ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চিনির দাম বাড়ানোর কাহিনী

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ০৩ মার্চ ২০২৪

আমরা জানি যে চিনি কেবল শরীরে শক্তিদাতা। তবে যে সত্য জানেন চিকিৎসকগণ, সেই সত্য আমরা মানি না অনেকক্ষেত্রেই। চিনি শক্তিদাতা খাদ্য হলেও তা শরীরের জন্য বিষও বটে। ইদানিং অনেকেই বলেন, মানবদেহের জন্য অতিরিক্ত ( প্রয়োজনের চেয়ে বেশি) চিনি ও নুন খাওয়া বিষতুল্য।

এই বিষতুল্য খাদ্য উপকরণ আমাদের প্রিয়বস্তু। আর বোধহয়, খোলাবাজারে চিনির দাম নিয়ে বেশ কারচুপি হয়। নিত্যদিন না হলেও চিনির দাম বাড়াতে ওস্তাদি আছে, চলছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছিলো যে চিনির দাম বাড়ানো হচ্ছে। আর অমনি ঝাঁপিয়ে পড়লো চিনির আমদানিকারক, মজুতকারী, বড় ব্যবসায়ী এবং খুচরো দোকানিরা।

তারা দাম বাড়ায়ে বিক্রি করছেন। প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন তারা। কিন্তু সরকার যে দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর তা বাতিল করে দিয়েছেন ( কেন করেছেন তা বলা যাচ্ছে না।) সেটা দোকানিরা জানলেও তা মানছেন না। তারা বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন। মানে, এই সুযোগে টু-পাইস’ কামিয়ে নেয়া।
এই মানসিকতাই হলো আমাদের প্রধান শত্রু। আর একটা সত্য এই দেশে চলছে, দাম একবার বাড়ানো হলে সেই পণ্যের দাম দেশে ও বিদেশে কমে এলেও, দোকানিরা তা মানছেন না। তারা যা বেড়েছিলো, সেই মাপেই বিক্রি করছেন। এই না কমানোর শক্তি তারা লালন করেন। কারণ তারা মনে করেন, এটা কোনো অন্যায় নয়। বেশি দামে কিনছে কেন মানুষজন?

কোনো নজির নেই যে সরকার দাম বেঁধে দেয়ায়, দোকানিরা সেই দামে বিক্রি করছেন পণ্য। উত্তরে তারা বলেন, যান, সরকারের কাছে থেকে কিন্যা নিয়া আসেন। আমরা দিবার পারমু না। এ-কথা শুনে কষে একটা চড় মানতে ইচ্ছে জাগে, কিন্তু সেটা করতে পারি না। ভোক্তা জনগণের সমস্যা এখানেই।

তারা না কিনলেই তো আমরা বিক্রি করতাম না। ক্রেতাগণ সংগঠিত জনশক্তি হলে দাম কমানোর জন্য তারা রাস্তায় নামতো। তারা বাধ্য করতো দোকানি, আড়তদার, হোলসেলারদের দাম কমানোর জন্য। সংগঠিত জনশক্তিকে সবাই ভয় পায়। বিশেষ করে ভয় পায় সরকার। তাদের তখতেতাউস ভেস্তে যেতে পারে, এই ভয়েই তারা জনগণের পক্ষে কিছু না কিছু কাজ করে। তবে সেই কাজ দাম কমানোর নয়, তারা কুমিরের লেজ দেখানোর মতো করে উন্নয়নের সেতু, টানেল, হাইওয়ে ও এলিভেটেড রোডের গীত গায়।

অর্থাৎ যা চাইবে জনশক্তি তার বিপরীতে উন্নয়ন দেখাও। এটাও রাজনৈতিক অসততা ও রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি। আমরা কোভিড পূর্ব ও উত্তর কালে দেখলাম সরকারের এই রাজনৈতিক লুকোচুরি, যা সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে জনগণকে বোঝ দেয়া। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজের রাজনৈতিক সমাজের প্রধান দুর্নীতি।

এটা যে মানসিকভাবে দুর্নীতি এবং সামাজিক ক্রাইম, ক্রেতার মৌলিক অধিকারকে হরণ করা হচ্ছে, সেটা তারা মানবেন না। ঠিক, পাতে টোকা লবণ বা নুন খাওয়ার মতোই বিষয়টা। নুন যে তার জান নেবার জন্যই `অতি’ রিক্ত ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা বোঝার মতো জ্ঞান সাধারণের নেই। ঠিক, অতিরিক্ত মুনাফা যে অন্যায়, অবৈধ ও মানসিক দুর্নীতির লক্ষণ তা বোঝার মতো প্রজ্ঞা আল্লাহ তাদের দেয়নি।

অথচ আমাদের যে মগজটি পেয়েছি দান হিসেবে, তার `সৎ ব্যবহার’ ও সদ্ব্যবহার তারা করছেন না। ২২ কোটি নিউরনের অধিকারী হচ্ছে পুরুষ, আর ১৯ কোটি নিউরনের অধিকারী হচ্ছে নারী। নারী বা পুরুষ, যিনিই হোন না কেন, ওই চিনি আর নুনের ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও জ্ঞান না থাকলে তারা ওই দুটি খাদ্য ব্যবহারের পার্থক্যই বুঝতে পারবেন না।

অতিরিক্ত মুনাফা লোটার মানসিকতা থেকেই বোঝা যায় এদেশের ব্যবসায়ীগণ অতিরিক্ত লোভী। লোভ উপলব্ধিটা ক্যান্সারের মতো উপাদান। এই ক্যান্সার উপকরণ আমাদের মনেই বাস করছে। ফলে আমরা মুনাফার কথাটা আগে ভাবি, কখনোই ন্যায্য দামের কথা ভাবি না। যত অন্যায়ের সূচনা সেখান থেকেই।

দুই.
উদাহরণ হিসেবে আমরা সরকারের নীতি আদর্শের কথা বলতে পারি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে গেলেও বাংলাদেশে তার দাম কমে না। এ-রকম নজির একবারও দেখাতে পারবো বলে মনে হয় না। সেই তেল হোক গাড়ি বা বিদ্যুৎ/ইন্ডাস্ট্রির জন্য কেনা বা ভোজ্যতেল। কিংবা গমের দাম নিয়েও কতো যে তেলেসমাতি দেখিয়েছেন আমদানিকারক ও বেসরকারি ব্যবসায়ীগণ, তাদের সহযোগ দিয়েছে সরকারের কর্মকর্তারা, রাজনৈতিক নেতারাও এর সঙ্গে জড়িত।

তারাও যে নানা উপায়ে `টু-পাইস’ কামাতে মানসিকভাবে তৈরি, তা কি আমরা হলফ করে বলতে পারি না। পারি, কিন্তু ভয়ে বলি না। কারণ, যারা সরকারে নীতিনির্ধারক, তারাই তো ওই দুর্নীতির উৎস। কিন্তু তারা সেটা মানবেন না। যেমন খুচরো দোকানি মানেন না। তারা বলেন বেশি দামে কিনেছি, ঠিক বেশি দামেই বিক্রি করছি। কিন্তু তারা মজুতদার বা আড়তদারকে বলেন না যে দাম কমেছে, সেই ন্যয্য দাম রাখেন।

আবার সরকার দাম কমানোর সার্কুলার জারি করেই ভাবেন, তাদের ওই পত্রাঘাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না কখনোই। কোনো নজির নেই যে সরকার দাম বেঁধে দেয়ায়, দোকানিরা সেই দামে বিক্রি করছেন পণ্য। উত্তরে তারা বলেন, যান, সরকারের কাছে থেকে কিন্যা নিয়া আসেন। আমরা দিবার পারমু না। এ-কথা শুনে কষে একটা চড় মানতে ইচ্ছে জাগে, কিন্তু সেটা করতে পারি না। ভোক্তা জনগণের সমস্যা এখানেই।

তারা ভদ্রতার বাইরে যেতে পারেন না লোকলজ্জার ভয়ে। এদিকে তাদের পকেট ফাঁকা করে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রেতারা। আর সরকার তাদের উপদেশ দিচ্ছেন, রমজানে দাম বাড়ানো যাবে না। সরকার একবারও বলেন না যে, পণ্য ক্রয়মূল্যের চেয়ে ৫/১০ শতাংশের বেশি দামে বিক্রি করা যাবে না।

বৃহৎ বিক্রেতার উৎসে যদি দাম ঠিক করে বিক্রি নিশ্চি করা যায়, তাহলে রিটেলরা বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন না। সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী টিটো সাহেব বলেছেন, এবার পণ্যের প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা থাকতে হবে/থাকবে। সেই দামেই বিক্রি করতে হবে। বিক্রেতা যদি বেশি দাম হাঁকে, তাহলে তার সঙ্গে তো ঝগড়া বেধে যাবে, হতে পারে তা গড়াবে মারামারিতে। সেটা কি ভালো কোনো ফল দেবে?

আমরা জানি খোলাবাজারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। কারণ আমাদের খুচরো দোকানিদের লক্ষ্যই অতি মুনাফা কারা। সরকারের লোকজনও চায় ও রিটেলারগণ টু-পাইস কামাক। এই সব ছোটোখাটো বিষয়ের জন্যই আমাদের ভোক্তাদের কেটে বেরিয়ে যায় হাজার হাজার কোটি টাকা।

আশাবাদী হতে ক্ষতি নেই। এবার অন্তত জনগণের পক্ষেই থাকবেন রাষ্ট্রের কর্তাগণ।

০২/২৫/২৪
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন