ইতিহাস ভুলে যাওয়ার ক্ষতি এই জাতিকে বহন করতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময় আমাদের খণ্ডকলীন শিক্ষক ছিলেন শাহেদ কামাল স্যার। উনি একজন সাংবাদিক ছিলেন। শাহেদ কামাল স্যার খণ্ডকালীন শিক্ষক হলেও ওনার চাপে আমাদের অবস্থা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। উনি বলতেন সব ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ করে সাংবাদিকতার স্টুডেন্ট হিসেবে দেশ-বিদেশ, প্রকৃতি-পরিবেশ, জীবন ও স্বাস্থ্য, জলবায়ু-আবহাওয়া ইত্যাদিসহ জগত সংসারের সব তথ্য অল্পবিস্তর জানা প্রয়োজন। স্যার পড়াতেন রিপোর্টিং কিন্তু পরীক্ষা নিতেন সাধারণ জ্ঞানের। প্রথম প্রথম স্যারের প্রশ্নগুলো আমাদের জানার আওতায় ছিল। যেমন বাংলাদেশের ইতিহাস, সরকার ব্যবস্থা, বিভিন্ন মহাদেশের বেসিক তথ্য, জলবায়ু ও রাজধানীর নাম ইত্যাদি।
ক্রমশ স্যারের মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী হিসেবে আমাদের সাধারণ জ্ঞান বেশ সীমিত। তাই উনি যখন তখন আমাদের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নেয়া শুরু করলেন। আমরা দলবেঁধে পত্র-পত্রিকা পড়া শুরু করলাম, যাতে কনটেম্পরারি কোনোকিছুই বাদ না যায়। এটা সত্যি যে ওই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আমাদের অনেককিছুই জানা হয়েছিল। এরপরেও কিছু প্রশ্ন এত অজানা অধ্যায়ের ছিল যে আমরা অনেকেই পাস নাম্বার পেতে ব্যর্থ হতাম। কিন্তু যে বেসিক তথ্যগুলো আমরা স্কুল-কলেজে শিখেছি, তা ঝালাই হয়েছিল এবং আমরা অনেক কিছু সম্পর্কে নতুনভাবে ধারণা পেয়েছিলাম। তখন কষ্ট হলেও কাজ করতে এসে আমাদের লাভই হয়েছে।
এত কথা বলার কারণ হচ্ছে সেদিন একটি ভিডিওতে কিছু তরুণ-তরুণীর কমেন্টস দেখে এতটাই হতাশ হলাম ও কষ্ট পেলাম, যাতে মনেহল আমাদের অর্জনের ষোল আনাই হয়তো মিছে হওয়ার পথে। জনকণ্ঠ এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেলে বইমেলার গেট থেকে একটি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত তরুণ-তরুণীদের কাছে মূলত তিনটি প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করা হয়েছে, যেমন ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিজয় দিবস কী এবং কবে হয়েছিল?
ইতিহাস নিয়ে ভালো বই ও সিনেমা অনেক আছে, কিন্তু আমাদের ইতিহাসকে আমরা ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। দিন দিন বইমেলাটাকে হারিয়ে ফেলছি। শুধু দিবস পালন, আলোকসজ্জা, মাথায় ফুলের টুপি, রিল, ভাইরাল করা বা হওয়া, নতুন পোশাক এসবকিছুর মধ্যে ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস হারানোর ক্ষতি এই জাতিকে বহন করতে হবে।
আমি জানিনা হয়তো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ব্যক্তি তাদেরই হাইলাইট করেছেন, যারা সঠিক উত্তর জানেন না। সবাই সবকিছু জানবে এটা যেমন আমরা আশা করতে পারি না, তেমনি এটাও আশা করি না যে ঢাকায় বসবাসরত, আধুনিক সাজগোজে সজ্জিত, কথাবার্তায় উচ্ছল এবং সর্বোপরি বইমেলায় আগত তরুণ-তরুণীরা একটা প্রশ্নেরও সঠিক জবাব দিতে পারবেন না বা ভুল উত্তর দেবেন।
এত সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে তারা ঠিক লজ্জিত হচ্ছেন না বরং হেসে গড়িয়ে পড়ছেন, হাত দিয়ে মুখ ঢাকছেন এবং ভাইরাল হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। যারা দেখেছেন এই ভিডিওটি তারাই অবাক হয়েছেন। অনেকে ঠিক বিশ্বাসও করতে চাইছেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব লজ্জিত হয়েছি। বইমেলায় যখন এসেছেন, তখন বই না কিনলেও এরা যে মোটামুটি শিক্ষিত তা ধরে নিতে হবে। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চুলের রং, বাহারি চশমা দেখে বোঝা যায় এরা ঠিক পথের মানুষ নন।
এইবার বইমেলায় যেসব কাণ্ড করছে সেগুলো দেখে মাঝেমাঝে সন্দেহ হচ্ছে কেউ কেউ হয়তো ষড়যন্ত্র করছে বইমেলার গরিমা নষ্ট করে দেয়ার জন্য। বইমেলাকে ঘিরে নানাধরনের সমালোচনা হয় যেমন অব্যবস্থাপনা, ধুলাবালি, ভীড়, হাড়ি-পাতিল, খাবার প্লাস্টিকের দোকান এইসব নিয়ে। কিন্তু চলতি বছর তিশা-মোশতাক জুটি ও জেলফেরত ডা. সাবরিনাকে নিয়ে যা হচ্ছে বইমেলায়, তা সবকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তারপর ভুয়া ধ্বনি দেয়া হয়েছে আয়মান সাদিককেও। যদিও ভুয়াধ্বনি দাতারা বলেছেন তারা আয়মান সাদিক ও তার স্ত্রীকে চিনতে পারেননি। তবে যেকারণেই হোক বইমেলার চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে।
একশ্রেণির মানুষ শুধু ডা. সাবরিনাকে দেখার জন্য, তার ছবি তোলার জন্য ভীড় করেছে। ভিডিওতে দেখলাম ডা. সাবরিনাও সাজগোজ করে পুতুলের মতো মেলা চত্বরে বসে আছেন। ভিডিও ক্যামেরা দেখে তরুণরা এত অদ্ভুভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে যে দেখলে মনে হয় এরা আমাদের খুব অপরিচিত। এদের কারো হতেই বই নেই, চেহারায় তেজ নেই, নেই উজ্জ্বলতা ও দৃঢ়তা। তাহলে এরা বইমেলায় কেন?
বই মেলাতো বাণিজ্যমেলা নয় যে খামোখাই দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া যায়, চিৎকার ও চেঁচামেঁচি করা যায়, যেকোন দোকানের সামনে ভীড় করা যায়। সবচেয়ে বড়কথা এই তরুণ প্রজন্ম বইমেলায় গিয়ে অন্যকে অপমান করছেন, যা খুবই অনভিপ্রেত। কেউ যখন কোনো একটা অন্যায় কাজ করেন, তখন সে "কী করছেন" সেটার চেয়ে জরুরি হচ্ছে এটা জানা যে "কেন করছেন"?
এই দুর্বিনীত শ্রেণিএকধরনের এটেনশন সিকার। যেসব লেখক খুব নিন্মশ্রেণির বই লিখে মেলা চত্বরে বই ও নিজেকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন, তারাও তাই। এদের লক্ষ্য বই নয়, নিজেকে যেমন করে হোক জাহির করা। এবারের বইমেলাটা এদের হাতে পড়েছে। বই সবার জন্য নয়, ইলেকট্রনিক ডিভাইস মাঠে নামা আগেও সবাই বই পড়তো না, কিনতোও না। এরপরেও অনেকেই বইমেলার যেতেন, বই ঘেঁটে দেখতেন, পছন্দ হলে কিনতেন, গল্প, আড্ডা, ভিড় সবই ছিল। কিন্তু এবছরের মতো অশোভন ও অভব্য আচরণ আগে দেখেছি বা শুনেছি বলে মনে করতে পারছিনা।
মাঝেমাঝে জানতে ইচ্ছা করে এই তরুণ জনতার কতজন “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” গানটির প্রথম প্যারাটি গাইতে পারে? এই গান গাইতে গাইতে, পরাণভরা ভালবাসা নিয়ে, পায়ে হেঁটে প্রভাতফেরীর মিছিলে অংশ নেয় কতজন? রিল, ভিডিও, ভাইরাল হওয়া, নতুন পোশাক, স্টাইল এগুলোই হচ্ছে এখন দিবস পালনের মূল উপজীব্য, শহীদ দিবসও এ থেকে বাদ যাচ্ছেনা।
এরা রফিক, জব্বার, বরকত, সালামের গল্প শুনেনি, শহীদ আলতাফ মাহমুদ ও আবদুল গাফফার চৌধুরীর নাম জানেনা। স্বাধীনতার পরের কয়েকটি প্রজন্মের শিশু-কিশোর ও তরুণরা যেভাবে একুশকে দেখেছে, ২০০০ সাল পরবর্তী প্রজন্ম সেভাবে দেখেনি, বরং অনেকটাই উপেক্ষা করা হয়েছে এই অর্জনকে। শহীদ স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে যেতে লক্ষ্য করছি সময় বদলে গেছে, আমরা বদলে গেছি, আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাও বদলে গেছে। একদিন লক্ষ্য করলাম শহীদ বেদি থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছি। কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। অন্যভাবে এগুনোর চেষ্টা করতে হবে।
এখন যেহেতু শিশু সংগঠন নাই, বাবা-মায়েদের হাতে সময় নাই, শিশুরা বই পড়তে অনাগ্রহী কিন্তু ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ও বিভিন্ন এপের প্রতি তারা আগ্রহী। ম্যুভির প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, শিশু-কিশোররা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে, তাই আমাদের উচিৎ প্রযুক্তির মাধ্যমেই শিশু-কিশোরদের হাতে একুশ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সঠিক ও আগ্রহ জাগানো তথ্য পৌঁছে দেয়া। স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর ও ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পার হলো, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি, মুক্তি সংগ্রাম, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান এমন কি এরশাদ বিরোধী আন্দোলন নিয়েও ভালো কোনো চলচ্চিত্র হয়নি। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, জেলহত্যা দিবস কোনোকিছু নিয়েই তেমন কোনো প্রচারণা চোখে পড়ে না। দিবস উদযাপন করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানান আয়োজন থাকে, থাকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা। কিন্তু ইতিহাস নির্ভর কোনো নাটক বা চলচ্চিত্র না থাকলে একদিন এইসব দিবসের প্রকৃত চিত্র হারিয়ে যাবে, সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।
ভাষা আন্দোলনের গল্প শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করার ষড়ষন্ত্রমূলক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রে থাকবে একুশকে ঘিরে আরো অনেক জানা-অজানা ইতিহাস।
বাংলা ভাষার উপর প্রথম আঘাত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতিবাদ, ৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলের প্রস্তুতি, ছাত্র আন্দোলন, দেশব্যাপী মিছিল, রফিক, জাব্বার, বরকত, সালামের শহীদ হওয়া, মেয়েদের প্রতিরোধ, ইটের মিনার গড়ার কথা, আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের সমাধি ক্ষেত্র, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানের কথা ও সুর নিয়ে তথ্য, রাতের প্রভাতফেরীসহ রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অবদান সব ঘটনা ও কাহিনী তুলে ধরতে হবে।
এই ইস্যুগুলো তুলে এনে একটি অসাধারণ সিনেমা যদি বানানো যায়, তাহলে সেই সিনেমাই হারিয়ে যাওয়া একুশকে ফিরিয়ে আনবে দেশে ও বিদেশে। বিশ্বের কোন দেশ ভাষার জন্য আন্দোলন করেনি, প্রাণদানও করেনি, শুধু বাঙালিরা করেছে। কাজেই আমাদেরই দায়িত্ব একুশ নিয়ে একটি বিশ্বমানের সিনেমা বানানো।
ইতিহাস নিয়ে ভালো বই ও সিনেমা অনেক আছে, কিন্তু আমাদের ইতিহাসকে আমরা ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। দিন দিন বইমেলাটাকে হারিয়ে ফেলছি। শুধু দিবস পালন, আলোকসজ্জা, মাথায় ফুলের টুপি, রিল, ভাইরাল করা বা হওয়া, নতুন পোশাক এসবকিছুর মধ্যে ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস হারানোর ক্ষতি এই জাতিকে বহন করতে হবে।
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম