শুভ নববর্ষ ১৪৩১
হিন্দু নববর্ষ এবং বাংলা নববর্ষ দুটি ভিন্ন বিষয়
প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্লাপক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে হিন্দুদের নতুন বছর শুরু হয়। এবছর হিন্দু নববর্ষ শুরু হয়েছে ৯ এপ্রিল থেকে। বিক্রম সংবত ২০৮১ এবং চৈত্র নবরাত্রি একই দিন থেকে শুরু হয়েছে।
ভারতীয় সম্রাট বিক্রমাদিত্য এই উৎসব শুরু করেছিলেন বলে এর নাম বিক্রম সংবত। সংবত অর্থাৎ সাল। বিক্রম সংবত প্রতিবছর নতুন নামে শুরু হয়। এছর এর নাম রাখা হয়েছে পিঙ্গল। বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করে ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই বিক্রম সংবতের প্রচল করেন। মনে করা হয় চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে শুভসময় এ নববর্ষ শুরু হয়েছিল।
ভারতীয় কালগণনা প্রকৃতিদেবীর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। বসন্ত ঋতু প্রকৃতিক কারণে নবজীবনের বার্তা বয়ে আনে। এই সময় প্রকৃতিও নবরূপ ধারণ করে। তাই এই দিনটি সমগ্র মানবজাতির নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র ভারতে এই উৎসবটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। গুড়ি পাডওয়া, চেতিচাঁদ, যুগাদি, নব সংবতস ইত্যাদি নামেও এই উৎসবটি পালিত হয়। হিন্দু নববর্ষের ১২ মাসের প্রত্যেকটিতে রয়েছে নিজস্ব বিশেষ তাৎপর্য। বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলের চন্দ্রে আবর্তনের বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ। জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামানুসারে জৈষ্ঠ্য। উত্তর ও পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রের নামানুসারে আষাঢ়। শ্রাবণা নক্ষত্রের নামানুসারে শ্রাবণ। উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নামানুসারে ভাদ্র। অশ্বিনী নক্ষত্রের নামানুসারে আশ্বিন। কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামানুসারে কার্তিক। মৃগশিরা নক্ষত্রের নামানুসারে অগ্রহায়ণ। পুষ্যা নক্ষত্রের নামানুসারে পৌষ। মঘা নক্ষত্রের নামানুসারে মাঘ। উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামানুসারে ফাল্গুন। চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ “সূর্যসিদ্ধান্ত” থেকে এই নামকরণ করা হয়েছে।
সৌর রাজ্যে প্রতি নতুন বছরে একজন অধিপতি হয়ে থাকেন। জ্যোতিষশাস্ত্রীয় গণনা অনুসারে হিন্দু নববর্ষের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত একজনকে অধিপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই ধারাবাহিতায় ৯ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া নববিক্রম সংবত ২০৮১ ক্রোধী নামে পরিচিত। অর্থাৎ এ বছর সংবতের রাজা হবেন মঙ্গল আর মন্ত্রী হবেন শনি।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে একটি বিশ্বাস আছে যে, ব্রহ্মপুরাণ মতে, এই দিনেই প্রজাপতি ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করেন। তাই পৃথিবীতে এটি কাল গণনার প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীতে দ্বাপর যুগে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের শেষে যে যুগাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল তাও এই দিনটি থেকেই। এবার শুরু হতে চলেছে ৫১২৬ যুগাব্দ। আবার উজ্জয়িনীর সম্রাট অত্যাচারী শকদের পরাজিত ও বিতাড়িত করে শকারি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন। সেই উৎসবকে মনে রাখার জন্য নতুন করে গণনা করা হয় বিক্রম সংবদ। এবছর বিক্রমাব্দ বা বিক্রম সংবদের ২০৮১ সূচনা হয়েছে। চৈত্র নবরাত্রি দ্বিতীয় সর্বাধিক উদযাপিত নবরাত্রি। এটি বসন্ত নবরাত্রি নামেও পরিচিত। চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের প্রতিপাদ তিথি থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত দেবী দুর্গার নয়টি রূপ, নয়দিনে পূজা করা হয়। এসময় দুর্গা পূজাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। ত্রেতা যুগে বসন্ত নবমীতে অযোধ্যায় দশরথ পুত্র শ্রী রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই এটি রাম নবমী নামেও বেশ পরিচিত। এছাড়া চৈত্র মাসের প্রতিপদ তিথিতে যুধিষ্ঠির রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। তাই মহাভারতের মতে এটি চৈত্র নবরাত্রি নামে পরিচিত। হিন্দু নববর্ষ পালনের সূচনা করা হয় সূর্য ও দেবী দুর্গার পুজো করে। যাতে সারা বছর সৌর্য-বীর্যে বলশালী হয় রাজ্য এবং মহা সুখে থাকে প্রজাগণ।
চৈত্র মাসের সংক্রান্তির রাত শেষে নতুন সূর্য উদিত হওয়ার সাথে সাথে নতুন বস্ত্র পরে নাচে গানে মুখরিত পরিবেশের মাধ্যমে বছরের প্রথম সূর্যকে বরণ করার রীতি চালু হয়েছে। বাংলা নববর্ষ আজকে যেভাবে পালন করা হয়। শুরুতে সেভাবে ছিল না। প্রথম দিকে সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো। বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরের নাম বলা হলেও বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তক হিসেবে ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের নাম বলা হয়। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিল। যেহেতু কৃষকদের কৃষি কাজ চাঁদের হিসেবের সাথে মিলতো না। তাই খাজনা আদায়ে সমস্যা হতো। সেই কারণে সম্রাট আকবর হিজরি পঞ্জিকায় সংস্কার আনেন। সম্রাট আকবরের নির্দেশে তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও হিজরি সন এর উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হয়। বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশে এই গ্রেগরীর বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল শুভ নববর্ষ পালন করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকেই মঙ্গল-শোভাযাত্রা বাঙ্গালীর নববর্ষ উদযাপনের একটি প্রধান আকর্ষণ। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা অনুষদ থেকে আয়োজিত যে মঙ্গল-শোভাযাত্রা বের করে, সেটিকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হলেও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায় ‘তিথি পঞ্জিকা’ অনুসরণ করে থাকে।
এপ্রিলের ১৪ তারিখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলাদেশের সবচাইতে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। কবল বাংলাদেশই নয়, দুনিয়া জুড়ে ছাড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছেও দিনটি বিশেষ উদযাপনের। বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে, সবাইকে নিয়ে পহেলা বৈশাখের আনন্দ ভাগাভাগির উৎসবে ছায়ানটের রমনা বটমূলে বর্ষবরণ বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সঙ্গীত ও মঙ্গল শোভাযাত্রা ছায়ানটের যাত্রা বাংলার মানুষকে সাংস্কৃতিক মুক্তিতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ছায়ানট বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৪ সাল অর্থাৎ বাংলা ১৩৭১ সালের ১লা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এ নববর্ষ উৎসব জাতিয়ে উৎসবে পরিণত হয়। এ দিনটিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এছাড়া বৈশাখী মেলা, পান্তা-ইলিশ বা বিভিন্ন ধরনের গ্রাম্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন বছর। দোকানে দোকানে বসে হালখাতা। দোকানীরা পুরানো বছরের হিসাব মিটিয়ে নতুন করে হিসাবের খাতা খোলে। সে উপলক্ষ্যে হিন্দু দোকানে গণেশ পূজা করা হয়। সারাবছর জুড়ে যেসব ক্রেতার সঙ্গে লেনদেন করা হয়, তাদের মিষ্টিমুখের মাধ্যমে নতুন বছরের যাত্রা শুরু হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে নববর্ষ পালনের রীতিকে হিন্দুয়ানী বলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। অনেকেরই ধারণা হিন্দু রীতি অনুযায়ী বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালন করা হচ্ছে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী হিন্দু নববর্ষ হয়ে থাকে তিথি অনুযায়ী। আর বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয় ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী। অথচ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুরা বাংলা নববর্ষ পালন করে তিথি পঞ্জিকা অনুযায়ী। যা ইংরেজি ১৩,১৪,১৫ এপ্রিল এই তিনদিনের যে কোনো একদিন হয়ে থাকে। তাহলে তিনটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত হিন্দু নববর্ষ, দ্বিতীয়ত হিন্দু বাঙালি নববর্ষ, তৃতীয়ত বাংলাদেশের বাঙালি নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।
এইচআর/এমএস