ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন যুগ!

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৮:৫৮ এএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

১২ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। এইদিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। কথায় কথায় আমরা ‘নতুন অধ্যায়’ লিখি বটে, কিন্তু সব নতুন অধ্যায় বা যুগ হয়ে ওঠে না। তবে ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বৈঠকে যা হয়েছে, তা সত্যিই বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নতুন যুগের যাত্রা। কী হয়েছে তা আপনারা সবাই জানেন। এক লাইনে বলে নেই- তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। আর প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পেয়েছেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু।

আপনাদের মনে হতে পারে, নতুন প্রধান নির্বাচক তো হতেই পারে, তাতে নতুন যুগ হবে কেন? প্রথম কথা হলো নাজমুল হোসেন শান্ত অধিনায়ক হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে কার্যত পঞ্চপান্ডব যুগের অবসান ঘটলো। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপান্ডবের গল্প নিশ্চয়ই আপনাদের সবার জানা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট চলেছে কার্যত মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর ওপর ভর করে।

কী নেতৃত্বে, কী মাঠের পারফরম্যান্সে- এই পাঁচজনই সামনে থাকতেন। মমিনুল হককে বাদ দিলে এই পাঁচজনই বিভিন্ন ফরম্যাটে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই পাঁচজনের মধ্যে পারফরম্যান্সে অবশ্যই সাকিব সবার আগে। শুধু এই পাঁচজন বলে নয়, পারফরম্যান্স বিবেচনায় সাকিব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা। বিশ্বেরই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের ছোট্ট তালিকায়ও থাকবে তার নাম। তবে পারফরম্যান্সের মত বিতর্কেও সেরা সাকিব। পারফরম্যান্সে যেমন মাঠে আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি ব্যক্তিগত বিতর্কে বারবার বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছেন সাকিব।

এখন পর্যন্ত সাকিব বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হলে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান অবশ্যই তামিম ইকবাল। সাকিব-তামিমের বন্ধুত্বের রসায়ন একসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের আলোচিত অধ্যায় ছিল। আবার তাদের শত্রুতা নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহ আত্মার আত্মীয়। দুই বোনকে বিয়ে করেছেন তারা দুজন। এই দুই ভায়রা বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক লড়াকু অধ্যায়ের সাক্ষি। মাহমুদুল্লাহ তো প্রত্যাবর্তনের নতুন গল্প লিখেছেন বারবার।

সবাই, এমনকি নির্বচকরাও যখন মাহমুদুল্লাহকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন, তখনও তিনি ফিরে এসেছেন পারফম্যান্সে ভর করে। যার যাওয়ারই কথা ছিল না, সেই মাহমুল্লাহই গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা পারফরমার। তার বুড়ো হাড়ের ভেলকি বুঝি এখনও বাকি রয়ে গেছে।

পঞ্চপান্ডবের মধ্যে সবচেয়ে কম গ্ল্যামারাস মাহমুদুল্লাহকে আমি 'ফাইটার' হিসেবে আমি সবচেয়ে এগিয়ে রাখবো। তবে পঞ্চপান্ডবের মধ্যে আমি সবচেয়ে এগিয়ে রাখবো মাশরাফিকে। তার নেতৃত্বগুন শুধু বাংলাদেশ নয়, যে কোনো দেশের জন্যই সম্পদ। মাশরাফির নেতৃত্বেই সম্মানজনক পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে জিততে চাওয়ার মানসিকতায় উত্তরণ ঘটে বাংলাদেশের। ২০১৫ এর বিশ্বকাপ ছিল সেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের দেখানোর মঞ্চ। স্পিন নির্ভরতা কাটিয়ে পেস অ্যাটাক নিয়ে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শুরুটাও তখনই।

আমার চোখে যিনি পঞ্চপান্ডবের সেরা, পঞ্চপান্ডবের শেষের শুরুটা হয়েছিল সেই মাশরাফির হাত ধরেই। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর মাশরাফি ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। কিন্তু অবসরের আগেই সরকারি দলের এমপি হয়ে যাওয়া, ২০১৯ বিশ্বকাপে অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্স তাকেও সাধারনের কাতারে নামিয়ে আনে। যার একটি গ্র্যান্ড-গালা বিদায় প্রাপ্য ছিল, সেই মাশরাফি মাঠ ৎেকে বিদায়ের সুযোগটাও পাননি। টানা দ্বিতীয়বারের সংসদ সদস্য মাশরাফি এখন জাতীয় সংসদের হুইপ। এখনও বিপিএল খেলছেন। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফেরার যে কোনো সম্ভাবনা নেই সেটা তিনি নিজেও জানেন।

গত বিশ্বকাপে তামিমের অধিনায়ক থাকার কথা। নানা নাটকীয়তায় তার যাওয়াই হয়নি। বিশ্বকাপের আগে এক প্রেস কনফারেন্সে 'আমাকে মনে রাইখেন, ভুলে যাইয়েন না' তামিমের এই আকুতি আসলে তার বিদায় বার্তাও। মাহমুদুল্লাহ কখন আসেন, কখন যান; নিজেও জানেন না। তার ক্যারিয়ার মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার মত। কখন মিউজিক থেমে যাবে, তিনিও জানেন না। কখন থামতে হবে, এটা যদি জানেন মুশফিক অন্তত বোঝেন, তাহলে ভালো হয়।

সাকিবকে নিয়ে আমার আফসোসের কোনো শেষ নেই। নিয়মিত সব ম্যাচ খেললে বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার সুযোগ ছিল তার সামনে। তিনি হেলায় সে সুযোগ হারিয়েছেন। তাতে তার নিজের তো ক্ষতি হয়েছেই, দেশের ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি। ক্রিকেটটা সবচেয়ে ভালো খেলেন। কিন্তু বরাবরই তার মনোযোগ অক্রিকেটেই বেশি। দেশের ক্রিকেট ফেলে শোরুম উদ্বোধন করতে চলে যাওয়াটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস যেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানপর্বের সঙ্গী গাজী আশরাফ লিপু আর নতুন দিনের বারতা নিয়ে আসা নাজমুল হোসেন শান্তর হাত ধরেই শুরু হোক বাংলাদেশ ক্রিকেটের নবযাত্রা। সম্মানজনক পরাজয় থেকে জিততে চাওয়ার আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। এখন জয়টাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। ক্রিকেটই আমাদের আনন্দ দেয়, ঐক্যবদ্ধ রাখে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাই ক্রিকেটে আমরা যেতে চাই বহুদূর।

মাশরাফির পথ ধরে অবসরের আগেই এমপি বনে গেছেন। এখন সাকিব কী করবেন? ক্রিকেট খেলবেন, রাজনীতি করবেন, শোরুম উদ্বোধন করবেন না ব্যবসা করবেন? একজন বলেছিলেন, ক্রিকেট ও রাজনীতিকে ব্যবহার করে ব্যবসা করবেন। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা শুরু করতে জানি। কিন্তু কোথায় থামতে হবে সেটা জানি না। তাই বিদায়ে প্রাপ্য মর্যাদাটাও পাই না।

পঞ্চপান্ডবের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একসঙ্গে তারা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনেক দিয়েছেন। বছর তিনেক আগেও মনে হতো, এই পাঁচজন চলে গেলে বাংলকদেশ ক্রিকেটের কী হবে? কিন্তু এখন আমি দিন গুনছি, কখন এরা যাবেন। পঞ্চপান্ডব বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একটা পর্যায়ে তুলে এনেছেন। কিন্তু তাদের কারণেই ক্রিকেট একটা বৃত্তে আটকে আছে।

পঞ্চপান্ডবের কেউ কেউ নিজেকে দেশের চেয়েও বড় মনে করেন। তারা বোর্ড, পরিচালক, নির্বাচক, অধিনায়ক কাউকে পাত্তা দেন না। তাদের জন্য কোচ টিকতে পারেন না। কোনো নিয়ম মানতে চান না। সিনিয়ররা মানেন না বলে জুনিয়ররাও লাই পায়। এই সিনিয়রদের জন্য দলে কোনো শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছিল না। এরা বিদায় হলেই বিসিবি নতুন করে সাজাতে পারবে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। নাজমুল হোসেন শান্তের নেতৃত্বেই শুরু হচ্ছে সেই নতুন যুগের যাত্রা।

এবার একটু শান্তর কথা বলি। বাংলাদেশের ফেসবুকারদের সবচেয়ে সহজ টার্গেট ছিলেন তিনি। বছর তিনেক আগেও তাকে নিয়ে সমানে ট্রল হতো। কেন জানি না, তাকে সবাই 'লর্ড শান্ত' ডাকতো। তিনি নাকি বোর্ডের কৃপায় খেলে যাচ্ছেন। কিন্তু শান্ত প্রমাণ করেছেন, নির্বাচকরা রত্ন চিনতে ভুল করেনি। বোর্ডও তার পেছনে বিনিয়োগ করে ঠিক কাজটিই করেছে।

গতবছর শান্ত ছিলেন সেরা পারফরমার। সাকিবের অনুপস্থিতিতে ফাঁকে ফাঁকে নেতৃত্ব গুণেরও ঝলক দেখিয়েছেন। এখন সময় সেই ঝলককে স্থায়ী রূপ দেয়ার। পঞ্চপান্ডবের পর অধিনায়ক হিসেবে ভাবা হচ্ছিল, লিটন, মিরাজদের কথা। কিন্তু শান্ত নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে অধিনায়কত্ব পেয়েছেন। ট্রলের লর্ড এখন সত্যিকারের লর্ড। এখন সময় নিজেকে প্রমাণের।

ক্রিকেট টিম হয়ে ওঠার জন্য মাঠের পারফরম্যান্সের মত দলের ডিসিপ্লিনটাও দরকার। আনেকদিন যেটা দলে নেই শান্ত যুগে ডিসিপ্লিন ফিরবে, এই আশাবাদের বড় কারণ গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। বাংলাদেশে বিসিবির প্রধান, বাফুফের সভাপতি, ওয়াসার এমডির মত ক্রিকেটে প্রধান নির্বাচকের পদটিও স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল।

নির্বাচক কমিটি খারাপ করেছে, এমনটি আমি বলবো না। তবে তারা ঠিকমত নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। কখনো অধিনায়ক, কখনো কোচ তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন তো বরাবরই সুপার সিলেক্টর। ঘোষণার আগেই তিনি মিডিয়াতে দল জানিয়ে দিতেন। যতটুকু জানি পূর্ণ স্বাধীনতার শর্ত ও ক্রিকেটের স্বার্থেই তিনি এ দায়িত্ব নিতে রাজি নন। অনেকদিন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকলেও গাজী আশরাফ লিপু বিসিবির প্রভাবশালী পরিচালক ছিলেন। পরিচালক থেকে প্রধান নির্বাচক- পদাবনতি মনে হতে পারে, তবে দায়িত্বটা অনেক বড়। আর তিনি পরিচালকের মর্যাদা পাবেন। গাজী আশরাফ লিপু বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসের সাক্ষি।

বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক লিপু ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়েও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অধিনায়ক আকরাম খান, কোচ গর্ডন গ্রিনিজের সাথে ম্যানেজার গাজী আশরাফ চমৎকার মেলবন্ধনটাই গড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিত্তি। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জিতেই বাংলাদেশ পেয়েছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ। প্রথম বিশ্বকাপেই পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই চমকের সূত্রেই আসে টেস্ট স্ট্যাটাস। যার পথ ধরে আজকের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানপর্বের সঙ্গী গাজী আশরাফ লিপু আর নতুন দিনের বারতা নিয়ে আসা নাজমুল হোসেন শান্তর হাত ধরেই শুরু হোক বাংলাদেশ ক্রিকেটের নবযাত্রা। সম্মানজনক পরাজয় থেকে জিততে চাওয়ার আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। এখন জয়টাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। ক্রিকেটই আমাদের আনন্দ দেয়, ঐক্যবদ্ধ রাখে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাই ক্রিকেটে আমরা যেতে চাই বহুদূর।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম