জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কলেজের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে দিন
কয়েকদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কলেজগুলো বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হবে। অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি চিন্তা। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের অধীনে পড়াশুনা করে। অথচ তাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২ হাজার ২৫৭টি কলেজে প্রায় ৩১ লক্ষ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী যা দেশে উচ্চ্ শিক্ষার মোট শিক্ষার্থীর ৭২ শতাংশ। এরমধ্যে সরকারী কলেজ ৫৫৫টি এবং ৩৩১টি বেসরকারী কলেজ অর্থাৎ ৮৮১টি কলেজে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর পাঠদান করা হয়। এসব কলেজে পড়াশুনার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একটি সম্মান ক্লাসে শিক্ষক ও ছাত্রের যে অনুপাত থাকা উচিৎ সে অনুপাতের ধারেও নেই কলেজগুলো।
একটি সরকারী কলেজে মানবিক ও কলা অনুষদের বিষয়ভিত্তিক ছাত্রসংখ্যা ৩০০ থেকে ৩৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে শিক্ষকের সঙ্গে কোনোভবেই যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না। বেসরকারী কলেজগুলোর অবস্থা বশী নাজুক। জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন কলেজে যত্রতত্র অনার্স কোর্স খুলে দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষাকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের কাছে।
এসব কলেজে নেই ভালো শিক্ষক নেই পর্যাপ্ত বইপুস্তক। লাইব্রেরির কোনো সুযোগ সুবিধা না থাকায় গাইড নির্ভর পড়াশুনা শিক্ষাকে পণ্য করে তুলেছে। মৌখিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে বই এর নাম জিঙ্গেস করলে গাইডের নাম বলে। ইংরেজি বই এর নাম কোনেদিন তারা শুনে না। এই যদি হয় অনার্স শ্রেণির অবস্থা তাহলে ডিগ্রি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অবস্থা ভাবুন। তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রি কোর্সের যে পরিমান ক্লাস হওয়ার কথা তার এক চতুর্থাংশ হয় কি না সন্দেহ। বিজ্ঞান (বিএসসি) ও বাণিজ্য (বিবিএ) গ্রুপের ছাত্রছাত্রীরা কিছু ক্লাস করে গণিত এবং ল্যাব থাকার কারণে। মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা গ্রহণ আর সনদ বিতরণ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
বিজ্ঞান অনুষদে ১৮০ থেকে ২০০ জন পর্যন্ত ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি করা হয়। ফলে বিজ্ঞানের ল্যাব ও হাতে কলমে শিক্ষার মান বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাছাড়া বিভাগীয় শহরের বড় বড় কিছু কলেজ ছাড়া জেলা ও উপজেলায় মান সম্মত পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বিষয় ভিত্তিক ক্রেডিট (ঘন্টা) আওয়ার ক্লাসের যে মান নির্ধারণ করা আছে সে বিষয়ে অনক শিক্ষকই জানেন না কতোটা ক্লাস তাকে নিতে হবে। তিন ক্রেডিটের একটি বিষয়ে কমপক্ষে ৪২টি ক্লাস নিতে হয়।
সে অনুযায়ী সপ্তাহে একটি বিষয়ে ৩টি ক্লাস নিলেও ৪ মাস ক্লাস নেওয়া আবশ্যক। ইচ্ছে থাকলেও কলেজের শিক্ষকরা এ মান বজায় রাখতে পারেন না। কারণ একজন শিক্ষক ৪ থেকে ৫টি বিষয়ের ক্লাস নেন প্রতিদিন ফলে সপ্তাহে ১২ থেকে ১৫ টি ক্লাস নিতে হয় । এ অবস্থায় একজন শিক্ষক কিভাবে মানসম্মত মেটিরিয়েল ক্লাসে ডেলিভারি দিবেন?
জনবল কম থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও একজন শিক্ষক প্রস্তুতি নিতে পারেন না। উপরন্ত যেসব কলেজে এইচএসসি, ডিগ্রী পড়ানো হয় সে কলেজগুলো মাসের পর মাস পরীক্ষা চলতেই থাকে ফলে একইসঙ্গে ক্লাস ও পরীক্ষা চালাানো সম্ভব হয় না। দেখা যায় পরীক্ষার আগে গড়ে একজন শিক্ষার্থী ১০ থেকে ১৫ টি ক্লাস করতে পারে না। চাকুরীজীবী শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না। ক্লাসের উপস্থিতি গণনা করে যেহেতু শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় না সেহেতু ক্লাসে না আসলেও কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। একবার ভর্তি হয়ে পরীক্ষা আর ফরম ফিলাপ করাই যেনো কলেজগুলোতে পড়াশুনা। এর ব্যতিক্রম হয়তো আছে কিছু কলেজে যেখানে ক্লাসের বিষয়ে কড়াকড়ি রয়েছে সামান্য।
লেখাটি যখন লিখছি সে মুহূর্তে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর একটি সংবাদ চোখে পড়লো রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাচ্ছে আরও ২০টি সরকারী কলেজ। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু অনার্স কোর্স পড়ানো বেসরকারী কলেজগুলোর বিষয়ে মাননীয় মন্ত্র কিছু বলছেন না কেন। হাজার হাজার শিক্ষার্থী যারা উচ্চ শিক্ষার নামে অদক্ষ বেকার হয়ে মফস্বলের কলেজ থেকে পাস করে বের হচ্ছে তাদের দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বানানো সম্ভব হবে কি?
২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান মনস্ক মেধাবী নাগরিক লাগবে। কর্মমুখী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এখনও কলেজগুলো আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বাজারমুখী কারিকুলাম নিয়ে ভাবছে না। শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের নামে যে প্রশিক্ষণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেয় সে প্রশিক্ষণ ক্লাসরুমে কতোটা প্রয়োগ হচ্ছে তার কোনো মূল্যায়ন আদৌ কি তারা করেন? গবেষণা মুলক প্রবন্ধ বা সেমিনার আয়োজন করেও বিষয়ভিত্তিক উৎকর্ষ সাধন করা যায় কিন্তু সে পথে হাটবে কে?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতি দেখভালের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ অবস্থায় সরকার যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলো দিতে চায় তাহলে সবচেয়ে ভালো একটি পদক্ষেপ হবে। ২০১৭ সালে ঢাকা শহরের ৭টি সরকারী কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেয়ার ফলে কলেজগুলোর শিক্ষার মান আগের চেয়ে অনেক ভালোর দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীর তালিকা কলেজগুলোতে পাঠিয়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে। ইয়ার প্রমোশনের প্রশ্ন পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কমিটি করে থাকে।
পরীক্ষার উত্তর পত্র মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা কমিটি ও কলেজের শিক্ষকরা করে থাকে। ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন টিউটোরিয়াল পরীক্ষা গ্রহণ করে নম্বর দেয়া হয় ফলে ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে পড়াশুনার আগ্রহ বেড়েছে। শিক্ষক ছাত্রের অনুপাত বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর সরকারী বেসরকারী কলেজগুলোর পড়াশুনার মান সন্তোষজনক হবে আশা করা যায়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি কলেজের (প্রায় ২০০০ কলেজ) শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার মান যদি নিশ্চিত করতে পারে তাহলেই ভালো। স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কলেজগুলোর দায়িত্ব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে দিলে শিক্ষার মানের যেমন উন্নয়ন ঘটবে তেমনি বেকারত্ব কমবে। প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দরোজা খুলে যাবে।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে এ সিদ্ধান্তের বিকল্প নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে শিক্ষা ও চিন্তায় স্মার্ট নাগরিক গড়ে তোলে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে স্মার্ট হতে হবে। প্রতিবছর কর্ম সংস্থানের চলমান বাজারে ৩১ লক্ষ আনস্মার্ট শিক্ষার্থী নিয়ে সম্ভব হবে না। সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন কোনো সাবজেক্ট না খুলে কলেজগুলোর বিদ্যমান বিষয়গুলো দেখভালের সিদ্ধান্ত বিবেচনাধীন আছে। এটি অনেক আধুনিক একটি চিন্তা। বিষয়টি কার্যকর করা গেলে কলেজগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। কাজের জবাবদিহিতা বাড়বে। মানবসম্পদ তৈরির কার্যকর পদক্ষেপ হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে দেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে কমিশন বঙ্গবন্ধুর হাতে রিপোর্ট তুলে দেন। কমিশনের রিপোর্টে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু সরকারের নীতিই অনুসরণ করছেন। দেশের উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো (বিশ্ববিদ্যালয়) যদি যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও আধুনিক বাজারমুখী শিক্ষার দায়িত্ব না নিতে পারে তাহলে বিশ্ব বাজারের চাহিদা থেকে ছিটকে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ থেকে যাবে অধরা ।
লেখক : শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর। সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষক ফেডারেশন।
এইচআর/এমএস