ঈদযাত্রায় এবারো জনসুনামী পছন্দ ট্রেনের ছাদ!
ঈদের উপর আঁকা কার্টুনগুলো আমার খুব ভালোলাগে। তাই সবসময় কোনো ছাপানো ঈদসংখ্যা হাতে পেলে অথবা অনলাইনে দেখতে পলে খুব মনোযোগী হয়ে উঠি। এবার এপ্রিলের নয় তারিখ সকালে রণবীর চোখে ঈদ নামক পাঁচমিশালী কার্টুন সামনে পেয়ে আগ্রহ সহকারে পড়ছিলাম। সেখানে পিঁয়াজ, গোস্ত, কাক, মেট্রো, ইয়াবার গোলা, পাগল-টোকাই ইত্যাদি সবকিছুই আছে। এক ব্যক্তি বলছেন, ‘ঈদের আক্রা বাজারে আমাগো করণীয় কী? পাগল সেজে ঘরে থাকা আর বলতে থাকা.. ‘খাইতে চাইনা সাজারে, আর যামু না বাজারে’। মশারা বলছে, ‘চল যাই মেট্রোরেলে, কেউ মারতে পারবে না, সবার দুই হাতই হাতলে ধরা থাকে।’ কার্টুনে একজনের স্ত্রীর মন্তব্য, ভিনগ্রহের মতো আমাদের প্রিয় পৃথিবীতে তো অনেকগুলো চাঁদ নেই! তাই একটি চাঁদ উঠার উপর ভরসা করে ঈদের দিনক্ষণ ঠিক করতে হয়। এসব বিষয় নিয়ে বেশ মজা করছিলাম অন্যদের সাথে।
কিন্তু কার্টুনে এবার যানজট বা যানবাহনে হেনস্তা হবার বিষয় নেই। তাই বেশ ফুরফুরে ছিলাম এই ভেবে যে কয়েক ঘন্টায় বাড়ি যাওয়া যাবে। কিন্তু নয় তারিখ টিভির সংবাদের দিকে তাকাতেই হঠাৎ গত ক’দিনের ঈদযাত্রার স্বস্তির খবরগুলো ওলটপালট হয়ে গেল।
এপ্রিলের দশ তারিখে মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ-আমেরিকা সবজায়গায় ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। আমাদের দেশেও সেদিন ঈদ হতে পারে কিন্তু চাঁদ না ওঠায় একদিন পিছিয়ে এগার তারিখ ঈদ হবে। তাই নয় তারিখে চাঁদ উঠতে পারে ভেবে সরকারী শেষ কর্মদিবস এবং হাজার হাজার গার্মেন্টস কারখানা একসংগে ছুটি হওয়ায় হঠাৎ করে বাড়ি ফেরার জন্য পাগল হয়ে উঠে সাধারণ কর্মজীবী ও শ্রমিকরা। বাড়ি যাবার জন্য আকুলতা যেন সবাইকে গ্রাস করে দেয়।
সেজন্য গত কদিনের ঈদযাত্রার স্বস্তির খবরগুলোকে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে আজ জনতার ঢেউ উথলে উঠে রেল, বাস ও লঞ্চঘাটগুলোতে। বিশেষ করে এবারের ঈদযাত্রায় প্রস্তুত বনেদী ট্রেনগুলোর জন্য তৈরী সিস্টেম ভঙ্গ করে হঠাৎ করে জনস্রোত যেন সুনামীর রুপ ধারণ করে নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে প্লাফরমে ঢুকে পড়েছে। তাদেরকে চেক বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তারা অনেকে বরাবরের মতো কালোবাজারিতে স্টান্ডিং টিকিট কিনে অথবা বিনা টিকিটে না পেয়ে ট্রেনেরে ছাদে উঠে বসে পড়েছে।
এই দৃশ্য দেখে টঙ্গীর ইজতেমা শেষের অথবা ২০-৩০ বছর আগের বাংলাদেশের ঈদের সময়কার ট্রেনের চিত্র ফুট উঠেছে বলে মনে হলো। অতীতে আন্তর্জাতিক ফটোপ্রদর্শনীতে আমাদের রেলগাড়ি না মানবগাড়ি শিরোনামে অনেক ফটো প্রদর্শিত হয়েছে। যেখানে পুরো চলন্ত ট্রেনে শুধু মানুষের মাথা দেখা যেত। মনে হতো যেন ট্রেন নয়- মানুষের মাথাগুলো দুলে দুলে চলছে!
ভেবেছিলাম, আমাদের সেই অবস্থা পরিবর্তন হতে চলেছে। তাই এবারের ঈদে ঘরফেরা মানুষের সংবাদগুলো খুব পজিটিভ মনে হচ্ছিল। কিন্তু আজকের সব ধরণের গণপরিবহনে হঠাৎ করে যাত্রীসেবার বিপর্যয় যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল- আমরা এখনও আগের মতোই আছি। পরিবর্তন যা কিছু হয়েছে সেটা বিশেষ শ্রেণির সুবিধার জন্য। সর্বজনীন গণপরিবহনের সুবিধার বিষয়টি এখনও যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে।
আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকগণ কোন সেক্টরের দুর্বলতা ধরিয়ে দিলে মন খারাপ করেন, ক্ষেপে যান। তারা আত্মতুষ্টির প্রচারে আগ্রহী। সাধারণ জনতুষ্টির বিষয়টিকে পাত্তা দিতে চান না। বিশেষ করে দেশে নিন্ম আয়ের মানুষ ও শ্রমিক, দিনমজুর, ভিক্ষুক ও ভাসমান মানুষের সংখ্যা কতবেশি সেটা আমলে নিতে চান না। রাজধানী ঢাকায় দুই-আড়াইকোটি মানুষের মধ্যে কতজন কোন লেভেলে আয় করেন অথবা কিভাবে বেঁচে আছেন সেটা তাদের মাথায় কাজ করে না।
আজকের ঈদযাত্রার বিড়ম্বনা ঘিরে তাদের অবদান কতটুকু এবং তারা ঈদযাত্রার জন্য তৈরি সাজানো সিডিউল ভেঙ্গে কেন এই নিয়ন্ত্রণহীনতা তৈরি করলেন তা-কি একটু ভেবে দেখছেন? শুধু আজকে নয়- গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো গাজীপুর স্টেশনে থামলেই মানুষের ভীড়ে ট্রেনের ভেতর পা ফেলার জায়গা থাকেনা বলে সংবাদের ছবি শিরোনাম হয়েছে। প্রতিদিন শুধু কমলাপুর রেলস্টেশনের ছবি গণমাধ্যমে দেখানো হলেও দেশের অন্যান্য জায়গার ট্রেনের ছাদের চিত্র দেখে সহজেই বোঝা যায় জীবনের কোনো দাম নেই যাত্রীদের কাছে। ট্রেনের ছাদে উঠা যাত্রীদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই কর্তৃপক্ষের। কমলাপুরের বাইরের স্টেশনগুলো কি অবৈধ যাত্রী নিয়ন্ত্রণের ভেন্যু নয়?
এবছর নয় এপ্রিলের ঈদযাত্রায় নিয়ন্ত্রণহীন উত্তাল যাত্রীসুনামীর কথা মাথায় রেখে আগামী দিনের ঈদযাত্রার পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। নিম্নআয়ের যাত্রীসহ সকল যাত্রীসাধারণের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটি নিরাপদ ও সস্তা ঈদযাত্রীসেবা পরিবহন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করাটা বেশি জরুরি।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অনেক কিছু করা হচ্ছে কিন্তু তথ্যজ্ঞান ও আয় বৈষম্যের কারণে যাত্রীসাধারণের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য এত বেশি চোখে পড়ছে যে তা বলার মতো নয়। এসি ট্রেন, বাস, লঞ্চ সবকিছুই শিক্ষিত, উচ্চ বা মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য। তা ছাড়া কিছু সুবিধাভোগী সরকারী মানুষ সেগুলোতে যাত্রী হবার সুযোগ পান। ডিজিটাল টিকিট ব্যবস্থাপনায় গিয়েও টিকিট কালোবাজারী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হচ্ছে না। কারণ, সেখানে ডিজিটাল চক্র অত্যাধুনিক ফাঁদ পেতে দ্রুত লগইন করে টিকিট ছাড়ার সাথে সাথে নিজেরা কিনে নিয়ে সেটা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ভিন্নভাবে কালোবাজারে বিক্রি করছে। সাধারণ মানুষ যারা অনলাইনে ঢুকে ই-টিকিট কিনতে জানেন না। অনেকে ই-টিকিট কিনতে গিয়ে মোবাইলে নেটের নি¤œগতি বা পর্যাপ্ত ব্যালান্স না থাকার কারণে একটু দেরীতে লগইন করলে দেখানো হচ্ছে- টিকিট শেষ! এটাই অনেকের ভাগ্যে ঘটছে প্রতিনিয়ত। তারা টিকিট কিনতে না পেরে হতাশ হয়ে স্টেশনে বা অন্যত্র কালোবাজারীতে বেশিদামে টিকিট বা স্টান্ডিং কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক যাত্রী সেখানেও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। টিকিট অনলাইনে ছাড়ার সাথে সাথে কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যাবার মতো ভুতুড়ে পলিসি পরিবর্তন করতে না পারলে যাত্রীসেবার বিষয়টি ডিজিটাল প্রতারণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। যা ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের অবতারণা করেছে।
বাসের ক্ষেত্রে নতুন চাতুরী দেখা গেছে। সিটি রুটে চলাচলকারী বাসগুলো কয়েকদিন আগ থেকেই এত কমে গেছে যে একঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়েও বাসের সন্ধান মিলেনি। রাজধানীর বুকে সিটিরুটের নিত্য চলাচলকারী পুরাতন বাসের সত্তরভাগ গাড়ির বডি রং করে ঈদের সময় দূরপাল্লায় চলাচলের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে-যা খুবই ভয়ংকর। কারণ ফিটনেসবিহীন পুরাতন লোকাল বাসকে নতুন ড্রাইভার দিয়ে দূরপাল্লায় চালানোর জন্য পাঠানোর ফলে প্রতিবছর ঈদের সময় অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এরা রাস্তায় চাঁদা দিয়ে চলাচল করে। তাই এসব বাসে যাত্রীদের নিকট থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। এবছর তিনশত টাকার ভাড়া একহাজার করে নেয়ার ব্যাপার ঘটেছে।
ট্রেনের মতো লঞ্চে উঠার জন্য শেষ কর্মদিবসে একই সংগে দুই-তিনলাখ যাত্রী সদরঘাটে ভিড় করেছে। এবারে ঈদের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় ঘরমুখো মানুষের সংখ্যাও বেশি। এই সংগে সবার ছুটি হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় যানবাহনের উপর চাপ বেড়ে গেছে। বেড়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে দূরপাল্লার রুটে অবৈধভাবে ব্যবহার করার প্রতিযোগিতা। এসব অবৈধ যানবাহন ব্যবহারে সড়ক দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনায় কোন ইতিবাচক সুরাহা করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
তাই প্রতিবছর ঈদযাত্রার মতো আনন্দের যাত্রা অনেকের কাছে বিষাদের ছায়া বয়ে নিয়ে আসে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঈদের বাড়ি আসা-যাওয়ার বিষয়টি প্রতবছর আলোচিত হয় কিন্তু রাজধানী ছেড়ে যাওয়া এক-দেড়কোটি মানুষের নিরাপদ চলাচলের জন্য সব শেণির যাত্রী বা মানুষের কথা মোটেই চিন্তা করা হয় না। যে শ্রেণিপেশার মানুষগুলোর আয় অতি নগণ্য। কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরার জন্য নাড়ির টান খুবই প্রবল। তারা এত আকুলতার মাধ্যমে এদিনটির জন্য অপেক্ষা করে যে রোদ-বৃষ্টি ঝড় মাথায় নিয়ে দ্রুতগামী ট্রেন-বাসের ছাদে বসে রাতদিন কাটিয়ে ভ্রমণ করতে মোটেও ভয় করে না।
তাই এবছর নয় এপ্রিলের ঈদযাত্রায় নিয়ন্ত্রণহীন উত্তাল যাত্রীসুনামীর কথা মাথায় রেখে আগামী দিনের ঈদযাত্রার পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। নিম্নআয়ের যাত্রীসহ সকল যাত্রীসাধারণের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটি নিরাপদ ও সস্তা ঈদযাত্রীসেবা পরিবহন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করাটা বেশি জরুরি।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। [email protected]
এইচআর/জেআইএম