শুভ নববর্ষ ১৪৩১
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গুরুত্ব
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি এই দিনটি পালন করে থাকেন। পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালি জাতির ঐক্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক।
পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন। এই দিনটি নতুন বছরের সূচনা হিসেবে পালিত হয়। নতুন বছরের শুরুতে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রতিজ্ঞা নেওয়া হয়। পহেলা বৈশাখ পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার দিন। এই দিনটিতে আমরা গত বছরের ভুলত্রুটিগুলো ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পাই।
পহেলা বৈশাখ সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই দিনে সকলে মিলে আনন্দ-উৎসব করে থাকেন। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নিম্ন সকলের মধ্যে বৈষম্য ভুলে সকলে মিলে এই উৎসব পালন করা হয়।
পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই দিনে আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার, পোশাক, গান-বাজনা, নাচ-গান ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি প্রকাশ করে থাকি।
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিরা নববর্ষ উদযাপন করে আসছে। বৈদিক যুগে 'চৈত্র সংক্রান্তি' নামে এই উৎসব পালিত হত। মধ্যযুগে 'পয়লা বৈশাখ' বা 'নববর্ষ' নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন 'হালখাতা' নামে ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলে নতুন হিসাব শুরু করতেন। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ সালে 'বঙ্গাব্দ' নামে নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই 'পহেলা বৈশাখ' রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ আমলে 'পহেলা বৈশাখে' সরকারি ছুটি ছিল না। তবে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই এই দিনটি উদযাপন করত। পাকিস্তান আমলে 'পহেলা বৈশাখ' উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে বাঙালিরা গোপনে এই দিনটি উদযাপন করত।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর 'পহেলা বৈশাখ' জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। এই দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। সারা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। আজকের 'পহেলা বৈশাখ' শুধু একটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদেরও প্রতীক। এই দিনে বাঙালিরা তাদের ঐক্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। 'পহেলা বৈশাখ' বাঙালি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো রমনা বটমূলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তখন থেকে প্রতি বছর নববর্ষের প্রথম দিন ভোর ৫ টায় এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছায়ানট বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানায় এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে গান, বাজনা, নাচ, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ইত্যাদি। বিখ্যাত শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এছাড়াও, বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করে।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর পরিবেশ। রমনা বটমূল নববর্ষের আনন্দে মুখরিত থাকে। মানুষ নতুন পোশাক পরে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ছায়ানটের কর্মীরা বিভিন্ন রঙের পতাকা ও ব্যানার টাঙিয়ে রমনা বটমূল সাজিয়ে তোলে। এছাড়াও, নববর্ষের বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করা হয়।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বেশ কিছু গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষকে জাতীয়ভাবে উদযাপন করা হয়। দ্বিতীয়ত, এই অনুষ্ঠান বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। তৃতীয়ত, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ঐক্য ও বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে এবং নববর্ষের আনন্দ-উৎসব পালন করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতি বছর 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' বের হয়। এই শোভাযাত্রায় বাংলার বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটে। বিভিন্ন রঙিন পোশাক পরিহিত মানুষ, মুখোশধারী, রথ, পালকি, ঐতিহ্যবাহী বাঁশি, ঢোল, কাঁসর, ইত্যাদি নিয়ে এই শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
'মঙ্গল শোভাযাত্রা' 'পহেলা বৈশাখ' উদযাপনের একটি অন্যতম আকর্ষণ। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উদযাপনের একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রতি বছর এই শোভাযাত্রা বের হয়।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। তখন থেকে প্রতি বছর নববর্ষের প্রথম দিন এই শোভাযাত্রা বের হচ্ছে। শুরুতে এই শোভাযাত্রায় শুধুমাত্র ঢাবির শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতো। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ মানুষও এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ শুরু করে।
মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ হলো এর রঙিন ও বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্ম। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন রঙের পোশাক পরে, মুখোশ লাগিয়ে, হাতে বিভিন্ন ধরনের পতাকা ও ব্যানার নিয়ে নৃত্য করে।
এছাড়াও, শোভাযাত্রায় বিভিন্ন রথ, পালকি, ঐতিহ্যবাহী বাঁশি, ঢোল, কাঁসর বাজানো হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা কেবল একটি শোভাযাত্রা নয়, বরং এটি একটি উৎসব। এই উৎসবে বাঙালিরা তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফুটিয়ে তোলে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালিরা নববর্ষের আনন্দ-উৎসব পালন করে।
মঙ্গল শোভাযাত্রার বেশ কিছু মহাত্ব রয়েছে। প্রথমত, এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। দ্বিতীয়ত, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ও বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, এই শোভাযাত্রা নববর্ষের আনন্দ-উৎসবকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়া বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। পান্তা ভাত খাওয়ার প্রচলন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পান্তা ভাত ছিল সহজলভ্য খাবার। রাতের রান্না করা ভাত পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো পরের দিনের জন্য। এতে ভাত নষ্ট হতো না এবং গরমের দিনে খাওয়ার জন্য উপযোগী হতো। ইলিশ মাছ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং বৈশাখ মাসে ইলিশ মাছের সরবরাহ বেশি থাকে। তাই ধীরে ধীরে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।
বর্তমানে পান্তা ইলিশ বাঙালিদের কাছে একটি জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দোকান গুলোতে পান্তা ইলিশ খাওয়ার জন্য ভিড় জমে। অনেকে বাড়িতেও পান্তা ইলিশ রান্না করে খান।
পান্তা ইলিশের জনপ্রিয়তার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, এটি একটি সুস্বাদু খাবার। পান্তা ভাতের অম্লতা এবং ইলিশ মাছের তেলমাখা স্বাদ মিলে অসাধারণ স্বাদের সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, পান্তা ইলিশ একটি পুষ্টিকর খাবার। পান্তা ভাতে ভাতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ডাল, ভর্ত্তা ,মাছ, মাংস ইত্যাদি মিশিয়ে খাওয়া হয়। তৃতীয়ত, পান্তা ইলিশ তুলনামূলকভাবে সস্তা খাবার। চতুর্থত, পান্তা ইলিশ রান্না করা খুব সহজ।
পান্তা ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু একটি খাবার নয়, বরং বাঙালিদের ঐক্য ও বন্ধুত্বের প্রতীক। পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খেয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে চলি।
পহেলা বৈশাখ এ বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের পণ্য, খাবার, খেলনা ইত্যাদি বিক্রি হয়। 'পহেলা বৈশাখ' এ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে গান, বাজনা, নাচ, কবিতা পাঠ, ইত্যাদি পরিবেশিত হয়।
অনেকে পহেলা বৈশাখে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা 'হালখাতা' করেন, অর্থাৎ গত বছরের হিসাব শেষ করে নতুন খাতা খোলেন।
পহেলা বৈশাখ ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে উদযাপন করা হয়। এই দিনটি বাঙালিদের জন্য একটি বিশেষ দিন যা তাদের ঐক্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলেও, সময়ের সাথে সাথে এর উদযাপন রীতিতেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি ধরে রেখেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে পহেলা বৈশাখের উদযাপনে। আগে পহেলা বৈশাখ মূলত গ্রামাঞ্চলেই উদযাপিত হত। বর্তমানে শহরাঞ্চলেও এই উৎসব উৎসাহের সাথে পালিত হয়।
পরিবার ও বন্ধুদের সাথে মিলে, নতুন পোশাক পরে, বিভিন্ন খাবার রান্না করে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগদান করে, মানুষ এই দিনটিকে আনন্দে কাটায়।
আগে পহেলা বৈশাখে গান, বাজনা, নাচ, কবিতা পাঠ ইত্যাদির মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গ্রাম ও পাড়ায় আয়োজন করা হত। বর্তমানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও টেলিভিশন চ্যানেলেও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিখ্যাত শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
আগে পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার আয়োজন করা হত। বর্তমানে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদির মতো আধুনিক খেলাধুলার প্রতিযোগিতাও এই দিনে অনুষ্ঠিত হয়।
পহেলা বৈশাখ নতুন জিনিসপত্র কেনার জন্য একটি আদর্শ সময়। বিভিন্ন দোকানে ছাড় ও অফার দেওয়া হয়। অনলাইন শপিংও বর্তমানে ব্যাপক জনপ্রিয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমেও পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা বার্তা ও ছবি শেয়ার করা হয়।
পহেলা বৈশাখ আশা ও অনুপ্রেরণার উৎস। এই দিনটি আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদী হতে অনুপ্রাণিত করে। নতুন বছরকে আমরা নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুরু করি।
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসব নয়, বরং বাঙালি জাতির জীবনে এটির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনটি আমাদের ঐক্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। পহেলা বৈশাখ আমাদের নতুন বছরকে আশা ও অনুপ্রেরণায় ভরে তোলে।
পরিশেষে, আমরা সকলে মিলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলতে এবং নতুন বছরকে আশা ও অনুপ্রেরণায় ভরে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই ।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/এমএস