রচন্ড বৃষ্টি- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতি চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে দিন দিন। যত দিন যাবে, প্রকৃতি আরো চরম হবে। কিন্তু দায় সবটাই কি প্রকৃতির?
সবাই বুকে হাত দিয়ে বলুন, দায় প্রকৃতির বেশি না মানুষের? প্রকৃতিকে নিজের মত চলতে দিলে ধরিত্রী সবার জন্য বাসযোগ্যই থাকতো। কিন্তু আমরা সভ্যতার নামে, উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি প্রতিনিয়ত। প্রকৃতি এখন শুধু শোধ নিচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে আমি জনকণ্ঠে চাকরি করতাম। তখন জনকণ্ঠের অফিস ছিল মতিঝিলে। আর আমার বাসা ছিল রাজাবাজারে। কাজ শেষে মধ্যরাতে অফিসের বেবিট্যাক্সিতে (আজকের সিএনজিচালিক থ্রি হুইলারের মত) বাসায় ফিরতাম।
কাকরাইল মসজিদের মোড়ে ডানে মন্ত্রীপাড়ার দিকে মোড় নিলেই একটা শীতল হাওয়ার ঝাপটায় শরীর জুড়িয়ে যেতো। শেরাটনের (এখনকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল) মোড় পেরুলেই আবার তাপমাত্রা বেড়ে যেতো। সবসময়ই রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা ধানমন্ডি লেক এলাকার তাপমাত্রা মতিঝিল এলাকার চেয়ে ২/৩ ডিগ্রি কম। গাছপালা, পানি প্রকৃতির তাপমাত্রা কমিয়ে রাখে, এটা বোঝার জন্য পরিবেশবিদ হতে হয় না। কিন্তু আমরা গাছ কেটে ভবন বানিয়েছি, জলাশয় ভরাট করে প্লট বানিয়েছে। এখন গরম নিয়ে প্রকৃতির ওপর দোষ চাপালে সেটি অন্যায় হবে। গোটা মতিঝিলে আপনি আশ্রয় নেয়ার জন্য কোনো গাছ খুঁজে পাবেন না।
আমার এখনকার অফিস যেখানে, সেই কারওয়ানবাজারেও গাছের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার। শুধু মতিঝিল বা কারওয়ানবাজার নয়; কিছু এলাকা বাদ দিলে আমাদের গোটা ঢাকাই এখন বৃক্ষশূন্য এক বিরাণভূমি। আমরা একের পর এক আবাসিক এলাকা বানাচ্ছি। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই বাসযোগ্য নয়। আবাসিক এলাকার গালভরা নাম নিকেতন, কিন্তু সেই নিকেতনে সবুজের ছোঁয়া নেই। নামেই জাপান গার্ডেন সিটি, গার্ডেনের চিহ্নমাত্র নেই।
আমরা দেয়াল টু দেয়াল ভবন বানাই, প্রকৃতির শ্বাস ফেলার জায়গা রাখি না। তো প্রকৃতি আমাদের শ্বাস ফেলার সুযোগ দেবে কেন? গুলশান এভিনিউতে গেলে দেখবেন দুই পাশে চমৎকার সব গ্লাস টাওয়ার। দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু এই গ্লাস টাওয়ার যে সূর্যের তীব্রতা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা জানার জন্য কি আমাদের বিজ্ঞানী হতে হবে। এই গ্লাস টাওয়ারগুলো যারা বানান, তারা তো নিশ্চয়ই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আর্কিটেক্ট হয়েছেন। তারা জানেন গ্লাস টাওয়ারে প্রকৃতি আরো উত্তপ্ত হয়। তাদের কি একটুও মায়া হয় না।
এই শহরে তো সেই আর্কিটেক্টদেরকেও থাকতে হয়। অবশ্য তারা সারাক্ষণ শীতাতপনিয়ন্ত্রণ করে রাখেন। তাই তারা হয়তো টেরই পান না গরমের কষ্ট। এই যে আমরা বাসায়, অফিসে, গাড়িতে এসি লাগিয়ে ঘুরছি। আমরা কি জানি না, এই এসি প্রকৃতিকে আরো বেশি উত্তপ্ত করে তুলছে। যত বেশি এসি, তত বেশি গরম। হিসাব বরাবর। কিন্তু অল্প কিছু মানুষের আয়েশের জন্য অনেক বেশি মানুষকে অনেক বেশি কষ্ট সইতে হচ্ছে।
প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। প্রকৃতি তো তার মত সুরক্ষা তৈরি করে রেখেছে। গ্রীষ্মকালে তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস, কাঁঠাল, আমের মত রসালো ফল দিচ্ছে প্রকৃতি। ধ্বংস তো করছি আমরা। দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। আরো বেশি গাছ লাগাতে হবে, আরো বেশি জলাশয় বানাতে হবে। কৃত্রিম এসির ব্যবহার কমাতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। নইলে একদিন তীব্র গরমে, প্রচন্ড শীতে, প্রবল বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় ভুগতে হবে আমাদের সবাইকে। উত্তর প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না, অভিশাপ দেবে।
২১ এপ্রিল, ২০২৪
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/এমএস